আট বছর ধরে ফুটবল ফ্যানদের কাছে বছরের হিসাব করা বেশ সহজ। বছরে দুবার ঈদ আসে, দুবার দলবদলের মৌসুম আসে, আর মৌসুমের সঙ্গে সঙ্গে উড়ে আসে গুঞ্জন। এই মৌসুমেই রিয়াল মাদ্রিদে তরি ভেরাচ্ছেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। দল বদলের মৌসুম আর রিয়াল মাদ্রিদ-এমবাপ্পের গুঞ্জন তাই হয়ে উঠেছিল সমর্থক শব্দ। আট বছরের জল্পনা-কল্পনা শেষে এবার খুব সম্ভবত গুঞ্জনটা সত্য হতে যাচ্ছে। রাখালের মিথ্যা বাঘের গল্প নয়, সত্যি সত্যিই রিয়ালে তরি ভেরাতে যাচ্ছেন কিলিয়ান এমবাপ্পে।
রিয়ালের সঙ্গে এমবাপ্পের সম্পর্ক অনেক পুরোনো। গুঞ্জনের বহু আগে থেকেই রিয়াল মাদ্রিদের জন্য পাগল কিলিয়ান এমবাপ্পে। এমবাপ্পের সঙ্গে রিয়ালের প্রথম সাক্ষাৎ ২০০৯ সালে। এমবাপ্পের বয়স তখন মাত্র ১১, বাবার হাত ধরে স্পেন এসেছিলেন রিয়াল মাদ্রিদ অনূর্ধ্ব-১২ দলের জন্য ট্রায়াল দিতে। সেসময় অবশ্য ইউরোপের বড় বড় বেশ কয়েকটা দলেই ট্রায়াল দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদ তখনই মন ছুঁয়ে গিয়েছিল তাঁর। কিন্তু সন্তানকে নিজেদের কাছে রাখতে, ইউরোপের বড় বড় দলকে পাশ কাটিয়ে এমবাপ্পে ভর্তি হয়েছিলেন মোনাকোর যুব দলে।
মোনাকোর যুব দল যে এমবাপ্পের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল, তা কয়েক মৌসুমের মধ্যেই বুঝতে শুরু করেন ফুটবল–বোদ্ধারা। ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো এমবাপ্পেকে চিনতে শুরু করে বিশ্ব। মোনাকোকে নিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমি ফাইনাল খেলে সকলের নজরের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন তিনি। তখন থেকেই ইউরোপের বড় বড় দলের সঙ্গে নিয়মিত গুঞ্জন তাঁর।
বাকি সব গুঞ্জন একে একে সরে যায়, একটা ছাড়া। ছোটবেলা থেকেই রিয়ালের পাঁড় ভক্ত এমবাপ্পে। এমনকি রিয়াল মাদ্রিদ আর রোনালদোর ছবি দিয়ে সাজানো ছিল এমবাপ্পের ঘর। এতকিছুর পর রিয়াল মাদ্রিদ যে এমবাপ্পের ভবিষ্যৎ হতে যাচ্ছে, সে নিয়ে কারও সংশয় ছিলই না। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে প্রথম এমবাপ্পেকে কেনার চেষ্টা করে রিয়াল। কিন্তু এত দ্রুতই নিজেদের তারকা খেলোয়াড়কে হারাতে চাচ্ছিল না মোনাকো, তাই রিয়ালের ১৮০ মিলিয়ন ইউরোর প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় তারা। বরং ফ্রেঞ্চ লিগের প্রতিদ্বন্দ্বী পিএসজির কাছে এক মৌসুমের জন্য এমবাপ্পেকে ধার দেয় মোনাকো। এক মৌসুম পর তাদের কাছেই ১৮০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে এমবাপ্পেকে পাকাপাকিভাবে বিক্রি করে দেয় মোনাকো। রিয়াল-এমবাপ্পে মহাকাব্যের মূল ভিলেনের আগমণ সেখান থেকেই।
পিএসজিতে যাওয়ার পর থেকে রিয়ালের সঙ্গে এমবাপ্পের গুঞ্জনে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। প্রতি মৌসুমেই নতুন করে গুঞ্জন শুরু হতো, আবার সেটা মিলিয়েও যেত। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বিদায়ের পর আর এডেন হ্যাজার্ডের আগমনে অনেকটাই স্থিমিত হয়ে পড়েছিল এমবাপ্পের নাম। কিন্তু এর মাঝেই হুটহাট মিডিয়ার হেডলাইন হয়ে উঠত এমবাপ্পে আর রিয়ালের জুটি। ২০২১ সালের এপ্রিলে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এমবাপ্পের নাম। ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ টিভিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমবাপ্পে প্রশ্নের উত্তর দেন ‘ত্রানকুইলো’। অর্থাৎ সবুর করো। লুইস ফিগো, ডেভিড বেকহামের মতো বড় নামকে রিয়ালে ভেরানোর আগেও ঠিকই একই কথা বলেছিলেন পেরেজ। সকলে মনে মনে ধরেই নেয়, যত দামই হোক না কেন, রিয়াল এবার এমবাপ্পেকে এনেই ছাড়বে। দলবদলের মৌসুম আসতে না আসতেই সামনে ছড়াতে থাকে পিএসজিমালিক নাসের আল খেলাইফি আর এমবাপ্পের দ্বন্দ্বের কথা। বাড়তে থাকে গুঞ্জনের পরিমাণ। এমবাপ্পেকে পাওয়ার জন্য ১৬০ মিলিয়ন ইউরো পর্যন্ত অফার করতে রাজি হয়েছিল রিয়াল। কিন্তু তা ফিরিয়ে দিয়ে আরেক মৌসুমের জন্য এমবাপ্পেকে নিজেদের করে রাখে পিএসজি।
২০২২ সাল ছিল এমবাপ্পের চুক্তির শেষ মৌসুম। চুক্তি নবায়ন না করলে রিয়াল মাদ্রিদ এমবাপ্পেকে দলে নিতে পারবে। এমবাপ্পে তো অনেক আগে থেকেই রাজি, তাহলে তাঁকে দলে আনতে আর বাধা কী? বাধা হয়ে দাঁড়ান স্বয়ং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ এমবাপ্পেকে অনুরোধ করলেন আরেকটা মৌসুম ফ্রান্সে থেকে যাওয়ার জন্য। অন্তত বিশ্বকাপের মৌসুমে অন্য কোনো দেশে না যাওয়ার জন্য। দেশপ্রধানের অনুরোধ ফেলে দেওয়ার সাধ্য কারইবা আছে? পিএসজির সঙ্গে দুই বছরের জন্য চুক্তি বৃদ্ধি করলেন এমবাপ্পে। বিশ্বকাপ মৌসুমে এমবাপ্পের ‘না’ বলা বেশ আঁতে লাগে রিয়াল মাদ্রিদের। তাই এমবাপ্পেকে বাদ দিয়েই নিজেদের দল সাজানো শুরু করে তারা।
গত মৌসুমে তাই প্রতিবারের থেকে দলবদলের মৌসুমে বেশ শান্তই ছিল রিয়াল। নিজেদের প্রয়োজনমাফিক খেলোয়াড় কিনে চুপিসারে মার্কেট থেকে সরে দাঁড়িয়েছে তারা। এমবাপ্পে–বিষয়ক কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দেয়নি রিয়াল। এই মৌসুমেও তাদের অবস্থানটা ঠিক একইরকম। এমবাপ্পে যদি আসতে চায় আসবে, নইলে না। রিয়াল আর নিজে থেকে দলবদলের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে না। যে কারণে ‘৭’ নম্বর জার্সিটা চড়িয়ে দিয়েছে ভিনিসিয়ুসের গায়ে, ভিনিও তাঁর সর্বোচ্চটা দিয়ে যাচ্ছেন এই জার্সিতে। ৯ নম্বর জার্সি বরাদ্দ রয়েছে এনড্রিকের জন্য, এমবাপ্পে আসতে চাইলে কোন জার্সি পাবেন, সে নিয়েও একটা প্রশ্ন আছে। তবে দলবদলের মৌসুম যত ঘনিয়ে আসছে, ততই বাড়তে শুরু হয়েছে এমবাপ্পে মহাকাব্য। এই মৌসুম শেষে আবারও ফ্রি এজেন্ট হয়ে যাচ্ছেন তিনি। তাঁকে দলে নিতে আলাদা করে খরচ করতে হবে না কাউকে। রিয়ালে যোগ দেওয়া যেখানে অনেকটাই নিশ্চিত, ঠিক তখনই এমবাপ্পেকে আবারও নিজের বাসভবনে ডেকে পাঠিয়েছেন ফ্রান্স প্রেসিডেন্ট ও কাতারের আমির। লক্ষ্যটা কী, তা নিশ্চয় আর ভেঙে বলতে হবে না। এখনও পর্যন্ত বল রিয়ালের কোর্টেই আছে, কিন্তু কখন অবার সেটা পিএসজির কোর্টে চলে যায়, তার নিশ্চয়তা নেই।
প্রশ্ন করতে পারো, দুনিয়ার এত দল থাকতে শুধু রিয়ালের সঙ্গেই এমবাপ্পের গুঞ্জন কেন? কারণটা স্বাভাবিক, সেরা খেলোয়াড়েরা বরাবরই সেরা দলে যেতে চায়। আর বর্তমানে দলবদলের যা অবস্থা, এতে করে এমবাপ্পেকে কেনা এবং তাঁর বেতন দেওয়ার মতো ক্লাব খুবই কম আছে বিশ্বে। যে কারণে এমবাপ্পেকে কেনার দৌড়ে আগেই পিছিয়ে গিয়েছে অনেকে। এছাড়াও ইউরোপীয় ঐতিহ্যের একটা ব্যাপারও আছে। পিএসজিতে অনেক দিন টাকাপয়সায় ডুবে ছিলেন তিনি। কিন্তু ইউরোপীয় সাফল্য ছিল অধরা। এক রিয়ালের কাছেই দুবার হেরে নিজের স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে তাঁকে। মেসি-নেইমারের মতো সতীর্থরাও ফিকে হয়ে গিয়েছে রিয়ালের সামনে। ইউরোপীয় সাফল্যের জন্য মুখিয়ে থাকা এমবাপ্পে অন্য কোনো দলে গিয়ে নিজের এই সুবর্ণ সুযোগ হারাতে চান না। যে কারণে রিয়াল মাদ্রিদই তাঁর প্রথম পছন্দ।
কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকেরা ঠকে ঠকে শিখে গেছেন। এমবাপ্পেকে নিয়ে মিডিয়ায় লাফালাফি হলেও রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকেরা ক্লাবের মতোই চুপচাপ, শান্ত। কারণ, তাঁরা জানেন, গত চার-পাঁচ মৌসুম ধরে এমবাপ্পে মানেই ধোঁকা। অন্য ক্লাবের সমর্থকদের কাছে বারবার হাসির পাত্র হতে হয়েছে এই এক খেলোয়াড়কে নিয়ে। তাই শেষ সিদ্ধান্ত আসার আগ পর্যন্ত রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকদের মধ্যেও চলছে চাপা আশা-নিরাশা।
শেষমেশ এমবাপ্পের রিয়ালে যোগ দেওয়ার সূত্রটা দাঁড়িয়েছে এইচএসসির বাংলা প্রথমপত্রের এমসিকিউ প্রশ্নের মতো। সবদিক দিয়েই মনে হচ্ছে এমবাপ্পের গন্তব্য রিয়াল মাদ্রিদই। ফেসবুকে উড়ে বেড়ানো উত্তর দেখেও নিশ্চিত, এটাই সঠিক উত্তর। কিন্তু মনের মধ্যে একটা ভয় থেকেই যায়, যতক্ষণ না এমবাপ্পেকে ওই সাদা জার্সিতে দেখছে, ততক্ষণ এই সত্য বিশ্বাস করতে নারাজ ফুটবল–বিশ্ব।