আমাকে ছোটবেলায় প্রথমে ওয়াইডব্লিউসিএ স্কুলে প্লে গ্রুপে ভর্তি করা হয়েছিল। তখন স্কুলে যেতে চাইতাম না আমি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও যখন যেতে হতো, চিত্কার করে কাঁদতাম। কোনো বন্ধুও ছিল না। এক সকালে ক্লাস শুরুর আগে পানি খেতে গিয়ে আমার প্রিয় পানির ফ্লাস্কটা হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল। আমি সাইরেন বাজিয়ে এত জোরে কাঁদতে লাগলাম যে সান্ত্বনা তো দূরের কথা, কানে আঙুল দিয়ে দৌড়ানো শুরু করল সবাই। কাঁদতে কাঁদতে হঠাত্ থেমে গেলাম। আমার দিকে ললিপপ এগিয়ে দিয়ে একটা অদ্ভুত ধরনের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। চুল কদিন ধরে সে আঁচড়ায়নি কে জানে। আমাকে বলল, ‘এই নে, ললিপপ মুখে দিয়ে কাঁদ।’ অদ্ভুত তো! আমাকে চেনে না। অথচ তুই তুই করে বলছে—আমি ভাবলাম একটু। তারপর ওর কথামতো ললিপপটা মুখে দিয়েই কাঁদতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না, ও বলল, ‘ওরে, তোকে থামানোর জন্যই এমনটা বললাম, তুই দেখি ভীষণ বোকা, ললিপপ মুখে দিয়ে কাঁদবি কী করে? আর কাঁদিস না। পরে চোখের পানির সাগর হয়ে যাবে। তখন সাঁতার কাটতে পারবি।’ আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। চোখের পানির সাগর হয়ে গেলে তো মুশকিল। ওর নাম জিজ্ঞেস করব, এমন সময় ক্লাসটিচার এলেন। তিনিই ডেকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ওকে, ‘বাচ্চারা ও হচ্ছে আলিফ। তোমাদের নতুন বন্ধু।’ ক্লাসের ছেলেমেয়েরা ওকে বিশেষ পছন্দ করল বলে মনে হলো না। পরদিন আমার পাশে জায়গা খালি দেখে আমিই বসতে বললাম ওকে। আস্তে আস্তে ও আমার খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেল। একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘হ্যাঁ রে, তুই এত আউলাঝাউলা থাকিস কেন? এ জন্যই তো কেউ তোকে পছন্দ করে না।’ ও বলল, ‘কী করব? আমার মা যে বাবাকে সারাক্ষণ দেখাশোনা করে।’ আমি বললাম, ‘সে তো সবাই করে।’ ও বলল, ‘বাবার কী যেন একটা হয়েছে। চলাফেরা করতে পারে না। হাত-পাও নাড়াতে পারে না। প্যালা প্যারা না কী যেন নাম।’ বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি, ওর বাবা প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাই ওর মা ওর দিকে তেমন খেয়াল করতে পারতেন না। সেদিন ওর কথা শুনে কষ্টও পেয়েছিলাম খুব। তাই সব সময় ওর ভালো বন্ধু হয়ে থাকার চেষ্টা করেছিলাম। ও খুব ভালো বন্ধু ছিল আমার। ক্লাস ওয়ান পর্যন্ত পড়েছিলাম আমরা একসঙ্গে। তারপর ভিকারুননিসায় চান্স পেলাম। যখন বললাম যে আমি চলে যাব, তখন ও কেঁদেই ফেলেছিল। আমার ফোন নম্বর মুখস্থ ছিল না। তাই ওরটা চাইলাম। ও লিখে দিল। ছুটির সময় ওকে টাটা দিয়ে চলে এলাম। অনেক কেঁদেছি সেদিন, অনেক। কিছুদিন পর ওর দেওয়া নম্বরটায় ডায়াল করলাম। কিন্তু ওপাশ থেকে বলত, এই নম্বর সঠিক নয়। নম্বর গুনে দেখলাম, ১১টার জায়গায় ১০টা ডিজিট। ও ভুল করে একটা ডিজিট লেখেনি। দু-একবার স্কুলে গিয়ে ম্যাডামদের জিজ্ঞেস করেছি ওর কথা। তাঁরা বলেন, ও স্কুল ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে জানেন না। মন খারাপ করে বাসায় চলে এলাম। তারপর কতগুলো বছর কেটে গেল। ওর কোনো খোঁজ পাইনি। ওটাই ছিল শেষ দেখা। এখনো খুব মনে পড়ে আমার প্রথম বন্ধুর কথা। আলিফ, তোকে অনেক মিস করি রে।’
লেখক : পঞ্চম শ্রেণি, ভিকারুননিসা নূন স্কুল, ঢাকা