বড় প্রতিপক্ষকে সিরিজ হারানোটার প্রত্যাশাটা তো সবসময়ই থাকে, আর সেটা যদি হয় ঘরের মাঠে, তাহলে সেটা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। বিদেশে যেমনই হোক, দেশের মাটিতে প্রত্যাশাটা কিন্তু বাংলাদেশ দল ভালোই পূরণ করতে পারছে। বড় দলকে সিরিজ হারানোটা পরিণত করছে অভ্যাসে।
শুরুটা হয়েছিল নিউজিল্যান্ডকে দিয়ে, ২০১০ সালে। সেবার পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ সাকিবরা জিতে নিয়েছিলেন ৪-০ ব্যাবধানে। বৃষ্টির কারণে এক ম্যাচ পরিত্যক্ত না হলে ফলটা ৫-০ হতেই পারত। কয়েক বছর পর, ২০১৩ সালে আবারও ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডকে পেয়ে নাকাল করে টাইগাররা, তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয় কিউইরা। তত দিনে হোয়াইটওয়াশের নাম হয়ে গিয়েছে ‘বাংলাওয়াশ’, আর ঘরের মাঠে আমরা হয়ে উঠছি অপ্রতিরোধ্য।
তবে ঘরের মাঠে বাংলাদেশের স্বর্ণযুগের সূচনা ২০১৫ বিশ্বকাপের পর। ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো শক্তিশালী দলের বিপক্ষে সিরিজ জিতে নেয় বাংলাদেশ। এত এত ম্যাচ জিতলেও, একটা ‘কিন্তু’ রয়ে গিয়েছিল। যে সিরিজগুলো বাংলাদেশ জিতছিল, সব কটিই ছিল ওয়ানডে সিরিজ। টেস্ট বা টি-টোয়েন্টি সিরিজে আসছিল না জয়। বিশেষ করে টি-টোয়েন্টিতে কোনোভাবেই সুবিধা করতে পারছিল না বাংলাদেশ। এমনকি বাংলাদেশের অনেক পরে খেলা শুরু করা আফগানিস্তান, আয়ারল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি দল তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো খেলছিল।
অবস্থা আস্তে আস্তে উন্নতি হতে থাকে ২০২১ সাল থেকে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ সফরে আসে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড। দুটি দলের বিপক্ষেই টাইগাররা খেলে পাঁচ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয় আসে ৪-১ ব্যবধানে, আর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষের জয়টা ৩-২। সিরিজ জিতলেও অতিরিক্ত স্পিনিং আর বাজে উইকেট বানানোর কারণে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় বিসিবিকে। পাশাপাশি এমন উইকেটে শক্তি পরীক্ষাটাও হয়ে ওঠে প্রশ্নবিদ্ধ। তাই সিরিজ জিতলেও একটা খচখচানি রয়েই গিয়েছিল সবার মনে।
সেটা দূর হয়ে গেল ইংল্যান্ড সিরিজে।
টি-টোয়েন্টি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজটা ছিল তিন ম্যাচের। ঘরের মাঠে সব সময় অতিরিক্ত স্পিনিং পিচ বানিয়ে প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করা বাংলাদেশ এবার ভাবে ভিন্ন কিছু করার। প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ইংল্যান্ড ব্যাটিংয়ে নামতেই পরিষ্কার হয় রহস্যটা। এবারের পিচটা যে মোটেও স্পিনিং নয়, পুরোদস্তুর স্পোর্টিং পিচ!
স্পোর্টিং পিচে স্পিনাররা বেশি সুবিধা পাবেন না, এটা স্বাভাবিক। ফলে দায়িত্ব তুলে নেন দলের পেসাররা। দুর্দান্ত শুরু করা ইংল্যান্ডের লাগাম টেনে ধরেন তাসকিন, মোস্তাফিজরা। আর ডেথ ওভারে ঝলক দেখান হাসান মাহমুদ। ২০০ রানের বেশি করার শঙ্কা জাগানো বাটলাররা থেমে যান ১৫৬ রানেই। নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের পর ব্যাটিংয়েও ভালো করে টাইগাররা, ম্যাচ জিতে নেয় ৬ উইকেটে।
সিরিজের বাকি দুই ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় মিরপুরে। দ্বিতীয় ম্যাচে সেই চিরায়ত স্পিনিং উইকেটের দেখা। ফলে ইংল্যান্ড অলআউট ১১৭ রানে, বাংলাদেশ জয়ী ৪ উইকেটে।
কিন্তু আজকের ম্যাচে আবারও দেখা পাওয়া গেল বেশ ভালো একটা পিচের। খুব একটা ব্যাটিং সহায়ক উইকেট ছিল আজকে, তা হয়তো না। তবে ব্যাটসম্যানদের জন্য কিছুটা সুবিধা যে ছিল, অস্বীকার করা যাবে না সেটাও। প্রথমে রনি, লিটন আর শান্তর ব্যাটিংয়ে একসময় তো মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের রান ছাড়িয়ে যাবে ১৮০। ইংলিশদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে তা হয়নি, তবে স্কোরবোর্ডে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা তোলেন যথেষ্ট রান। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ইংল্যান্ড ব্যাটিংয়ে নামার পর। দারুণ জুটির পর একই ওভারে বাটলার আর মালান আউট হয়ে গেলে আর ম্যাচে ফিরতে পারেনি তাঁরা, শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয় ১৬ রানে। প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে জয় পায় বাংলাদেশ।
টি-টোয়েন্টি বাংলাদেশের জন্য সব সময়ই দুর্বোধ্য এক ফরম্যাট। দেশের মাটিতেও ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট এই ফরম্যাটে হিমশিম খেতে হতো টাইগারদের। এই কঠিন সংস্করণে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের মতো পরাশক্তির বিপক্ষে সিরিজ জয়, তা–ও আবার হোয়াইটওয়াশ—বাংলাদেশের কাছে এটি অসম্ভবকে সম্ভব করার মতোই একটা ব্যাপার। বিশেষ করে ওয়ানডে সিরিজ হারের পর ভক্ত-সমর্থক থেকে সমালোচক—সবাই ধরে নিয়েছিলেন যে এবার আর সিরিজ জয় পাওয়া হচ্ছে না বাংলাদেশের। অপরাজেয়ই থেকে যাচ্ছে ইংল্যান্ড। সেই আশঙ্কাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে ৩-০ ব্যাবধানেই জয় তুলে নিল বাংলাদেশ। সাকিবের নেতৃত্বে দলের তরুণেরা গাইলেন নতুন দিনের গান, আর জানান দিয়ে গেলেন, আগামী বছরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে হতে যাচ্ছে ভালো কিছুই।