গল্পটা মূলত আমার নিজের। তখন আমি মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। প্রতিটি পরীক্ষায় আমার মা আমাকে আনা-নেওয়া করতেন। রোজ রিকশায় আসা–যাওয়া করতাম আমরা। আমি মানুষটা চুপচাপ। চুপচাপ বললে যদিও ভুল হবে, কারণ ঘরে আমি যথেষ্ট দুষ্টু। একবার কথা বলা শুরু করলে সহজে থামতে চাই না। মূলত, ঘরের বাইরে আমি চুপচাপ, মুখ বন্ধ করে থাকি। কারণ, আমি লাজুক প্রকৃতির। তবে আমার বান্ধবীদের দেখলে আমি একেবারেই বদলে যাই। এই স্বভাব যদিও ইদানীং হয়েছে। আগে আমার তেমন বন্ধুবান্ধব ছিল না। তাই কথা বলা আর হাসাহাসি করা বহু দূরের কথা। আমি বরাবরই আমার মা, বোন আর আমার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে অনেক সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলি। সুতরাং রিকশা দিয়ে আসা–যাওয়া করার সময়ও আমি আমার মায়ের সঙ্গে ভালোই গল্প করতে করতে সময় কাটাতাম। পরীক্ষা কেমন হয়েছে, কীভাবে কী লিখেছি, প্রশ্ন সহজ হয়েছে কি না—এসব থেকে শুরু করে নানা রকম কথাবার্তা বলতেই থাকতাম। আসল কথা হলো, আমি অনেকটা আমার বাবার মতো হয়েছি। যদিও সে বিষয়ে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই। তবে আমার ধারণা, আমার বাবাও হয়তো ছোটবেলায় আমার মতোই ছিলেন। আমি আমার বাবাকে অনেক ভয় পাই। তাঁকে দেখলেই আমার মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বের হয় না। তিনিও আমার মতোই চুপচাপ থাকেন। বলা যায়, আমার চেয়ে বেশি। কখনো কোনো ব্যাপারে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখান না। তাঁকে কখনো বিস্মিত হতেও দেখিনি। আমার মা-বাবা দুজনই চাকরিজীবী। তাই বেশি দিন আমার মা কর্মস্থল থেকে ছুটি নেননি। শেষের দিকে ব্যবহারিক পরীক্ষাগুলোয় মা আমার সঙ্গে বাবাকে পাঠালেন। যথারীতি আমি আর বাবা রিকশায় আসা–যাওয়া করতাম। পরীক্ষা শেষে বাবা আমাকে শুধু জিজ্ঞেস করতেন, পরীক্ষা কেমন হয়েছে? ব্যস, এতটুকুই। তবে সেই সব দিন ছিল একেবারেই ভিন্ন। কারও মুখে কোনো কথা নেই। যেন দুজনই বাক্শক্তিহীন দুটো মানুষ। আমি জানি, বাবা যতই নির্বাক হয়ে থাকুন, যতই রেগে থাকুন না কেন, তাঁর মধ্যেও ভালোবাসা ও আবেগ আছে। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল আমি বাবাকে ফোনে জানিয়েছিলাম। যখন তিনি শুনলেন যে আমি জিপিএ ফাইভ পেয়েছি, তখন বাবার চোখ থেকে আনন্দের অশ্রু ঝরছিল। আমি কোনো দিন কল্পনাও করিনি যে পাথরের মতো শক্ত বাবা নামক মানুষটার চোখেও কখনো জল আসতে পারে। তবে আমার বাবা কথা কম বললেও তিনি ধৈর্যশীল ও ন্যায়পরায়ণ মানুষ। আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা।
নুজহাত তাবাসসুম
দ্বাদশ শ্রেণি, শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজ, ঢাকা