লিওনেল মেসি যে ব্যালন ডি’অর জিততে চলেছেন, তা অলিখিতভাবেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর। আর্জেন্টিনাকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্বকাপ জেতানো অধিনায়কই যে পরবর্তী ব্যালন ডি’অরের মালিক, সে নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ ছিল না কারও। অসময়ে বসা বিশ্বকাপ সেই সমীকরণে কিছুটা তো রদবদল এনেছেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই ব্যালন ডি’অর সেরেমনির পর প্রশ্ন উঠছে, লিগ মৌসুমে অনেকটাই নিজের ছায়া হয়ে থাকা লিওনেল মেসি কি সত্যিই ব্যালন ডি’অরের যোগ্য ছিলেন?
২০২২-২৩ মৌসুমে লিওনেল মেসির পারফরম্যান্সকে দুই ভাগে ভাগ করা সম্ভব। লিগের জার্সিতে আর আর্জেন্টিনার জার্সিতে। লিগের জার্সিতে লিওনেল মেসি যতটা নিষ্প্রভ ছিলেন, জাতীয় দলের জার্সিতে ছিলেন ঠিক ততটাই উজ্জ্বল। ক্লাবের জার্সিতে মেসির এই নিষ্প্রভতা বার্সেলোনা ছাড়ার পর থেকেই লক্ষণীয়। পিএসজিতে তাঁর প্রথম মৌসুম তো ছিল ভুলে যাওয়ার মতো এক অধ্যায়। মাত্র ৬ গোল করে ব্যালন ডি’অরের তালিকা থেকেও নিজের জায়গা হারান মেসি। ১৫ বছরের ইতিহাস ভেঙে সে বছর মেসিকে ছাড়াই ঘোষণা হয় ব্যালন ডি’অরের ছোট্ট তালিকা। ব্যালন ডি’অরের তালিকা থেকে বাদ পড়াকে অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন মেসির শেষের শুরু হিসেবে।
কিন্তু তত দিনে লিওনেল মেসির লক্ষ্যটা পাল্টে গেছে বহুগুণে। বার্সেলোনায় তিনিই ছিলেন সর্বেসর্বা। পিএসজিতে তেমনটা নয়, বরং এমবাপ্পে-নেইমারই তাদের পোস্টারবয়। আড়াল থেকে একটু কলকাঠি নাড়লেও খুব একটা প্রভাব পড়েনি দলে। তাই তো ক্ষিপ্রগতিতে পুরো মাঠ দাপিয়ে না বেরিয়ে চেষ্টা মেসির চেষ্টা ছিল পেছন থেকে খেলা নিয়ন্ত্রণ করার। তাতে সফলও হয়েছেন বটে। পিএসজিতে থাকাকালীন বিশ্বকাপের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করাই হয়ে উঠেছিল লিওনেল মেসির একমাত্র লক্ষ্য।
বিশ্বকাপে মেসি কী করেছেন, তা যে বিশেষণেই বিশেষায়িত করা হোক না কেন, কম হয়ে যায়। ৩৬ বছর ধরে যে স্বপ্ন পূরণের জন্য অধীর আগ্রহে বসে ছিলেন আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা, সেই স্বপ্নকে সত্যি করেছেন মেসি। আগ বছর আগে যে স্বপ্ন পূরণ করতে না পেরে ব্রাজিলের মারাকানা স্টেডিয়ামে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন আর্জেন্টিনার ‘নাম্বার টেন’, সেই তিনিই আট বছর পর কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে পূরণ করেছেন নিজের স্বপ্ন। মাঠের ভেতরে–বাইরে আর্জেন্টিনার প্রত্যেক সমর্থক মেতেছিলেন এক সুরে, এক নামে—লিওনেল মেসি!
আর তার প্রতিফলন ছিল ব্যালন ডি’অরের ভোটে। সবাইকে ছাড়িয়ে অষ্টমবারের মতো ব্যালন ডি’অরের স্বর্ণালি বল নিজের করে নিলেন লিওনেল মেসি। ইউরোপের বাইরে খেলেও ব্যালন ডি’অর বাগিয়ে নিতে বিন্দুমাত্র কষ্ট করতে হয়নি তাঁকে। মেসির সঙ্গে লড়াইয়ে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান দখল করেছেন আর্লিং হালান্ড ও কিলিয়ান এমবাপ্পে। দুজনের সঙ্গে মেসির পার্থক্য যৎসামান্যই। সেই পার্থক্যটা কি মেসিকে জেতানোর জন্য যথেষ্ট ছিল?
সে জন্য ফিরে তাকাতে হবে লিওনেল মেসির প্রতিপক্ষদের দিকেও। ব্যালন ডি’অরের দৌড়ে দ্বিতীয় হয়েছেন আর্লিং হালান্ড। গত মৌসুমে শিরোপার দিক দিয়ে হালান্ডের পাল্লাটাই সবচেয়ে বেশি ভারী। ম্যানচেস্টার সিটির চ্যাম্পিয়নস লিগ স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তাঁর হাত ধরে। প্রথমবারের মতো জিতে নিয়েছেন ট্রেবল। ৫৩ ম্যাচে ৫২ গোল করে গত মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলদাতাও এই নরওয়েজিয়ান তারকা। কমতি শুধু একটাই—নরওয়ের জার্সিতে বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ হয়নি তাঁর।
অন্যদিকে রয়েছেন একই সঙ্গে তাঁর সতীর্থ ও প্রতিপক্ষ কিলিয়ান এমবাপ্পে। বিশ্বকাপ ফাইনালের রাতে এমবাপ্পের ছড়ানো আলোর নিচে প্রায় চাপা পড়েই গিয়েছিলেন লিওনেল মেসি। হ্যাটট্রিকসহ মোট চারবার আর্জেন্টিনার জালে বল জড়িয়েছেন ফরাসি তারকা। কিন্তু সতীর্থদের ব্যর্থতায় টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জেতা হয়নি তাঁর। ৪৩ ম্যাচে ৪১ গোল করে গোল ব্যবধানেও মেসিকে পেছনে ফেলেছেন এমবাপ্পে। নামের পাশে রয়েছে লিগ ওয়ান শিরোপা। সেটা অবশ্য ভাগাভাগি করে নিয়েছেন মেসির সঙ্গেই।
তবে লিওনেল মেসি সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন একটি জায়গাতেই। বিশ্বকাপ! ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ টুর্নামেন্টে মেসির পারফরম্যান্স ছিল অসাধারণ। ৭ গোল, ৩ অ্যাসিস্ট। পুরো মৌসুমে পারফরম্যান্সে যতই পিছিয়ে থাকুন না কেন, লিওনেল মেসি তাঁর সামর্থ্যের সর্বোচ্চটা দিয়েছেন বিশ্বকাপের মঞ্চে। শুধু দিয়েই ক্ষান্ত হননি, ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপের শিরোপা নিয়ে ফিরেছেন আর্জেন্টিনায়। পুরো বিশ্বের আনাচ-কানাচ ছড়িয়ে থাকা আর্জেন্টাইন ভক্তদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন তিনি।
পুরো মৌসুমের পারফরম্যান্স চিন্তা করলে বাকিদের তুলনায় মেসি একটু পিছিয়েই আছেন। ৫৫ ম্যাচে তাঁর গোলসংখ্যা মাত্র ৩২! শুধু তা–ই নয়, মৌসুম শেষে ইউরোপিয়ান ফুটবলকেও বিদায় বলেছেন তিনি। যোগ দিয়েছেন মেজর লিগ সকারের দল ইন্টার মায়ামিতে। সেখানেও যে বলার মতো পারফর্ম করতে পারছেন, ব্যাপারটা তেমন নয়। চোটের কারণে বেশ অনেক দিন ধরেই মাঠের বাইরে তিনি। যে কারণে প্লে-অফ খেলা থেকে বঞ্চিত হয়েছে তাঁর দল। আগামী পাঁচ মাস আর্জেন্টিনার জার্সি বাদে মেসিকে মাঠে দেখার তাই আর কোনো সম্ভাবনাই নেই।
পুরো মৌসুমের কথা বিবেচনা করলে ব্যালন ডি’অরের মঞ্চে লিওনেল মেসির একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার কিছুটা অবকাশ থাকেই। তবে যে সমীকরণে বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স প্রবেশ করে, তখনই সব প্রশ্নের উত্তর এসে থামে লিওনেল মেসিতেই। গত ২০ বছরের ব্যালন ডি’অর পারফরম্যান্স বিবেচনা করা যাক। বিশ্বকাপের মৌসুমে ব্যালন ডি’অরের মালিক হয়েছেন হয় বিশ্বজয়ী কেউ, নয়তো রানার্সআপ হওয়া কোনো খেলোয়াড়। ২০০২ সালে বিশ্বজয়ী রোনালদো, ২০০৬ সালে বিশ্বজয়ী ফ্যাবিও ক্যানাভারো আর ২০১৮ সালে রানারআপ লুকা মদরিচ। ব্যতিক্রম ছিল ২০১০ ও ২০১৪ সালের ব্যালন ডি’অর। সে দুই বছর বিশ্বকাপের ফাইনাল না খেলেও ব্যালন ডি’অর জিতে নেনে যথাক্রমে লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। এ নিয়ে অবশ্য সমালোচনাও কম হয়নি।
তবে অলিখিতভাবে একটা জিনিস নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে, বিশ্বকাপের মৌসুমে ব্যালন ডি’অর জয়ে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলে বিশ্বকাপই। তাই ঘুরেফিরে এটুকু বলা যায়, লিওনেল মেসির অষ্টম ব্যালন ডি’অর নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ সেই ১৮ ডিসেম্বরই শেষ করে দিয়েছেন তিনি।