ইউরো ২০২৪: গ্রুপ এ—ঘরের মাঠে জার্মানি কি কাটাতে পারবে ২৮ বছরের ইউরো–খরা

যদি তোমাকে প্রশ্ন করি, জার্মানি শেষ কবে ফুটবলে আন্তর্জাতিক শিরোপার দেখা পেয়েছিল? তাহলে হয়তো খুব সহজেই উত্তরটা তোমরা দিয়ে দিতে পারবে। ২০১৪ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল জার্মানরা। কিন্তু যদি প্রশ্ন করি, জার্মানি শেষবার ইউরো কবে জিতেছিল? তাহলে হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর দিতে বেশ চিন্তাভাবনা করতে হবে। কারণ, তারা শেষ ইউরো জিতেছে সেই ১৯৯৬ সালে। এরপর দীর্ঘ ২৮ বছর ইউরোতে কোনো সাফল্যের দেখা পায়নি জার্মানি। বলার মতো সর্বশেষ সাফল্য ২০০৮ সালে। সেবার ইউরোর ফাইনালে উঠলেও স্পেনের কাছে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয় তাদের। একটা দেশ এত দীর্ঘ সময় ইউরো জেতে না, কিন্তু তোমরা কি জানো, ইউরোর ইতিহাসে স্পেনের সঙ্গে জার্মানিই সবচেয়ে সফল দল। কারণ, উভয়েই মোট তিনবার করে ঘরে তুলেছে ইউরো শিরোপা।

জার্মানি নিজেই এবার ইউরো আয়োজক। ঘরের মাঠে দীর্ঘ ২৮ বছরের ইউরো জুজু কাটানোর সুবর্ণ সুযোগ। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে তারা কতটা প্রস্তুত এবার? চলো, ইউরোর গ্রুপ এ-এর বাকি দলগুলোর সার্বিক অবস্থা বোঝার পাশাপাশি জার্মানির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে তোলার পর ইউরো থেকে বিশ্বকাপ কোনো টুর্নামেন্টই বিশেষ ভালো কাটেনি জার্মানদের। ২০১৮ আর ২০২২ বিশ্বকাপেও জার্মানি আগাগোড়া হতাশ করেছে। আর ২০১৬ সালের ইউরোতে সেমিফাইনালে ফ্রান্সের কাছে এবং ২০২০ সালের রাউন্ড অব সিক্সটিনে ইংল্যান্ডের কাছে হেরে ইউরো স্বপ্নও শেষ হয়ে যায় তাদের। বিশ্বকাপ জয়ের পরবর্তী বছরগুলোতে জার্মানি দলে খুব একটা বদল আসেনি। কোচের আসনে ছিলেন জোয়াকিম লো। প্রায় একইরকম এক দল নিয়ে তিনি জার্মানির ডাগ আউটে থাকেন ২০২১ সাল পর্যন্ত। সে বছর বিশ্বকাপজয়ী কোচ পাল্টে জার্মানরা নিয়ে আসে হ্যান্স ডিয়েটার–ফ্লিককে, যিনি বায়ার্ন মিউনিখকে আগের বছরে ট্রেবল জিয়েছিলেন। ফ্লিকের সঙ্গে দলে নতুন কিছু তরুণ মুখের দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু এই দলের একাদশের মধ্যকার রসায়নটা তিনি ঠিক তৈরি করতে পারেননি। হারের বৃত্তে ঘুরতে থাকার পর ফ্লিকের পরিবর্তে জার্মানদের দায়িত্ব আসেন ৩৬ বছর বয়সী জুলিয়ান নাগেলসম্যানের কাছে।

দীর্ঘ ২৮ বছর শিরোপার দেখা পায়নি জার্মানি
এএফপি

যদিও নাগেলসম্যান দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রীতি টুর্নামেন্ট ছাড়া আর কিছু খেলার সুযোগ পাননি। প্রথম দিকে কিছু ম্যাচ হেরে গেলেও শেষের দিকে নেদারল্যান্ডস আর ফ্রান্সকে হারিয়ে তারা দিয়েছে ঘুরে দাঁড়ানোর আভাস। তাই বলা যায়, ইউরোই এই তরুণ কোচের জন্য জন্য প্রথম বড় মঞ্চ। আর বেশ কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্তের পরও এই মঞ্চে তিনি যে দলটাকে নিয়ে যাচ্ছেন, সেখানেও তারুণ্য ও অভিজ্ঞতার দারুণ সংমিশ্রণ ঘটেছে।

তবে এই দলটার মূল ভরসা আসলে মাঝমাঠ। অবসর থেকে টনি ক্রুস ফেরার পরই যে জার্মান মিডফিল্ডের চেহারা পাল্টে গেছে, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। গোলবারে নয়্যার এবং ডিফেন্সে নিয়মিত মুখদের পাশাপাশি এবার ইউরোতে তাক লাগাতে পারে জার্মানদের এই মধ্যমাঠ। ক্রুস হয়তো প্রতিটা ম্যাচের ৯০ মিনিট খেলতে পারবেন না, কিন্তু ৩০ থেকে ৪০ মিনিট মাঠে থেকে তাঁর অভিজ্ঞতার ছোঁয়া তিনি মাঠে রেখে যাবেন, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তাই এখন দেখার বিষয়, এই বর্ষীয়ান মিডফিল্ডারকে কোন কৌশলে ব্যবহার করেন নাগেলসম্যান।

ঘরের মাঠে নাগেলসম্যানের অধীনে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে খেলবে জার্মানি

ক্রুসের পাশাপাশি মাঝমাঠে নিয়মিত থাকবেন বার্সেলোনার মিডফিল্ডার ইলকায় গুনদোয়ান এবং বায়ার লেভারকুসেনের হয়ে ইতিহাস রচনা করা ফ্লোরিয়ান ভারটজ ও রবার্ট আনড্রিখ। বায়ার্ন মিউনিখের তরুণ তুর্কি জামাল মুসিয়ালাও থাকবেন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের ভূমিকায়। আর ফরোয়ার্ডে আর্সেনালের হয়ে দারুণ একটা মৌসুম পার করা কাই হাভার্টজের পাশাপাশি ফুলক্রুগ, উনদাব আর টমাস মুলাররা তো থাকছেনই। তবে আক্রমণভাগের একমাত্র দুর্বলতার কথা বললে প্রথাগত একজন নাম্বার নাইনের অভাব জার্মানকে ভোগাতে পারে। কারণ, হাভার্টজকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে চাইলে নাগেলসম্যানকে ফলস নাইন কৌশলে যেতে হবে। কিন্তু প্রথাগত নাম্বার নাইনের সঙ্গে ৪-৩-৩ ছক খেলালে হাভার্টজ সেভাবে কাজে নাও লাগতে পারেন।

আরও পড়ুন

তাই দলের শক্তিমত্তা এবং কোচের কৌশলগত দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। তবে সর্বোপরি এই দলের একমাত্র দুর্বল দিক হতে পারে নাগেলসম্যান এবং জার্মান ফুটবলারদের বোঝাপড়া। কারণ, এই দল আর কোচের মধ্যে কৌশলগত দিকের বয়স মাত্র কয়েকটি প্রীতি ম্যাচের।

একটা সোনালি প্রজন্মের শেষের পর দীর্ঘদিন হাঙ্গেরি ফুটবলের বড় আসরে জায়গা পায়নি। কিন্তু গত এক দশকে ফুটবলের বড় মঞ্চগুলোতে তাদেরকে নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। গ্রুপ পর্বে হাঙ্গেরিকে নিয়ে প্রথম থেকেই জার্মানদের মনে একটা ভয় কাজ করলেও করতে পারে। কারণ, তাদের সঙ্গে গত শেষ তিন ম্যাচে কোনো জয় পায়নি নাগেলসম্যানের শিষ্যরা।

সাদা চোখে গ্রুপ এ–কে সাধাসিধে দেখালেও হাঙ্গেরি, স্কটল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ড—যেকোনো প্রতিপক্ষকে যেকোনো মুহূর্তে কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলতে পারে। সেই সামর্থ্য যেমন তাদের আছে, পাশাপাশি বিশ্বকাপ থেকে ইউরো প্রতিটা টুর্নামেন্টে তারা তাদের সামর্থ্যকে প্রমাণও করেছে।

ইংল্যান্ডের সঙ্গে সমানে সমান লড়াই করেছে স্কটল্যান্ড

প্রথমে আসি স্কটল্যান্ডের কথা। যদিও ইউরোর মঞ্চে শেষ পাঁচ ম্যাচে তারা জার্মানিকে হারাতে পারেনি। ইউরোপিয়ান বাছাইপর্বে টানা জিতে আসা দলটা সাম্প্রতিক সময়ে ফর্ম হারালেও বেশ কয়েকজন দুর্দান্ত খেলোয়াড় আছেন তাদের দলে। লিভারপুলের রবার্ট অ্যান্ডারসন, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের স্কট ম্যাকটমিনিয়ে ছাড়াও অ্যাস্টন ভিলার জন ম্যাকগিন আর ব্রাইটনের বিলি গিলমোরের মতো প্রিমিয়ার লিগে নিয়মিত খেলা কিছু মুখ আছে স্কটল্যান্ড দলে। তবে তাঁদের সাম্প্রতিক পারফর্মেন্স দেখে ধরে নেওয়া যেতে পারে, হয়তো প্রথম ম্যাচেই জার্মানির জন্য তারা খুব একটা কঠিন প্রতিপক্ষ হবে না।

এরপর আসবে হাঙ্গেরির কথা। একটা সোনালি প্রজন্মের শেষের পর দীর্ঘদিন হাঙ্গেরি ফুটবলের বড় আসরে জায়গা পায়নি। কিন্তু গত এক দশকে ফুটবলের বড় মঞ্চগুলোতে তাদেরকে নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। গ্রুপ পর্বে হাঙ্গেরিকে নিয়ে প্রথম থেকেই জার্মানদের মনে একটা ভয় কাজ করলেও করতে পারে। কারণ, তাদের সঙ্গে গত শেষ তিন ম্যাচে কোনো জয় পায়নি নাগেলসম্যানের শিষ্যরা। প্রীতি ম্যাচগুলো বাদ দিলে হাঙ্গেরি শেষ আট ম্যাচে হারের দেখা পায়নি। আর মারকো রসির দলে সাম্প্রতিক ফর্মও বলে যে গ্রুপ এ থেকে পরের রাউন্ডে যাওয়াই তাঁদের মূল লক্ষ্য। এ ছাড়াও লেফটব্যাক কেরকেস, লিভারপুলের দমিনিক স্লাবসোজাই এবং রোনাল্ড সাল্লাইদের বর্তমান এই দলটা এতটাই অনির্দেশ্য যে জার্মানির মতো কঠিন প্রতিপক্ষকেও তারা ধরাশায়ী করে দিতে পিছপা হবে না। তবে তাদের দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ ও প্রধান গোলরক্ষক পিটার গুলাসির চোটে ছিটকে যাওয়া তাদের ইউরো যাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়াতেও পারে।

সুইজারল্যান্ডকেও হিসেবে রাখতে হবে। সুইজারল্যান্ডের কথা ভেবে কিছুটা অস্বস্তিতে বোধ করতেই পারে জার্মানি।

গ্রুপ এ–এর শেষ দেশ সুইজারল্যান্ড। প্রতিবারই বিশ্বকাপ আর ইউরোর মতো টুর্নামেন্টগুলোতে নিয়মিত গ্রুপপর্বে জায়গা করে নেয় তারা। আর এই গ্রুপের পরাশক্তি হিসেবে জার্মানিকে ধরলে, সুইজারল্যান্ডকেও হিসেবে রাখতে হবে। সুইজারল্যান্ডের কথা ভেবে কিছুটা অস্বস্তিতে বোধ করতেই পারে জার্মানি। কারণ, ২০২০ সালের উয়েফা নেশন্স লিগে টানা দুইবার ড্র করার পর সুইসদের সঙ্গে বিশ্বকাপে হারার রেকর্ডও রয়েছে তাদের। যদিও সেসব বেশ আগের কথা। কিন্তু ম্যাচের আগে পরিসংখ্যান তো এই রেকর্ডগুলো সামনে তুলবেই।

আরও পড়ুন

তবে সুইজারল্যান্ডের সাম্প্রতিক ফর্ম খুব একটা ভালো না। ইউরোপিয়ান বাছাইপর্বে রোমানিয়ার মতো দুর্বল প্রতিপক্ষের কাছে হেরেছে তারা। পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নিয়েছে কসোভো, ইসরায়েল আর বেলারুশের সঙ্গে। তবে ইয়ান সমার, ম্যানুয়েল আকাঞ্জি আর গ্রানিত শাকারেন ওপর ভরসা করে সুইসরা এবারও তাকিয়ে থাকবে পরবর্তী রাউন্ডের আশায়।

২০১৮ আর ২০২২ বিশ্বকাপেও জার্মানি আগাগোড়া হতাশ করেছে।

তাই ধরে নেওয়া যায়, খুব বিশেষ কোনো অঘটন না ঘটলে এই গ্রুপ থেকে পরবর্তী রাউন্ডে জার্মানির দেখা মিলবে। তবে দ্বিতীয় স্থানের জন্য মূল লড়াইটা হবে হাঙ্গেরি আর সুইজারল্যান্ডের মধ্যে। তাই ১৫ জুনের হাঙ্গেরি ও সুইজ্যারল্যান্ডের মধ্যকার ম্যাচই হয়তো দিয়ে দেবে সকল প্রশ্নের উত্তর।

গ্রুপ এ–এর ম্যাচসমূহ:

রাউন্ড এক:

জার্মানি বনাম স্কটল্যান্ড ১৫ জুন (রাত ১টা)

হাঙ্গেরি বনাম সুইজারল্যান্ড ১৫ জুন (সন্ধ্যা ৭টা)

রাউন্ড দুই:

জার্মানি বনাম হাঙ্গেরি ১৯ জুন (রাত ১০টা)

স্কটল্যান্ড বনাম সুইজারল্যান্ড ২০ জুন (রাত ১টা)

রাউন্ড তিন:

সুইজারল্যান্ড বনাম জার্মানি ২৪ জুন (রাত ১টা)

স্কটল্যান্ড বনাম হাঙ্গেরি ২৪ জুন (রাত ১টা)

আরও পড়ুন