আমার বাবা
আমার প্রথম জন্মটা দিয়েছিল আমার মা। আর দ্বিতীয় জন্মটা দিয়েছে আমার বাবা! হ্যাঁ, আমি একবার মরে গিয়েছিলাম, হয়তো শারীরিকভাবে নয় কিন্তু মানসিকভাবে। ২০২২ সালের কথা। আমার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সময়। আব্বু অনেক সাপোর্টিভ ছিল আগে থেকেই। কিন্তু এই সময় তাকে আমি নতুনভাবে আবিষ্কার করি। আমি ভাবতে পারিনি, আমি এতটা ভাগ্যবান যে আমার বাবা আমাকে এতটা সাপোর্ট দেবে, আমার মায়ের মতো! বাবারা একটু রাগি আর অভিমানী হয় জানতাম, কিন্তু আমার বাবা খুব সাদামাটা, হাসিখুশি এক অসাধারণ ভালো মানুষ! আমার জীবনের সত্যিকারের আইডল! আব্বু আমাকে ফার্মগেট দিয়ে ফিরে আসার সময় খুব মন খারাপ করে বলে গিয়েছিল, ‘ভালো থেকো বাবা, সাবধানে থেকো। আব্বু তো আছেই।’ কিন্তু আমি ভালো থাকতে পারছিলাম না। একদিন তো ফোন দিয়ে বলেই বসলাম, ‘আব্বু, আমি এখানে পড়তে পারছি না, আমি ভালো নেই। আমাকে নিয়ে যাও।’
আমার কথা শুনে আব্বু আমাকে পরদিনই এসে নিয়ে গেল। বাড়ি ফিরে আমার জার্নি শুরু। লক্ষ্য অর্জনে অবিচল ছিলাম আমি। সেই রুমের কোনায় পড়ার টেবিল, আমার বই, আমার স্বপ্ন আর আমি। আব্বু যখন দুপুরে বাসায় খেতে আসত, দেখত আমি পড়ছি। যখন রাতে ঘুমাতে যেত, তখনো আমি পড়ছি। যখন তাহাজ্জুদ পড়তে উঠত, তখনো আমি পড়ছি। যখন ফজর পড়ে আসত, তখনো আমি পড়ছি। আব্বু আমার জন্য দুধের গ্লাস নিয়ে আসত। ‘খাব না’ বলে বাচ্চাদের মতো ভ্যা ভ্যা করতাম। দুধ আনবে বুঝতে পারলে দরজা লাগিয়ে বসে থাকতাম অনেক সময়। মাঝেমধ্যে শসা, পেয়ারা কেটে নিয়ে আসত আব্বু। আঙুর এনে রেখে দিত ফ্রিজের কোনায়।
চোখভর্তি স্বপ্ন আর মাথাভর্তি পড়ার প্রেশার! কিন্তু ভাগ্যটা আমার সহায় হলো না। ১৪ বছর ধরে খুব যত্নে লালিত স্বপ্নটা ভেঙে গেল। ভেঙে দিল আমাকেও! আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। মারাত্মক রকম অসুস্থ হয়ে গেলাম। অতঃপর হাসপাতাল! এরপর সেই অন্ধকার রুমের কোনার সেই বিছানায় আমার অসুস্থ শরীর, ভাঙা মন নিয়ে পড়ে থাকতাম। ঠিকমতো হাঁটতে বা চলতে পারতাম না। এভাবে কেটে গেল প্রায় চার মাস। বারবার মরে যেতাম আমি ভেতর থেকে। আব্বু তখন আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নিল। আমি চাইনি এত কষ্ট করার পরও প্রতি মাসে আমার মধ্যবিত্ত বাবার ওপর ১৫–১৬ হাজার টাকার বোঝা চাপিয়ে দিতে। আব্বু আমাকে কখনো কিছু বলেনি। নিজের কষ্টটা দেখেনি। চেয়েছে শুধু আমার ভালো থাকা। এরপর হলো আমার নতুন জন্ম। সেই ভাঙা অসুস্থ মেয়েটা আজ নতুন করে বেঁচে উঠেছে! শুধু আমার বাবার জন্য!
লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, নীলফামারী