করিডরে কে

প্রায় ছয় বছর হলো আমি এই স্কুলে পড়ালেখা করছি। খুব সুন্দর আমার স্কুল, আশপাশে ঘন পাহাড়, পাহাড়ে সবুজ বৃক্ষরাজি, তাতে নানা রঙের ফুল, ফুলে ফুলে পাখি আর মধুর খোঁজে ভ্রমর। তবে এই সুন্দর জায়গা নিয়ে আমার জীবনে দুঃস্বপ্নময় একটি স্মৃতি রয়েছে।

আমার স্কুলের পুরোনো ভবনটি পাঁচতলা। চারতলা পর্যন্ত ক্লাস হয়, পাঁচতলায় সাধারণত ক্লাস হয় না। শুধু পরীক্ষার সময় ক্লাসরুমগুলো খোলা হয়। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগত আমার কাছে। প্রথম যখন স্কুলে ভর্তি হই, তখন আমার বান্ধবীরা নানা রকম ভূতের গল্প বলত পাঁচতলার করিডরটা নিয়ে। আমি অবশ্য খুব একটা পাত্তা দিতাম না। তবে আমার বেশ ভয় লাগত। আবার অবাকও লাগত যে চারতলা পর্যন্ত এত হইহুল্লোড়, পাঁচতলা নীরব আর সুনসান। অলসতার কারণে ওদিকে খুব একটা পা মাড়াতাম না আমি (তবে বান্ধবীদের সঙ্গে লোভে পড়ে যেতাম মাঝেমধ্যে) এখন আর সেদিকে যাই–ই না।

ক্লাস সিক্সে ক্লাস পার্টির সময় আমি ও আমার কিছু বন্ধু ক্লাস সাজানোর দায়িত্ব পেয়েছিলাম। এটা নিয়ে খুশি আর উৎসাহের শেষ ছিল না আমার। ক্লাসে গিয়ে বেশ হইহই করে কাজে লেগে পড়লাম। বেশ কিছুক্ষণ পর কিছুটা দুর্বল বোধ করলাম। ভাবলাম তিনতলার ওয়াশরুমে গিয়ে হাত–মুখ ধুয়ে আসি। আমাদের স্কুলে মেয়েদের এই ওয়াশরুমে মাঝেমধ্যে পানি থাকে না। তখন চারতলার ওয়াশরুমটায় যেতে হয়। আমি মনে মনে দোয়া করলাম, যেন আজ অন্তত পানি থাকে। আমি অতটুকু কষ্টও করতে চাইনি, আর তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল, পুরো স্কুল প্রায় খালি। আমি পাঁচতলার কাছাকাছিও যেতে চাচ্ছিলাম না। তবে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। ঠিক ঠিক সেখানে পানি ছিল না। বেশি দুর্বল লাগায় বাধ্য হয়ে চারতলায় উঠলাম। চারতলার ওয়াশরুমটা পাঁচতলায় ওঠার সিঁড়ির পাশেই, আমার গা ছমছম করে উঠল। যখন আমি ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নিচ্ছিলাম, হঠাৎ শুনি, ওয়াশরুমে কে যেন একবার ঢুকে দৌড়ে বের হয়ে গেল। মুখে পানি থাকায় খেয়াল করিনি। শুনলাম, আমার বান্ধবী দুইবার চেঁচিয়ে ডাকল আমাকে। বলল, ‘কী রে ফারনাজ, তাড়াতাড়ি আয়। চল একটু পাঁচতলায় গিয়ে ঘুরে আসি।’ তৃতীয়বার ডাকার সময় আমি সাড়া দিয়ে বেরিয়ে এলাম। দেখলাম, আমাকে রেখেই পাঁচতলায় উঠে গেছে ওরা। আমি উঠতে চাইলাম না, ভয় লাগল। তবে কিসের আকর্ষণ যেন আমাকে টেনে নিয়ে গেল। এটি ছিল আমার জীবনের অন্যতম ভুল সিদ্ধান্ত।

আরও পড়ুন

পাঁচতলায় উঠে দেখি, সেখানে মানুষ তো দূর, একটা কাকপক্ষীও নেই, আমার মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল, এ কার ডাক শুনলাম আমি!

হঠাৎ দেখি, করিডরের একদম কোনার ক্লাসরুমের সামনে কে যেন নিচে বসে হাঁটুর ওপর মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

একটি কালো ছায়া!

হঠাৎ দেখি ছায়াটি আমার সামনে উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। আর আমি জায়গায় স্থির হয়ে গেছি। একচুলও নড়তে পারছিলাম না। হঠাৎ দেখলাম, ছায়াটা অদ্ভুত একধরনের চিৎকার দিয়ে বারান্দা থেকে লাফ দিল। ভেতর থেকে কেঁপে উঠলাম আমি। দেখি, আমার চারপাশের সবকিছু ঝাপসা হয়ে উঠল। ব্যস, আমার আর কিছু মনে নেই।

চোখ খুলে দেখলাম, আমার মা ও বান্ধবীরা আমার চারপাশ ঘিরে বসে আছে, আর আমি করিডরেই পড়ে আছি। মাথাটা ঝিমঝিম করছিল।

বাসায় যাওয়ার পর আমার এক সপ্তাহ টানা জ্বর ছিল। তাই ক্লাস পার্টিটা মিস করেছিলাম। কে ছিল সেই ছায়া?

লেখক: শিক্ষার্থী, অষ্টম শ্রেণি, ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল ও কলেজ, চট্টগ্রাম

আরও পড়ুন