প্রথম বিশ্বকাপের সাফল্য ফিফাকে এনে দিয়েছিল অনন্য সম্মান। পৃথিবীর সামনে বদলে গিয়েছিল তাদের অবস্থান। ইস্পাত কঠিন পণ নিয়ে বিশ্বকাপের সূচনা করা ফিফার সামনে এখন লক্ষ্য এই সাফল্য ধরে রাখা। ব্রিটিশদের পদত্যাগে সবাই ধরেই নিয়েছিল, তাসের ঘরের মতো ভেঙে পরবে ফিফা। কিন্তু সফল বিশ্বকাপ আয়োজন করে ফিফা চমকে দিয়েছে সবাইকে।
তবে ইউরোপের বাইরে প্রথম বিশ্বকাপের আয়োজন ভালো চোখে দেখেনি অনেকেই। কিন্তু চার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সবার অভিমান গলে পরিণত হলো পানিতে। ইউরোপেই হতে চলছে বিশ্বকাপ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিশ্বকাপ আয়োজনের কঠিন দায়িত্ব উঠতে যাচ্ছে কার হাতে?
তালিকার প্রথম নাম ছিল ফ্রান্স। দৌড়ে ছিল স্পেনও। কিন্তু সবাইকে হটিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পেল ইতালি। ফিফার আট বৈঠকের পরও যখন সমতায় আসতে পারছিল না কেউ, তখন ভোটাভুটিই ছিল একমাত্র সমাধান। ভোটে জিতেই নিজেদের মাটিতে বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে ইতালি।
ইউরোপ তখন আস্তে আস্তে নিজের পায়ে দাঁড়ানো শুরু করেছে। স্প্যানিশ ফ্লু আর ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ ইউরোপের অর্থনীতির যে ভঙ্গুর অবস্থার তৈরি করেছিল, তা থেকে আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে তারা। বিশ্বকাপ ছিল পৃথিবীর কাছে নতুন করে তাদের প্রমাণ করার সুযোগ। যার অর্থ, ইউরোপ হারিয়ে যায়নি।
প্রথম বিশ্বকাপের অভাবনীয় সাফল্যে ফিফার আত্মবিশ্বাসই তখন তুঙ্গে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল ফুটবলের প্রতি আগ্রহী দলের সংখ্যা। চার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ফিফার সদস্যসংখ্যা বেড়ে যায় দ্বিগুণেরও বেশি। ১৯৩৪ বিশ্বকাপে অংশ নিতে চাওয়া দলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৬-এ। কিন্তু এতগুলো দলকে তো বিশ্বকাপে সুযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। অগত্যা নতুন নিয়ম ভাবতে হলো ফিফাকে। আর প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে দেখা যায় বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ার রাউন্ড।
বাছাইপর্বে ৩৪ দেশ থেকে বিশ্বকাপের জন্য বেছে নেওয়া হয় সেরা ১৬ দলকে। বিশ্বকাপের আগমুহূর্তে বেঁকে বসে উরুগুয়ে। আগের বিশ্বকাপে আন্টলান্টিক পাড়ি দিয়ে উরুগুয়েতে খেলতে যায়নি ইউরোপিয়ানরা। তাই ইউরোপিয়ান দলগুলোর বিপক্ষে প্রতিবাদস্বরূপ বিশ্বকাপ বর্জন করে উরুগুয়ে। ওদিকে প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছে মিসর। ইউরোপের ১২ দল আর ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, যুক্তরাষ্ট্র ও মিসরকে নিয়ে সূচনা হলো দ্বিতীয় বিশ্বকাপের।
প্রথম বিশ্বকাপের মতো এই বিশ্বকাপেও ছিল গ্রুপ পর্ব। ১৬টি দলকে ৪ গ্রুপে ভাগ করা তো আরও সহজ। কিন্তু বিশ্বকাপের দিন কয়েক আগে হঠাৎই বেঁকে বসল ফিফা। ঠিক বেঁকে বসল না, বসানো হলো। একেবারে বিলুপ্ত করে দেওয়া হলো বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব। ৮ জোড়া দলকে ভাগ করা হলো ৮টি ম্যাচে। আর এই ৮ ম্যাচের চ্যাম্পিয়নই সুযোগ পাবে পরবর্তী পর্বে। প্রথম ম্যাচেই বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ল ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স। দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বিশ্বকাপ পরিণত হলো ‘অল ইউরোপ গেম’-এ। সেখান থেকে ফাইনাল নিশ্চিত করল ইতালি আর চেকোস্লোভাকিয়া।
কিন্তু পুরো বিশ্বকাপ শেষেও একটা ‘কিন্তু’ থেকে যায়। উরুগুয়ে বিশ্বকাপ যতটা রঙিন আর আনন্দে ভরপুর ছিল, ইতালি বিশ্বকাপ ছিল ঠিক ততটাই মলিন আর দোদুল্যমান শঙ্কায় ভরপুর।
৩০-এর দশক ছিল ইউরোপে ফ্যাসিজমের আঁতুড়ঘর। মহামারি আর ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ বা মহামন্দায় যখন ইউরোপের ছন্নছাড়া অবস্থা, তখন সে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ফ্যাসিজম। আর তার প্রবাদপুরুষ ছিলেন ইতালির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বেনিতো মুসোলিনি। এক পাশে স্পেনের ফ্র্যান্সিস্কো ফ্র্যাঙ্কো, অন্যদিকে জার্মানির অ্যাডলফ হিটলার; সব মিলিয়ে ইউরোপজুড়ে তখন ফ্যাসিজমের কালো ছায়া। আর সেখান থেকে নিজেদের ভাবমূর্তি উন্নত করতে বিশ্বকাপ ছিল বড় অস্ত্র। ফ্রান্সের কাছ থেকে একপ্রকার জোরজবরদস্তি করেই বিশ্বকাপের আয়োজন ছিনিয়ে নিয়েছিল ইতালি। সেখানে থেমে থাকলেও হতো।
বিশ্বকাপের কয়েক দিন আগে মুসোলিনির নির্দেশেই পাল্টে ফেলা হয়েছিল বিশ্বকাপের ফরম্যাট। পুরো বিশ্বকাপ আয়োজন করা হয়েছিল নক আউট পদ্ধতিতে। যাতে শুরুতেই ইউরোপের বাইরের দলগুলো বাদ পড়ে যায়। ইউরোপই যে বিশ্বের সেরা—এই চিত্রই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন মুসোলিনি। প্রতিটি ম্যাচ শেষে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পুরস্কার বিতরণ করতেন ইতালির রাষ্ট্রপ্রধান। গুঞ্জন আছে, ইতালি ম্যাচের রেফারিও নিজেই ঠিক করতেন তিনি। এমনকি ফাইনালের আগের দিন সব রেফারিকে বাসায় ডেকে বিশেষ আপ্যায়নও করিয়েছেন তিনি। উদ্দেশ্য একটাই, পৃথিবীর সামনে ইতালি ও মুসোলিনির একটা ভালো ভাবমূর্তি তৈরির এক ঘৃণ্য প্রচেষ্টা, যার বলি হয়েছিল ফুটবল।
১৯৩৪ সালের ১০ জুন, মাঠে গড়াল বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আসরের ফাইনাল। রোমের স্তাদিও ন্যাজিওনালে জড়ো হলো ৫৫ হাজার দর্শক। ৯০ মিনিট শেষ ফলাফল ১-১। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ফাইনাল গড়াল অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ের ৫ মিনিটের মাথায় অ্যাঞ্জেলো শিয়াভিওর গোলে এগিয়ে যায় ইতালি। আর সে গোলেই নিশ্চিত হয় ইতালির শিরোপা। পরপর দুই আসরে বিশ্বকাপ জিতে নেয় স্বাগতিক দল। আজও বিশ্বকাপ ইতিহাসের এক লজ্জাজনক অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয় ১৯৩৪ বিশ্বকাপকে।