শেষবেলায় শৈশবের ক্লাবে ফিরেছেন যে খেলোয়াড়েরা
ইউরোপিয়ান দলবদলের বিদায় ঘণ্টা তত দিনে বেজে গিয়েছে। বড় দলগুলো নিজেদের স্কোয়াড সাজিয়ে ফেলেছে। এর মধ্যে একজন ছিলেন সর্বজয়ী অধিনায়ক সার্জিও রামোস। পিএসজি ছাড়ার পরে বেশ কয়েকটি দল প্রস্তাব দিলেও কোথাও যোগ দেননি তিনি। শেষ পর্যন্ত ফেরত এসেছেন নিজের প্রথম দল সেভিয়াতে। ১৮ বছর পর এই ফিরে আসা শুধু রামোসকে নয়, আবেগতাড়িত করেছে কোটি ফুটবল–ভক্তদের। বিশ্বজয় করে ক্যারিয়ারের শেষ দিকে নিজের ঘরে ফেরা তারকাদের নিয়েই আজকের লেখা।
জিয়ানলুইজি বুফন—পার্মা
ক্যারিয়ারজুড়ে তাঁর কাজ ছিল গোল থামানো। গোল থামাতে এতটাই পটু ছিলেন যে বিশ্বের সেরা গোলকিপারদের তালিকা করলে বুফনের নামটা উচ্চারিত হবে ওপরের দিকে। অথচ তাঁর ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল গোল থামানো দিয়ে নয়, বরং গোল করার কাজে। ইতালির ক্লাব পার্মাতে বুফনের অভিষেক হয়েছিল একজন স্ট্রাইকার হিসেবে। কিন্তু হঠাৎই ম্যাচের মাঝে চোটে পড়েন দলের গোলরক্ষক। কোচের হাতে কোনো বদলিও নেই। বাধ্য হয়ে বুফনকে নামিয়ে দেন গ্লাভস হাতে। ভাগ্যিস নামিয়েছিলেন, নইলে এমন দিন কি দেখা যেত?
১৯৯৫ সালে পার্মার জার্সিতে অভিষেক হয় বুফনের। ছয় মৌসুম সেখানে খেলে তৎকালীন গোলকিপারদের জন্য রেকর্ড ফি ভেঙে তাঁকে কিনে নেয় জুভেন্টাস। সেখানে থেকেই বিশ্বজয় করেন তিনি। এক চ্যাম্পিয়নস লিগ বাদে সবকিছুই আছে তাঁর ঝুলিতে। ২১ বছর নিজের ঘর থেকে দূরে থাকার পর অবশেষে ২০২২-২৩ মৌসুমে আবারও পার্মায় ফেরেন। সেখানেই ইতি টানেন বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের।
ওয়েইন রুনি—এভারটন
রেড ডেভিলদের জার্সিতে এত বছর একসঙ্গে খেলেছেন যে ওয়েইন রুনিকে অনেকেই ইউনাইটেডের নিজেদের খেলোয়াড় ভাবেন। ব্যাপারটা কিন্তু তেমন নয়। ম্যানচেস্টারের জার্সিতে বিশ্বজয় করলেও রুনির শুরুটা হয়েছিল মার্সিসাইডে, ম্যানচেস্টারের জন্মজন্মান্তরের শত্রুরাজ্যে। ২০০২ সালে রুনির অভিষেক হয় এভারটনের জার্সিতে। ২ বছরে ৭৭ ম্যাচ খেলে স্যার অ্যালেক্সের নজরে আসেন তিনি। ২০০৪ সালে ইউনাইটেডে যোগ দেন রুনি। পরবর্তী ১৩ বছরে এমন কোনো শিরোপা নেই, যার ছোঁয়া পাননি তিনি। ইউনাইটেডের জার্সিতে হয়েছেন সর্বোচ্চ গোলদাতাও। অবশেষে ২০১৭ সালে ইউনাইটেড ছেড়ে আবারও এভারটনে ফেরত আসেন তিনি। যদিও এক মৌসুমই ছিলেন, তবে ঘরে ফেরার স্বাদ পেয়েছিলেন এই স্ট্রাইকার।
কার্লোস তেভেজ—বোকা জুনিয়র্স
আর্জেন্টাইন তারকা কার্লোস তেভেজের গল্পকে বলিউডের কোনো নামকরা রোমান্টিক সিনেমার সঙ্গে তুলনা করলেও ভুল হবে না। তেভেজের শুরুটা হয়েছিল আর্জেন্টিনার ক্লাব বোকা জুনিয়র্সের জার্সিতে। সেখান থেকে যান ব্রাজিলে, অতঃপর ইংল্যান্ড, ইতালি। ইউরোপে তাঁর শেষ মৌসুমেও তিনি ছিলেন ইউরোপের সেরা স্ট্রাইকারদের একজন। বড় বড় দল মুখিয়ে ছিল তাঁকে দলে ভেরানোর জন্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও ১১ বছর পর তেভেজ ফিরে আসেন নিজের ঘরে। মাত্র এক বছর থেকে আবারও পাড়ি দেন বিশ্বভ্রমণে। দুই বছর চাইনিজ লিগে কাটিয়ে ক্যারিয়ারের ইতি টানেন আবার সেই বোকা জুনিয়র্সেই।
আরিয়ান রোবেন—গ্রোনিজেন
ডাচ কিংবদন্তি রোবেনের প্রত্যাবর্তন বাকি সব খেলোয়াড়ের চেয়ে একটু আলাদাই ছিল। প্রত্যেকে যখন ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে নিজের ঘরে ফিরেছেন, রোবেন ফিরেছেন ক্যারিয়ার শেষ করে। শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি এটাই। রোবেনের ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল নেদারল্যান্ডসের ক্লাব গ্রোনিজেনের জার্সিতে। সেখানে দুই মৌসুম কাটিয়ে যোগ দেন পিএসভিতে। সেখান থেকে চেলসি, অতঃপর রিয়াল মাদ্রিদ ঘুরে শেষমেশ নিজের ঘর গড়ে তোলেন বায়ার্ন মিউনিখে। বাভারিয়ানদের সঙ্গে ১০ মৌসুম একটানা কাটিয়েছিলেন রোবেন। বায়ার্নের ঘরের ছেলে হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাই তো তাদের প্রস্তাব ফেলতে পারেননি রোবেন। ২০১৯ সালে বাভারিয়ানদের ঘর থেকেই ফুটবলকে বিদায় জানান রোবেন। তার এক বছর পরই পৃথিবীতে আঘাত হানে করোনা। করোনার প্রভাবে বিশ্বের যখন তথৈবচ অবস্থা, তখনই ফেরার ঘোষণা দেন রোবেন। অবসর থেকে ফিরে আসার ঘটনা নতুন কিছু নয়, কিন্তু রোবেনের ঘোষণার পেছনে কারণ ছিল নিজের ক্লাবকে বাঁচানো। করোনায় যখন নিজের শৈশবের ক্লাব দেউলিয়া হওয়ার পথে, তখন নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে ক্লাবকে রক্ষা করেন তিনি। এরপর এক মৌসুমের জন্য নাম লেখান সে দলে। কিন্তু চোটের কারণে মাত্র সাত ম্যাচে মাঠে নামার সৌভাগ্য হয়েছে তাঁর। মৌসুম শেষে দ্বিতীয়বারের মতো ফুটবলকে বিদায় জানান তিনি।
রবিন ভ্যান পার্সি—ফেইনুর্দ
এবারের গল্পটাও আরেক ডাচ কিংবদন্তির, যিনি পরিচিত ‘ফ্লাইং ডাচম্যান’ নামে। রবিন ভ্যান পার্সির শুরুটা হয়েছিল ফেইনুর্দের জার্সিতে। সেখানে তিন বছর খেলে যোগ দেন আর্সেনালে। সেখান থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ফেরেনবাচ ঘুরে আবারও ফিরে আসেন ফেইনুর্দে। শেষ বয়সে নিজেদের ক্লাবে ফিরে বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই থাকেন নিজের ছায়া হয়ে। কিন্তু ভ্যান পার্সি ছিলেন উজ্জ্বল। নিজের শেষ মৌসুমেও করেছেন ১৮ গোল। ২০১৯ সালে ফুটবলকে বিদায় বলেন ডাচ তারকা।
ফার্নান্দো তোরেস—অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ
“মাদ্রিদে আমি যে স্কুলে পড়তাম, সেই স্কুলে মোট ২৮ জন শিক্ষার্থী ছিল। যেদিন স্পোর্টস ডেতে সবাইকে জার্সি পরে যেতে বলল, আমি একা অ্যাথলেটিকোর জার্সি পরে গিয়েছিলাম। আর বাকি সবার ছিল রিয়ালের জার্সি।” মাদ্রিদের কোনায় কোনায় যখন রিয়ালের অগণিত সমর্থক, তার ভিড়ে ব্যতিক্রম ছিলেন ফার্নান্দো তোরেস। যে কারণে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই তাঁর হাতে উঠেছিল অধিনায়কের আর্মব্যান্ড। ক্যারিয়ারের প্রথম ৬ বছর ছিলেন অ্যাথলেটিকোতেই। অতঃপর বের হন বিশ্বভ্রমণে। লিভারপুল, চেলসি, এসি মিলানের পথ মারিয়ে শেষবেলায় আবারও ফিরে আসেন অ্যাথলেটিকোতে। তিন মৌসুম সেখানে কাটিয়ে ক্যারিয়ারের ইতি টানেন জাপানে। ক্যারিয়ারের ইতি টানতে না–টানতেই যোগ দিয়েছেন অ্যাথলেটিকোর কোচিং প্যানেলে। এখন অ্যাথলেটিকো অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচ তিনি।
সার্জিও রামোস—সেভিয়া
ছোট্ট এই তালিকার সর্বশেষ সংস্করণ স্প্যানিশ অধিনায়ক সার্জিও রামোস। রামোসের গল্পটা আরও বেশি রোমাঞ্চকর। সেই সঙ্গে অবাক করার মতো। শেষ বয়সে সবার লক্ষ্য যেখানে বেশি অর্থ কামানোর, সেখানে লোভনীয় প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন রামোস। বিশেষ করে এই সময়ে, যখন সবাই নিজেদের গন্তব্য হিসেবে বেছে নিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্র অথবা সৌদি আরব, সেখানে তাদের পাশ কাটিয়ে রামোস বেছে নিয়েছেন সেভিয়াকে। নিজের শৈশবের ক্লাব, যেখানে শুরু করেছিলেন ক্যারিয়ার, সেখানেই। সেভিয়া থেকে রামোসের গন্তব্য ছিল রিয়াল মাদ্রিদ। সেখানেই পূর্ণতা পেয়েছে ক্যারিয়ার। এমন কোনো শিরোপা নেই, যা ছুঁয়ে দেখা হয়নি তাঁর। অতঃপর যোগ দিয়েছিলেন পিএসজিতে, ধরে নিয়েছিলেন নতুন কোনো চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিজেকে আরেকবার প্রমাণ করবেন। তা হয়নি। পিএসজি ছেড়ে দিলেও নতুন কোনো ক্লাবের ডাকে সাড়া দিচ্ছিলেন না রামোস। সৌদি আরব, তুরস্ক, এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্র থেকেও এসেছিল ডাক। কিন্তু রামোস ফিরিয়ে দিয়েছেন। দলবদলের মৌসুম শেষে সেভিয়াতে যোগ দিয়েছেন তিনি। বছরে ২৫ মিলিয়ন ইউরোর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে স্বাক্ষর করেছেন ১ মিলিয়ন ইউরোর চুক্তিতে। বুড়ো হাড়ের ভেলকি কথাটা যে মিথ্যা নয়, তার প্রমাণ মিলেছে শেষ ছয় মাসেই। ৩৭ বছর বয়সেও সেভিয়ার ডিফেন্স লাইনের ভরসার পাত্র তিনি।