এউইন জোসেফ জেরার্ড মরগান, বেঞ্জামিন অ্যান্ড্রু স্টোকস। জন্মসূত্রে একজন আইরিশ, অন্যজন কিউই। অথচ দুজনকে মানুষ চেনে ইংলিশ হিসেবে। ইংলিশ ক্রিকেটের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তাঁদের নাম। ১৪৫ বছরের ইংলিশ ক্রিকেট ইতিহাসে যা কেউ করে দেখাতে পারেননি, সেটাই করে দেখিয়েছেন এই দুজন। ২০১৯ বিশ্বকাপের স্বপ্নসারথিরা পাদপ্রদীপে এসেছেন একসঙ্গে, ইংলিশ ক্রিকেটের বদলে যাওয়ার অন্যতম নায়কও এই দুই ক্রিকেটার। কদিন আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলেছেন এউইন মরগান। তার পরপরই ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন বেন স্টোকসও। তাঁদের বদলে যাওয়া, বদলে দেওয়ার গল্পটা বুঝতে টাইম মেশিনে করে পাড়ি দিতে হবে ঠিক সাত বছর আগে।
৯ মার্চ, ২০১৫। অ্যাডিলেডে মুখোমুখি বাংলাদেশ আর ইংল্যান্ড। ১০ বলে দরকার ১৬ রান, হাতে মাত্র ১ উইকেট। এর থেকে বেশি কিছু মনে না করিয়ে দিলেও চলবে। সেদিন পরাক্রমশালী ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছিল বাংলাদেশ। অন্যদিকে পরপর দুই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে হেরে চুরমার হয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশদের দম্ভ। অস্ট্রেলিয়ায় সেবারের ব্যর্থ বিশ্বকাপ মিশন চোখ খুলে দেয় ইংলিশ ক্রিকেট বোর্ডের। আভিজাত্য আর ‘টেক্সটবুক’ মেনে ক্রিকেট চলে না। ক্রিকেট এগিয়ে গেছে বহুদূর।
অন্য কেউ বুঝতে না পারলেও বুঝতে পেরেছিলেন মরগান। কিন্তু বিশ্বকাপের মাত্র দুই মাস আগে অধিনায়কত্ব পেয়ে তেমন কিছুই করতে পারেননি। বোর্ডেরও সায় ছিল না পরিবর্তনে। কিন্তু ২০১৫ বিশ্বকাপ বদলে দেয় সবকিছু। ইংলিশ বোর্ডও বুঝতে পারে, বড়সড় একটা পরিবর্তন দরকার। আর সে দায়িত্ব তুলে দেয় মরগানের হাতে।
বিশ্বকাপের পরের নিউজিল্যান্ড সিরিজেই বদলে যায় ইংলিশ দল। ব্যাটিংয়ে অ্যালেক্স হেলস, জেসন রয়; বোলিংয়ে আদিল রশিদ, মার্ক উড। আর তুরুপের তাস হিসেবে রইলেন বেঞ্জামিন অ্যান্ড্রু স্টোকস। ২৩ বছর বয়সী বাদামিচুলো খেলোয়াড়কে মরগান পরিচয় করিয়ে দিলেন ভবিষ্যতের অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ হিসেবে। নিন্দুকেরা ধুয়ে দিলেন, দেখতে একরকম হলেই কি খেলোয়াড় এক রকম হয় নাকি? ২৪ ম্যাচে মাত্র একটা হাফ সেঞ্চুরি, বল হাতে ২০ উইকেট। তাঁকে ‘মিনি অলরাউন্ডার’ আখ্যা দিলেও যেন বেশি হয়ে যায়।
মরগানের দলে ম্যাচ জেতানো তারকার অভাব ছিল না। ব্যাটিং আর বোলিংয়ে নতুন-পুরোনোর মিশ্রণে যে ধামাকা তৈরি করতে চেয়েছিলেন, তা চোখে পড়েছে বিশ্বকাপের পরের সিরিজ থেকেই। প্রতি ম্যাচেই দল ছাড়িয়েছে ৩০০, মরগান মনে মনে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা সত্যি হয়ে ধরা দিচ্ছিল প্রতিনিয়তই। আর সেই দলেরই ট্রাম্পকার্ড ছিলেন বেন স্টোকস। ইংল্যান্ড দলের তারকারা প্রতিদিন ম্যাচ বের করে নিতেন, কিন্তু হুট করে চাপে পড়ে গেলেই ঘুরে দাঁড়াতেন বেন স্টোকস। যাঁর ছোঁয়ায় অজেয় ম্যাচেও জয়ী হয়ে ফেরত এসেছে মরগানের দল।
২০১৫ বিশ্বকাপের আগে যে স্টোকসের রান ছিল ১৫ গড়ে ২৮২ রান, সেই স্টোকসই দুই বিশ্বকাপের মাঝের চার বছরে করেছেন ৪৭ গড়ে ২৬৩৭ রান। বল হাতে ছিল ৪৩ উইকেট। ইংলিশ সমর্থকদের মনে নিজেকে দ্বিতীয় ফ্লিনটফ নয়, বরং জায়গা করে নিয়েছিলেন প্রথম স্টোকস হিসেবে।
একদিকে যখন বেন স্টোকস ব্যাটে–বলে সমান ছড়ি ঘোরাচ্ছেন, ঠিক একই সময়ে ব্যাট আর মাথা দিয়ে খেলছেন ‘আইরিশম্যান’ এউইন মরগান। মরগানের শুরুটা হয়েছিল আয়ারল্যান্ডের হয়ে। ২০০৭ বিশ্বকাপে অংশও নিয়েছেন আইরিশ জার্সি গায়ে দিয়ে। কিন্তু থ্রি লায়ন্সদের জার্সি গায়ে চড়ানোর লক্ষ্য ছিল তাঁর। বহু চড়াই–উতরাই পেরিয়ে ২০০৯ সালে ইংল্যান্ডের হয়ে অভিষেক হয় মরগানের। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০১৫ সালে একদিনের ক্রিকেট থেকে অধিনায়ক অ্যালিস্টার কুকের অবসর ও স্টুয়ার্ট ব্রডের অধিনায়কত্বে অনীহার কারণে নেতৃত্বের দায়িত্ব পড়ে মরগানের ওপর। আর সেটাকে কাঁধে তুলে নিয়েই শুরু করেন ইংলিশ ক্রিকেটের নতুন এক বিপ্লব। একসময়ের টেক্সটবুক ক্রিকেট ভুলে শুরু করেন ভয়ডরহীন ক্রিকেট। যেখানে প্রথম বল থেকে পরিকল্পনা একটিই। আক্রমণ আর আক্রমণ!
ফলাফল? ২০১৫ থেকে ২০১৯—চার বছরে ক্রিকেট ইতিহাসের সব রেকর্ড চুরমার করেছে ইংল্যান্ড। চার বছরে মোট ৩৮ বার ৩০০+ স্কোর করেছে তারা। এক ম্যাচে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ভেঙেছে দুই-দুইবার। ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ স্থান, চার বছরে সর্বোচ্চ ম্যাচ জয়; রেকর্ডের জয়জয়কার ছিল ইংলিশদের। অধিনায়ক মরগান ব্যাট হাতেও পিছিয়ে ছিলেন না; ইংল্যান্ডের জার্সিতে সর্বোচ্চ রান, সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ড করে নিয়েছিলেন নিজের।
চার বছরের যত অর্জন, যত পরিকল্পনা, এর সবই এই বিশ্বকাপের জন্য। নিজেদের মাটিতে বিশ্বকাপ, সেখান থেকেও যদি মাথা হেঁট করে ফিরতে হয়, তবে ষোলো আনাই যে মিছে। ইংলিশ সমর্থকদের হতাশ করেনি থ্রি লায়ন্সরা। একদিকে ব্যাট হাতে জো রুট, অন্যদিকে বল হাতে জফরা আর্চার। আর তাঁর সঙ্গে মরগানের বুদ্ধিদীপ্ত অধিনায়কত্ব তো আছেই। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছিল বেন স্টোকসের ক্যামিও। প্রতি ম্যাচেই কিছু না কিছু করে দলকে বের করে আনতেন খাদের কিনার থেকে।
গ্রুপ পর্বের ৯ ম্যাচের ৬টি জিতে সরাসরি সেমিফাইনালে; সেখানে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়াকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে ফাইনালে। বাকি রইল ফাইনাল, আর সেখানে প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড। সেই নিউজিল্যান্ড, যাদের বিপক্ষেই শুরু হয়েছিল ইংলিশ ক্রিকেটের নতুন উত্থানগাথা। তাদের হারিয়েই সেই মহাকাব্যের অন্তিম পরিসমাপ্তি টানতে চেয়েছিল ইংল্যান্ড। কিন্তু সে মহাকাব্য যে অন্য আরেক মহাকাব্যের রচনা করবে, তা জানা ছিল না কারোরই।
২৪২ রানের টার্গেটে ৭২ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলে ইংল্যান্ড। সে সময় মাঠে আসেন বেন স্টোকস। নেমেই রচনা করেন বিশ্বকাপ ফাইনালের অন্যতম সেরা এক ইনিংস। ৯৮ বলে অপরাজিত ৮৪ রানের রোমাঞ্চে ভরা সেই ইনিংস শেষে ম্যাচ শেষ হয় ২৪১ রানে। বিশ্বকাপ ফাইনাল গড়াল সুপার ওভারে।
কথায় আছে, বাস্তব নাটকের চেয়েও বেশি নাটকীয়। একে তো সুপার ওভার, তার ওপরে সুপার ওভারেও ম্যাচ টাই। ইংল্যান্ডের ১৫ রানের জবাবে নিউজিল্যান্ডেরও সংগ্রহ ছিল ১৫ রানই। শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপজয়ী নির্ধারিত হলো বাউন্ডারির ওপর নির্ভর করে।
লর্ডসের সোনালি রোদের গোধূলিতে ম্যান অব দ্য ফাইনাল হলেন বেন স্টোকস। সেই বেন স্টোকস, যিনি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালের শেষ ওভারে চার–ছক্কা হজম করে হতাশায় ডুবিয়েছেন গোটা ইংল্যান্ডকে। সেই বেন স্টোকস, যিনি বারে মারামারি করে দল থেকে নিষিদ্ধ হয়েছেন। এত কিছুর পরও একজনের ভরসা হারাননি অধিনায়ক এউইন মরগান। লর্ডসের গোধূলিতে এক ‘কিউই’য়ের ওপর ভর করে এক ‘আইরিশম্যান’ তুলে ধরলেন ইংল্যান্ডের পরম আরাধ্য বিশ্বকাপ।
বিশ্বকাপের পর থেকেই বয়সের ছাপ পড়তে থাকে মরগানের ব্যাটে, আস্তে আস্তে ফর্ম হারালেও অধিনায়কত্বে তার বিন্দুমাত্র ছাপ পড়েনি। একদিনের ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ভেঙেছেন আরেকবার। কিন্তু ফর্ম নিয়ে প্রশ্ন আসতে না আসতেই চলে এল প্যাডজোড়া খুলে রাখার ঘোষণা।
অন্যদিকে বেন স্টোকসও নিয়মিত তিন ফরম্যাটে খেলা চালিয়ে যেতে পারছিলেন না। অবসাদ দূর করতে কিছুদিন ক্রিকেটের বাইরেই ছিলেন। অধিনায়কের হঠাৎ বিদায় কি তাঁকে প্রভাবিত করল? মরগানের বিদায়ের এক মাসের মাথাতেই একদিনের ক্রিকেট ছাড়ার ঘোষণা দিলেন বেন স্টোকস। মরগানের মতো হুট করেই দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের মাঝামাঝি খেললেন ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডে।
২০১৫ বিশ্বকাপের পর ক্রিকেট–বিশ্ব দুজনের উত্থান দেখেছিল দুইভাবে। ইংলিশ ক্রিকেটকে বদলে দেওয়ার ইঞ্জিন যদি হন মরগান, স্টোকস ছিলেন তার স্টিয়ারিং হুইল। এক মাসের ব্যবধানে চলতি গাড়ি থেকে বিদায় নিলেন দুজনে। ইংলিশ ক্রিকেট সে ধাক্কা সামলাতে পারবে কি না সে প্রশ্ন দূরে থাক, ক্রিকেট–বিশ্বই সেই ধাক্কা সামলাতে অপারগ। তবু যাঁরা পুরো ক্যারিয়ার কাটিয়েছেন কোটি মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে, তাঁদের বিদায়ে কি মলিন মুখ মানায়?