স্টুয়ার্ট ব্রড: ছয় ছক্কা থেকে ছয় শ উইকেট
ছেলেকে নিজের মতোই বানাতে চেয়েছিলেন ক্রিস ব্রড। ঘরোয়া ক্রিকেটে ৩০ হাজারের ওপরে রান, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৭টা সেঞ্চুরি করা ক্রিস ছিলেন ইংল্যান্ডের ওপেনার। ১৯৮৬-এর অ্যাশেজে পরপর তিন ম্যাচে সেঞ্চুরি করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। একমাত্র ছেলেকে নিজের চেয়েও সেরা ব্যাটসম্যান বানাতে চাইবেন, তাতে অবাক হওয়ার কী আছে!
ছোটবেলায় অবশ্য বাবার দেখানো পথেই হেঁটেছিলেন স্টুয়ার্ট। ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শুরুতে বাবার মতোই বাঁহাতি ওপেনিং ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি। তারপর যখন হঠাৎ করে বয়ঃসন্ধিকালে লম্বা হতে শুরু করলেন, এক্সট্রা বাউন্স পাওয়া যাবে বলে শুরু করলেন বোলিং। পার্টটাইম বোলার হিসেবে হাত ঘোরাতে ঘোরাতে দলের নিয়মিত পেসার হয়ে ওঠেন স্টুয়ার্ট ব্রড। কোনোরকম উদ্দেশ্য ছাড়া ফাস্ট বোলার হয়ে ওঠার এমন গল্প সচরাচর শোনা যায় না। কিংবা শোনা গেলেও এ রকম কিংবদন্তির উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে কয়জন?
অনূর্ধ্ব ১৯, ‘এ’ দল পার করে যখন ইংল্যান্ডের জাতীয় দলে ডাক পেলেন, স্টুয়ার্ট ব্রডের বয়স মাত্র ২০ বছর। ২০০৬ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখলেন ব্রড। ঠিক এক বছর পরই তাঁর জীবনে নেমে আসে বিভীষিকার মতো এক রাত। প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মঞ্চে ভারত বনাম ইংল্যান্ডের ম্যাচ। ইনিংসের ১৯তম ওভারে বল করতে এলেন স্টুয়ার্ট ব্রড, অপর প্রান্তে ব্যাটিংয়ে যুবরাজ সিং। প্রথম বলটা করলেন খাটো হাফভলি লেংথে, কিছুটা স্লোয়ার। কিন্তু সেটাকে সজোরে হাঁকিয়ে প্রায় স্টেডিয়ামের বাইরে পাঠিয়ে দিলেন যুবরাজ। পরের বলও একই লেংথে, তবে এবার কিছুটা মিডল স্টাম্প বরাবর। এটাকেও কবজির মোচড়ে ঘুরিয়ে গ্যালারিতে পাঠিয়ে দেন যুবরাজ, ছক্কা। তার পরের চারটি বলের ভাগ্যও তা–ই। সেই রাতে এক ওভারে ছয়-ছয়টি ছক্কা হাঁকানোর বিশ্ব রেকর্ড করেন যুবরাজ সিং। বোলার হিসেবে দুমড়েমুচড়ে যাওয়ার মতো এক অভিজ্ঞতা! তাঁর ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারত সেখানেই। কিন্তু ওই রাতই ব্রডের মধ্যে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে।
কঠোর পরিশ্রম আর বাঁধাধরা রুটিন, একেবারে বাইবেলের মতো মানতে শুরু করেন তিনি। বোলার হিসেবে প্রায় সাড়ে ছয় ফুট উচ্চতার কারণে বাড়তি বাউন্স আদায় করে নেওয়ার সুযোগ পেতেন। সেই সঙ্গে তিনি শিখতে থাকেন কাটার, স্লোয়ার এবং লেংথ মেপে বল করা। বোলিং অ্যাকশন পরিবর্তন করে নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের পুরোনো অ্যাকশনে ফিরে যান। ধীরে ধীরে এসবের ফল আসতে শুরু করে। ছয় ছক্কার ঘটনার মাত্র ১১ মাসের মাথায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচে ক্যারিয়ার–সেরা স্পেলটি করেন ব্রড। গ্রায়েম স্মিথ, গিবস, ক্যালিসের উইকেটসহ ৫টি উইকেট নেন মাত্র ২৩ রানের বিনিময়ে এবং এর সবগুলোই নিজের লেংথ মেপে ও সুইং-কাটার বোলিংকে কাজে লাগিয়ে।
গল্পের নায়কের মতো ঘুরে দাঁড়িয়ে ব্রডকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ইংল্যান্ডের অন্যতম ভরসার পাত্র হয়ে ওঠেন তিনি। নিজের প্রথম অ্যাশেজ সিরিজে ইংল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়া, ব্যাট হাতেও অবদান রাখা—সব মিলিয়ে স্বপ্নের মতো দিন যেতে থাকে তাঁর। ‘চেরি অন দ্য টপ’ হিসেবে যুক্ত হয় ২০১০-এর টি২০ বিশ্বকাপ জয়। ৮ উইকেট নিয়ে সেই টুর্নামেন্টেও দারুণ খেলেছিলেন তিনি।
ইংলিশ ক্রিকেটের আধুনিক পোস্টার বয় হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ব্রডকে ধরা হয়েছিল টি-টোয়েন্টির অন্যতম তারকা হিসেবে। কিন্তু সাক্ষাৎকারে বারবারই তিনি বলেছেন টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসার কথা। সবাই যখন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগ খেলে নাম-যশ-খ্যাতির পাশাপাশি মোটা অঙ্কের অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত, ব্রড বেশির ভাগ সময়ই নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন ওই ডামাডোল থেকে। তাঁর কাছে গ্রীষ্মের প্রথম টেস্টের সকাল কিংবা লর্ডসের মাঠে খেলা অ্যাশেজ ম্যাচের চেয়ে অসাধারণ কিছু আর হয় না।
টেস্ট ম্যাচের প্রতি এই অকুণ্ঠ ভালোবাসা ধীরে ধীরে তাঁকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। যেখানে তিনি সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন আরেক ইংলিশ বোলার জেমস অ্যান্ডারসনকে। প্রতিপক্ষের কাছে রীতিমতো ত্রাস এই দুজনের বোলিং জুটি। অ্যান্ডারসনের পেস এবং সুইং যদি হয় মেশিনগানের মতো বিধ্বংসী, তবে ব্রডের লেংথ এবং কাটার বোলিং হবে স্নাইপারের মতো নিখুঁত ধীশক্তির উদাহরণ।
কেবল যে বোলিং ব্রডের একমাত্র শক্তি, তা–ই নয়। ছোটবেলায় ওপেনার হওয়ায় ব্যাটিংটাও বেশ ভালো জানতেন তিনি। লর্ডসের মাটিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৬৯ রানের এক কাব্যিক ইনিংস আছে তাঁর। পাশাপাশি ১১টা হাফ সেঞ্চুরিও তাঁর ব্যাটিং–দক্ষতার প্রমাণ দেয়। একসময় ফ্লিনটফের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে ধরা হতো ব্রডকে। কিন্তু ২০১৫ সালে মাথার মারাত্মক একটা ইনজুরি যতিচিহ্ন এনে দেয় তাঁর ব্যাটিংয়ে। স্বাচ্ছন্দ্যে আর ব্যাটিং করতে পারেননি তিনি।
দীর্ঘ ১৬ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারে ধারাবাহিকতা ধরে রাখা ব্রডকে আলাদা করেছে অন্যদের থেকে। এই ৩৭ বছরে এসেও ইংল্যান্ডের হয়ে অ্যাশেজে সর্বোচ্চ উইকেট নিয়েছেন। আর তাতেই টপকে গেছে ৬০০ উইকেটের ল্যান্ডমার্ক। বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখানো ব্রড তাই আরও অনেক দিন খেলবেন বলেই আশা করছিলেন ক্রিকেট ভক্তরা। অ্যাশেজের শেষ টেস্টের মধ্যে তাঁর ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর ঘোষণা চমকে দিয়েছে সবাইকে। মাথা উঁচু করে মাঠ থেকে বিদায় নিতে চেয়েছিলেন তিনি। বিধাতাও তাতে সায় জানিয়েছেন। ক্যারিয়ারের শেষ বলে অস্ট্রেলিয়ান উইকেটরক্ষক অ্যালেক্স ক্যারিকে আউট করে যেন রূপকথা লিখলেন ব্রড। এর চেয়ে সুন্দর চিত্রনাট্য আর হয় না। নটিংহামের সেই ছোট্ট ছেলেটার নামের পাশে এখন ৬০৪টি টেস্ট উইকেট—টেস্ট ইতিহাসের পঞ্চম সর্বোচ্চ, পেসারদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, এমনকি ইংল্যান্ডেরও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়া বোলারের মেডেল তাঁর গলায়। অথচ ছেলেবেলায় তিনি ফাস্ট বোলার হওয়ার স্বপ্নই দেখেননি। ছেলেকে ব্যাটসম্যান বানাতে চাওয়া বাবা ক্রিসও এখন ছেলের বোলিং নিয়ে গর্ব করেন। কিংবদন্তিদের গল্প বোধ হয় এমনই হয়!