পানি ছাড়া প্রাণী কত দিন বাঁচতে পারে

পানি ছাড়া সবচেয়ে বেশি দিন বাঁচে থর্নি ডেভিল নামে একটা প্রাণী। দেখতে অনেকটা টিকটিকির মতো। এদের অস্ট্রেলিয়ায় দেখা যায়। সারা শরীরে অসংখ্য কাঁটা। সামান্য এই পানি ব্যবহার করে এরা ২০ বছর বেঁচে থাকতে পারে অনায়াসে।

থর্নি ডেভিলছবি: দ্য গার্ডিয়ান

পৃথিবীর সব প্রাণী পানিনির্ভর। পানি ছাড়া কোনো প্রাণী বেঁচে থাকে না। তবে প্রাণীভেদে পানির প্রয়োজনীয়তা ভিন্ন ভিন্ন। মানুষের জন্য যেমন ‘রুল অব থ্রি’ প্রযোজ্য। অর্থাৎ, মানুষ অক্সিজেন ছাড়া ৩ মিনিট, পানি ছাড়া ৩ দিন এবং খাবার ছাড়া ৩ সপ্তাহ বাঁচতে পারে। তবে সব প্রাণীর ক্ষেত্রে আবার এই নিয়ম খাটে না। প্রকৃতিতে অনেক অসাধারণ প্রাণী আছে, যারা পানি বা খাবার না খেয়েও বছরের পর বছর বাঁচতে পারে। সে রকম কিছু প্রাণী নিয়েই আজকের আলোচনা।

পানি ছাড়া কোন প্রাণী বেশি দিন বাঁচতে পারে, এমন প্রশ্নের উত্তরে সবার প্রথমে মাথায় আসে উটের কথা। পানি ছাড়া মরুভূমিতে উটের বেঁচে থাকার কথা কমবেশি সবাই জানো। কিন্তু পানি ছাড়া সবচেয়ে বেশি দিন বাঁচতে পারে এমন প্রাণীর তালিকা করলে উটকে শেষের দিকেই রাখতে হবে। উট ১৫ দিন পানি ছাড়া বাঁচতে পারে। তবে এদের নিয়ে একটা প্রচলিত মিথও আছে। সেটা হলো, উট নিজের গলার কাছে অনেক পানি সংগ্রহ করে রাখে। তৃষ্ণা পেলেই সেখান থেকে পানি পান করে। এ নিয়ে আছে রূপকথাও। মরুভূমির বেদুইনরা তৃষ্ণা পেলে সন্তানতুল্য উটের গলা কেটে পানি পান করতেও দ্বিধা করে না। সম্ভবত এমন রূপকথা থেকে মিথটি চালু হয়েছে। তবে এটা আসলে ভুল। বরং উট পিঠের কুঁজে চর্বি সঞ্চয় করে। পর্যাপ্ত খাবার খাওয়ার পরে অতিরিক্ত খাবার চর্বি আকারে কুঁজে জমিয়ে রাখে। একটা উট প্রায় ৩০-৪০ কেজি চর্বি জমাতে পারে। প্রয়োজনের সে চর্বি গলিয়ে পানি ও খাবারের অভাব পূরণ করে। আর এভাবে উট পানি ছাড়াও ১৫ দিন বাঁচতে পারে।

আরও পড়ুন

পানি ছাড়া উটের চেয়ে বেশি দিন বাঁচে জিরাফ। এরা প্রচুর গাছপালা খায়। বিশেষ করে বাবলাগাছের পাতা জিরাফের খুব প্রিয়। এসব গাছ, লতা-পাতা খাওয়ার কারণে পানির চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। জিরাফের দেহও বিশাল। একসঙ্গে এরা প্রায় ৫৪ লিটার পানি পান করে। সঙ্গে গাছপালার পাতার মাধ্যমে কিছু পানির অভাব পূরণ হয়ে যায়। এভাবে জিরাফ পানি ছাড়া ২১ দিন বাঁচতে পারে।

মরুভূমির কচ্ছপ আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে। এরা পানি ছাড়া প্রায় ১ বছর বাঁচে। মরুভূমির কচ্ছপের শক্ত শেলের নিচে একটা মূত্রাশয় থাকে। কচ্ছপের শরীরের ওজনের প্রায় ৪০ শতাংশ পানি এখানে জমা রাখতে পারে। এই পরিমাণ পানি কচ্ছপের এক বছর বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট। তবে কোনো কারণে কচ্ছপ ভয় পেলে পানি ছাড়া ১ বছর বাঁচতে পারবে না। কারণ, ভয় পেলে জমানো পানি সব মূত্র আকারে বেরিয়ে যায়।

জেরবোয়া পানি না খেয়ে তিন বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে
ছবি : রেপটাইলস ফর অল

পূর্ব ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা ও এশিয়ায় একধরনের ইঁদুরজাতীয় প্রাণী দেখা যায়। নাম জেরবোয়া। এরা পানি না খেয়ে তিন বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। এদের কান অনেক বড় হওয়ায় সামান্য কোনো শব্দ হলেও টের পায়। ফলে এই প্রজাতির ইঁদুর শিকার করা বেশ কঠিন শিকারির জন্য। এরা গাছপালা এবং পোকামাকড় খায়। সেখান থেকে পানি পায়। এভাবে সরাসরি তরল পানি পান না করেও জেরবোয়া তিন বছর বেঁচে থাকে।

আরও পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ায় ওয়াটার হোল্ডিং ফ্রগ নামে এক প্রজাতির ব্যাঙ দেখা যায়। এরা শুষ্ক পরিবেশে বাস করে। তবে গর্ত করে সেখানে থাকে। তা না হলে রোদে অতিরিক্ত পানি প্রয়োজন হয়। গর্তের মধ্যে লুকিয়ে থেকে টানা পাঁচ বছর পানি ছাড়া বাঁচতে পারে এ ব্যাঙ। অবশ্য গর্তে থেকে ক্ষুধা পেলে নিজের ত্বক খায়।

উত্তর আমেরিকার মরুভূমিতে ছোট প্রজাতির ইঁদুর দেখা যায়। নাম ক্যাঙ্গারু ইঁদুর। তবে নাম এমন হলেও ক্যাঙ্গারুর সঙ্গে এদের কোনো মিল নেই এবং অস্ট্রেলিয়ায়ও পাওয়া যায় না। স্থানীয় এই ছোট্ট ইঁদুরটি পানি ছাড়া বাঁচতে পারে পাঁচ বছর। এরা কিডনির এক পাশে যতটা সম্ভব পানি সংগ্রহ করে রাখতে পারে। খুব বেশি ঘামে না এ ইঁদুর। তাই শরীরে পানিও লাগে কম।

পশ্চিম আফ্রিকার লাংফিশও পানি ছাড়া ৫ বছর বেঁচে থাকে
ছবি: সংগৃহীত

পশ্চিম আফ্রিকার লাংফিশও পানি ছাড়া ৫ বছর বেঁচে থাকে। এরা প্রায় ৪০ কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে টিকে আছে। পানির নিচে শ্বাস নেওয়ার জন্য এ মাছের রয়েছে ফুলকা। অবশ্য এরা বাতাস থেকেও অক্সিজেন সংগ্রহ করতে পারে। কম পানিতেও বেঁচে থাকতে কোনো অসুবিধা হয় না লাংফিশের। রোদ দেখা দিলে কাদার মধ্যে ডুবে থাকে। পুষ্টির জন্য অস্ট্রেলিয়ার ওয়াটার হোল্ডিং ফ্রগের মতো নিজের ত্বক খায়।

আরও পড়ুন

হরিণ ও জিরাফের সঙ্গে মিল থাকা একটা প্রাণি আছে, নাম জেরেনুক। এই প্রাণীটি দেখলে মনে হতে পারে ফটোশপের সাহায্যে হরিণের দেহে জিরাফের মাথা লাগানো হয়েছে। কিন্তু আসলেই জেরনুকের গলা অনেক লম্বা। অদ্ভুতাকার এই প্রাণীটি দেখা যায় পূর্ব আফ্রিকার মরুভূমিতে। এরা পানি না খেয়েও আট বছর বাঁচতে পারে।

স্কাউচস স্পেডফুট টোড কলোরাডো মরুভূমিতে বাস করে
ছবি: আইন্যাচারালিস্ট

স্কাউচস স্পেডফুট টোড নামে কলোরাডোতে কিম্ভুতাকৃতির এক ব্যাঙ দেখা যায়। এরা কলোরাডো মরুভূমিতে বাস করে। অত্যন্ত দ্রুত এদের বংশ বৃদ্ধি হয়। দুই দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। ১০ দিনের মধ্যে বাচ্চাগুলো হাঁটতে শেখে এবং ৩ মাসের মধ্যে সেসব বাচ্চা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে আবার বাচ্চা দেয়। শুষ্ক মৌসুমে এরা বালিতে গর্ত খুঁড়ে তুলনামূলক ভেজা বালিতে বাস করে। এভাবে এই ব্যাঙ পানি ছাড়াই বাঁচতে পারে টানা ১০ বছর।

আরও পড়ুন

অ্যারাবিয়ান স্যান্ড গ্যাজেলও দেখতে অনেকটা হরিণের মতো। হরিণ থেকে এদের আলাদা করা কঠিন। আরব উপদ্বীপ এবং এর আশপাশের অঞ্চলে এই হরিণ প্রজাতির গ্যাজেল দেখা যায়। এরা হার্ট ও লিভার ৩০ ভাগ সংকুচিত করে মরুভূমির তীব্র উত্তাপ থেকে বেঁচে থাকে। যেহেতু হার্ট সংকুচিত করে রাখে, তাই শ্বাস নেয় ধীরে ধীরে এবং শরীরে পানি লাগে কম। এভাবে এই গ্যাজেল ১৫ বছর পানি ছাড়া বাঁচে।

চিতা পানি ছাড়া প্রায় ১০ দিন বাঁচে। হাতি বাঁচে প্রায় চার দিন। বিড়াল ও কুকুর পানি ছাড়া দুই বা তিন দিন বাঁচতে পারে। তবে মুরগি বাঁচতে পারে মাত্র ৮-২৪ ঘণ্টা। মানে মুরগি এক দিনের বেশি পানি ছাড়া বাঁচতে পারে না।

তবে পানি ছাড়া সবচেয়ে বেশি দিন বাঁচে থর্নি ডেভিল নামে একটা প্রাণী। দেখতে অনেকটা টিকটিকির মতো। এদের অস্ট্রেলিয়ায় দেখা যায়। সারা শরীরে অসংখ্য কাঁটা। দেখতে ভয়ঙ্কর বলেই নাম রাখা হয়েছে থর্নি ডেভিল। মাত্র ২১ সেন্টিমিটার লম্বা এই প্রাণীটির প্রিয় খাবার পিঁপড়া। এদের মুখ পিঁপড়া খাওয়ার জন্য এমনভাবে অভিযোজিত হয়েছে যে পানি পান করতে পারে না। বরং শিশিরের ফোটা জমে জমে এদের গায়ে পড়ে এবং শরীর সে পানি শোষণ করে। এভাবে সামান্য এই পানি ব্যবহার করে এরা ২০ বছর বেঁচে থাকতে পারে অনায়াসে।

আরও পড়ুন
অ্যারাবিয়ান স্যান্ড গ্যাজেলও দেখতে অনেকটা হরিণের মতো।
ছবি: উইকিপিডিয়া

এতক্ষণ যে প্রাণীগুলোর কথা বললাম, সেগুলো বেশিরভাগই তোমাদের কাছে অপরিচিত। তাই পরিচিত কিছু প্রাণী কত দিন পানি ছাড়া বাঁচতে পারে, তা জানিয়ে দিই।

চিতা পানি ছাড়া প্রায় ১০ দিন বাঁচে। হাতি বাঁচে প্রায় চার দিন। বিড়াল ও কুকুর পানি ছাড়া দুই বা তিন দিন বাঁচতে পারে। তবে মুরগি বাঁচতে পারে মাত্র ৮-২৪ ঘণ্টা। মানে মুরগি এক দিনের বেশি পানি ছাড়া বাঁচতে পারে না।

সূত্র: এ টু জেড অ্যানিমেল ডট কম, সেভর্ন ট্রেন্ট ওয়াটার ডট কম ও বিবিসি ওয়াইল্ড লাইফ ম্যাগাজিন

আরও পড়ুন