এমন কি কখনো হতে পারে, কেউ অলিম্পিকে পদক জেতেনি কিন্তু তারপরও তিনি হিরো? শুনে মনে হবে, এ আবার কেমন কথা! অলিম্পিকে সবাই আসে পদক জিততে। যাঁরা পদক জেতেন, তাঁদের সবাই হিরো মানে। তাঁরাই ‘ভিক্টরি স্ট্যান্ডে’ আসেন। তাঁদের সবাই ছবি তোলে। পত্রিকায় তাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। ইতিহাসে তাঁদেরই নাম উল্লেখ থাকে বাকিদের কথা প্রায় সবাই ভুলে যায়।
কিন্তু এমনটাও হতে পারে যে অলিম্পিকে সবার শেষে যে দৌড় শেষ করল, তাঁকে নিয়ে সবাই মাতামাতি করছে, তাঁর সাক্ষাৎকার পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে, এমন কি তাঁর জীবনী ক্লাসে পড়ানো হচ্ছে। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা সত্যি!
ক্যামেরা আর সাংবাদিকেরা তাঁকে ঘিরে ধরল। জাপানের প্রচারমাধ্যমে লেখা হলো, রানাতুঙ্গে একজন বীর। জাপানের সাংবাদিক হারুয়ো সুজুকি ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি রানাতুঙ্গের সাক্ষাৎকার নেন।
হ্যাঁ, এমন অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটেছিল ১৯৬৪ সালে। সেবার অলিম্পিকের আসর বসেছিল জাপানের রাজধানী টোকিওতে। সেবার অলিম্পিকের অনেক ঘটনার মধ্যেও একজন ব্যক্তির কাহিনি সবার মধ্যে এক আলাদা অনুভূতির জন্ম দিয়েছিল, তিনি এমন এক ব্যক্তি, যিনি পদক জয় না করেও সবার মন জয় করে নিয়েছিল। তাঁর নাম রানাতুঙ্গে করুনানন্দ।
নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে তাঁর দেশ শ্রীলঙ্কা। তবে দেশটা তখনো শ্রীলঙ্কা হয়নি, তখন দেশটির নাম সিলন। টোকিও অলিম্পিকে রানাতুঙ্গে করুনানন্দ সেবার ৫০০০ মিটার ও ১০,০০০ মিটার দৌড়ে অংশ নেন। ৫০০০ মিটার দৌড়ে তিনি শেষ থেকে দ্বিতীয় হন।
কিন্তু রানাতুঙ্গে করুনানন্দ অসাধারণ কীর্তি গড়েন ১০,০০০ মিটার দৌড়ে। স্টেডিয়ামভর্তি দর্শক প্রথমে রানাতুঙ্গের শেষ দুই ল্যাপ বা রাউন্ডের দৌড় দেখে হাসি, তামাশা ও ঠাট্টা করতে শুরু করে, কিন্তু সেই হাসি ও ঠাট্টা দ্বিতীয় মানে শেষ ল্যাপে এসে আনন্দ ও উৎসাহে পরিণত হয়, যখন তাঁরা রানাতুঙ্গের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারে।
ঘটনা হচ্ছে সকল প্রতিযোগী যখন ১০,০০০ মিটার দৌড় শেষ করেছে তখনো এই দূরত্ব শেষ করতে রানাতুঙ্গের দুই ল্যাপ বা দুবার রাউন্ড দেওয়া বাকি ছিল। অন্য যে কেউ হলে সেখানে বাকি দৌড় না দিয়ে প্রতিযোগিতায় ক্ষান্ত দিত। কিন্তু রানাতুঙ্গে যখন শেষ ধাপের প্রথম রাউন্ড দৌড়ানো শুরু করলেন, তখন পুরো ট্র্যাক ফাঁকা।
যার ফলে সবাই তাঁকে বিদ্রূপ করা শুরু করল। কিন্তু যখন তিনি শেষ রাউন্ড দৌড়ানো শুরু করলেন, তখন সবাই বুঝে ফেলল যে তিনি আসলে ১০,০০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতার সব রাউন্ড শেষ করেই থামবেন, তখন গ্যালারিভর্তি দর্শকের সবাই তাঁকে উৎসাহ প্রদান করা শুরু করল, যেন তিনি দৌড় শেষ করেই থামে। রানাতুঙ্গে ফিনিশিং লাইন স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে পুরো স্টেডিয়াম হাততালিতে ভরে গেল।
ক্যামেরা আর সাংবাদিকেরা তাঁকে ঘিরে ধরল। জাপানের প্রচারমাধ্যমে লেখা হলো, রানাতুঙ্গে একজন বীর। জাপানের সাংবাদিক হারুয়ো সুজুকি ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি রানাতুঙ্গের সাক্ষাৎকার নেন। সেই সাক্ষাৎকার রানাতুঙ্গে বলেছিলেন ‘অলিম্পিকের অনুপ্রেরণা মানে এতে অংশগ্রহণ, কেবল পদক জেতা নয়। আমি জানি আমি অলিম্পিকে পদক জিততে আসিনি, কিন্তু আমি যে দৌড়ে অংশ নিতে এসেছি, আমি সে দৌড় শেষ করেই অলিম্পিক থেকে বিদায় নেব।’
পরের দিন জাপানের ভক্তরা রানাতুঙ্গের জন্য নানা উপহার পাঠাতে শুরু করেন। সেই উপহারের পরিমাণ এত হয়ে যায়, অলিম্পিক ভিলেজের কর্তারা রানাতুঙ্গেকে একটা চিরকুট পাঠায় এই লিখে, ‘আপনার জন্য যে উপহারসামগ্রী এসেছে, সেগুলো আমরা একটা ব্যাগে ভরেছি। এই ব্যাগটা এত ভারী যে এটা আমরা বয়ে আপনার কাছে নিয়ে যেতে পারছি না, আপনি কি সেটা আমাদের কাছ থেকে আপনার রুম পর্যন্ত নিয়ে যেতে সাহায্য করবেন?’
জাপানের পাঠ্য বইয়ের একটি কাহিনির নাম, ‘জার্সি নম্বর ৬৭, সবার শেষে দৌড় শেষ করেও যিনি হিরো’।