বাংলায় একটা কথা আছে, ‘যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়াপড়শির ঘুম নাই’। ১৯৬৬ বিশ্বকাপ শুরুর আগমুহূর্তে বিশ্বকাপের অবস্থা ছিল অনেকটা এ রকমই। বিশ্বকাপ শুরুর জন্য সবাই তৈরি। কিন্তু বিশ্বকাপ ট্রফির খবর নেই। চুরি হয়ে গেছে সে ট্রফি।
বিশাল বিশ্বযুদ্ধ যে শিরোপার গায়ে আঁচ ফেলতে পারেনি, সেই বিশ্বকাপ কিনা চুরি হয়ে গেল ফুটবলের দেশে এসে? ফুটবল নিয়ে নিজেদের বড়াইয়ের শেষ নেই ইংলিশদের। কিন্তু সে দেশে এসেই বিশ্বকাপ শিরোপার এমন তিরোধান? সেবার বিশ্বকাপ থেকেও বেশি আলোচিত ছিল বিশ্বকাপের তিরোধান-কাব্য।
বিশ্বকাপের প্রায় ছয় মাস আগেই আয়োজক দেশে ট্রফি পাঠানোর নিয়ম ফিফার। সেবারও ব্যতিক্রম হয়নি। জুলে রিমে ট্রফি প্রদর্শনের জন্য রাখা হয় লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার হলে। বিশ্বকাপ ট্রফি সামনে থেকে একনজর দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে ইংল্যান্ডবাসী। কিন্তু নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা সত্ত্বেও চোখের সামনে থেকেই হাওয়া হয়ে যায় বিশ্বকাপ শিরোপা। রেডিও-টেলিভিশনের সুবাদে মুহূর্তেই জেনে যায় পুরো বিশ্ব—চুরি হয়ে গেছে বিশ্বকাপ ট্রফি।
পরদিন বিশ্বকাপ ট্রফির মুক্তিপণ হিসেবে চাওয়া হয় ১৫ হাজার পাউন্ড। সেটাও দিতে হবে ১ আর ৫ টাকার নোটে। পুলিশের ফন্দিতে চোর ধরা পড়ল বটে, কিন্তু ট্রফির হদিস নেই কোথাও। বিশ্বকাপ শুরুর কয়েক দিন আগে এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে নিজেদের বাঁচাতে রেপ্লিকা ট্রফিও বানিয়ে রাখে ফিফা। কিন্তু ফিফা ও ইংল্যান্ডের মান বাঁচাতে এগিয়ে আসে পিকলস। ডাস্টবিনে পলিথিনে মোড়ানো সেই ট্রফি আবিষ্কার করে ‘পিকলস’ নামের সেই কুকুর। রাতারাতি ইংল্যান্ডের নায়ক বনে যায় ‘পিকলস’। পেলে, বেকেনবাওয়ার, লেভ ইয়াশিন, ববি মুরকে সরিয়ে বিশ্বকাপের সবচেয়ে জনপ্রিয় তারকা হয়ে ওঠে পিকলস।
তবে বিশ্বকাপ নিয়ে ইংল্যান্ডের সমস্যার শুরু আরও আগে থেকে। পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে নিজেদের দেশে বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বত্ব পায় ইংল্যান্ড। বিশ্বকাপের বছরখানেক আগে বিশ্বকাপ থেকে নাম সরিয়ে নেয় আফ্রিকান দেশগুলো। বাকি সব দেশ যখন বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব জিতে সরাসরি অংশ নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে বিশ্বকাপে, সেখানে আফ্রিকানদের প্লে-অফ খেলতে হতো এশিয়ানদের বিপক্ষে। এমন অযৌক্তিক নিয়মের প্রতিবাদে ১৯৬৬ বিশ্বকাপ থেকে নিজেদের নাম সরিয়ে নেয় আফ্রিকান দেশগুলো। যদিও দক্ষিণ আফ্রিকা চেষ্টা করেছিল এশিয়ান দেশ হিসেবে নাম লেখানোর, কিন্তু আফ্রিকান দেশগুলোর চাপে শেষ পর্যন্ত নাম সরিয়ে নেয় তারাও।
প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে দেখা মেলে বিশ্বকাপ মাসকট—ওয়ার্ল্ড কাপ উইলি নামক এক সিংহকে। অঘটনঘটনপটীয়সী বিশ্বকাপের সূচনা হয় ১১ জুলাই। বিশ্বকাপের জন্য নির্ধারিত উইন্ডোর প্রায় এক মাস পরে।
বিশ্বকাপ সবার নজর ছিল ব্রাজিলের দিকেই। টানা দুই বিশ্বকাপ জিতে ব্রাজিল তখন ফর্মের তুঙ্গে। টানা তৃতীয় আর জুলে রিমে বিশ্বকাপ নিজেদের করে নেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই ইংল্যান্ডে ভিড়েছিল ব্রাজিল। কিন্তু আবারও বাদ সাধে ইনজুরি। প্রথম ম্যাচেই চোটে পড়েন পেলে। আর বয়সের কারণে আগের বিশ্বকাপের মতো ‘ওয়ান ম্যান শো’ চালাতে পারেননি গারিঞ্চা। ফল—বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকেই বাড়ির টিকিট কাটতে হয় ব্রাজিলকে।
বিশ্বকাপের সারপ্রাইজ প্যাকেজ ছিল পর্তুগাল। ‘কালো চিতা’খ্যাত ইউসেবিও একাই ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন বাকি দলগুলোর জন্য। ঠিক কতটা? প্রমাণ উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল। ম্যাচের ২৫ মিনিটেই ৩-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল উত্তর কোরিয়া। প্রথম এশিয়ান দল হিসেবে বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন তখন তাদের চোখে-মুখে। ইউসেবিওর ‘কালো চিতা’ নামের প্রমাণ মিলল সেখানেই। পরপর ৪ গোল আর এক অ্যাসিস্ট করে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে ফেললেন উত্তর কোরিয়াকে।
যদিও পর্তুগালের বিশ্বকাপযাত্রা থেমে যায় পরের ম্যাচেই। সেমিতে ইংল্যান্ডের কাছে ২-১ গোলে হেরে শেষ হয় তাদের বিশ্বকাপের স্বপ্নযাত্রা। অন্যদিকে লেভ ইয়াসিনের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে একই ব্যবধানে জিতে ফাইনালের টিকিট কাটে ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের পশ্চিম জার্মানি। বিশ্বকাপ আয়োজন থেকে শুরু করে ইংলিশ আর জার্মানদের অমীমাংসিত এক ঠান্ডা যুদ্ধের সমাধান মিলবে ফাইনালে। আর সেই ওয়েম্বলির ফাইনালই হয়ে রইল বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম রোমাঞ্চকর ফাইনাল।
লন্ডনের বিখ্যাত ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ৯৮ হাজার দর্শকের সামনে মুখোমুখি হয় পশ্চিম জার্মানি আর ইংল্যান্ড। স্বাগতিকদের চাপে ফেলে ম্যাচের ১২ মিনিটেই এগিয়ে যায় পশ্চিম জার্মানি। হেলমুট হেলার এগিয়ে নেন জার্মানিকে। ৬ মিনিটের মাথায় সেই গোল পরিশোধ করে স্বাগতিকদের সমতায় ফেরান জিওফ হার্স্ট। ৭৮ মিনিটে ইংল্যান্ডকে এগিয়ে নেন মার্টিন পিটারস। ইংল্যান্ডবাসী যখন শিরোপার আনন্দে উদ্বেলিত তখনই তাদের আনন্দে জল ঢেলে দেন উলফগ্যাং ওয়েবার। শেষ বাঁশি বাজার মিনিটখানেক আগে জার্মানিকে সমতায় ফেরান ওয়েবার।
২-২ গোলে সমতায় শেষ হয় নির্ধারিত ৯০ মিনিট, খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। আলোচনা-সমালোচনার সূচনা এখান থেকেই। ১০১ মিনিটে ডি-বক্সের ভেতর থেকে শট নেন জিওফ হার্স্ট। সে শট ক্রসবারে লেগে মাটিতে ড্রপ করে আবার বেরিয়ে আসে লাইন থেকে। জার্মানি-ইংল্যান্ড দুই দলই ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের দাবি জানাতে। অতিরিক্ত সময়ের গোল, একটা সিদ্ধান্তই বদলে দিতে পারে চিত্রনাট্য। রেফারির সঙ্গে আলোচনা করে লাইন্সম্যান তৌফিক বাহমারুফ সেটিকে গোল বলেই ঘোষণা দেন। ইংল্যান্ড যখন ব্যস্ত গোল উদ্যাপনে, জার্মানি তখন গোল বাতিলের দাবিতে সোচ্চার। যদিও আধুনিক নিয়ম অনুযায়ী সেই বলের ৯৭% লাইনের ভেতরে ছিল, অর্থাৎ বর্তমান সময়ের ভিএআর দ্বারা সে গোল বাতিল হয়ে যেত নিমেষেই। কিন্তু মাঠের সর্বেসর্বা তো সেই রেফারিই। তাঁর কথা মেনে নিয়ে আবারও খেলায় নামে জার্মানি। কিন্তু জিওফ হার্স্টের চমক দেখানো বাকি তখনো। ১২০ মিনিটে জার্মানির কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেন হার্স্ট। প্রথমবারের মতো বিশ্বজয়ের আনন্দে মাতে ইংল্যান্ড।
ব্রিটেনের সদ্য প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের কাছ থেকে বিশ্বকাপ শিরোপা বুঝে নেন ইংলিশ অধিনায়ক ববি মুর। তাঁর হাত ধরেই ফুটবল অবশেষে ফেরে নিজের বাড়িতে। সেই প্রথম আর সেই শেষবারের মতো বাড়ির দেখা পেয়েছিল বিশ্বকাপ।