কে ভেবেছিল, আমার দেহখান গানের কথাই সত্যি হবে
২০২৩ সালের আগস্ট মাসে কিআ পাঠকদের মাসিক সভা। কিশোর আলোর সভাকক্ষে উপস্থিত শত পাঠক ও স্বেচ্ছাসেবক। অন্যান্য সভার মতো এই সভায় এসেছিল একটি জনপ্রিয় ব্যান্ড। গান গেয়ে শুনিয়েছে ব্যান্ড অড সিগনেচার। কিশোর আলোর পাঠকদের মধ্যে তাদের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। তারা শুনিয়েছিল ‘তুমিও পারো’, ‘প্রস্তাব’, ‘ঘুম’-এর মতো দারুণ সব গান। সবাই গলা মেলানোয় সভাকক্ষ তখন মুখর। আর এমন সময়ই ওঠে ‘আমার দেহখান’-এর প্রসঙ্গ।
‘আমার দেহখান’ গানটির গীতিকার কি বেঁচে আছেন? শেষমেশ তাঁর কী পরিণতি হয়েছিল? ব্যান্ড ‘অড সিগনেচার’-এর কাছে জানতে চাইল এক পাঠক। উপস্থিত সবার মধ্যে তখন চাপা আগ্রহ। উত্তর জানতে উদ্গ্রীব সবাই। তাই যেন নেমে এল অদ্ভুত নীরবতা।
উত্তরের বদলে ব্যান্ডটির ভোকাল মুন্তাসির রাকিবের তরফ থেকে এল পাল্টা প্রশ্ন—
‘গানটি কে লিখেছে জানেন?’
‘মুন্তাসির রাকিব।’
‘আর আমার নাম?’
‘মুন্তাসি...’
‘ঠিক ধরেছেন। আমিই মুন্তাসির রাকিব। আমি কিন্তু বেঁচে আছি। অ্যালবামের বাকি গানগুলো মুক্তি পেলে পুরো গল্প স্পষ্ট হবে।’
জনপ্রিয় এই গানের ভোকাল আহাসান তানভীর পিয়াল। তিনিও উপস্থিত ছিলেন সেই সভায়। কিআড্ডায় গানটি গাওয়ার সময় আহাসান তানভীর পিয়ালের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছিল উপস্থিত সবাই। যেকোনো কনসার্টে যখন এই গান গেয়ে শোনাতেন পিয়াল, দর্শক–শ্রোতা তাঁর সঙ্গে গলা মেলাতেন। মনের মধ্যে অন্য রকম অনুভূতি কাজ করত। কে জানত, এই গানের কথা এত তাড়াতাড়ি সত্যি হবে? শেষ পর্যন্ত আমার দেহখান গানের কথাই সত্য হলো? এই গানে আছে,
‘আমার সব স্মৃতি ভুলো না তোমরা
যা ফেলে গেছি
দেহ পাশে কেউ কেঁদো না
গল্পগুলো রেখো অজানা
গানখানা থেকে খুঁজে নিও মোর সে গল্প…’
আজ অড সিগনেচার ব্যান্ডের ভক্ত ও কিশোর আলোর পাঠকদের শোকের দিন। সকালে অড সিগনেচার ব্যান্ডের ফেসবুক পেজ থেকে একটা পোস্ট দেওয়া হয়েছে দুর্ঘটনার খবর জানিয়ে। সেখানে লেখা, ‘সিলেট যাওয়ার পথে নরসিংদীর পাঁচদোনা ড্রিম হলিডে পার্কের সামনে অড সিগনেচারের গাড়ি মারাত্মক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়। এতে ব্যান্ডের সব সদস্য মারাত্মকভাবে আহত হন। চালক আবদুস সালাম আর ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য আহাসান তানভীর পিয়াল এ দুর্ঘটনায় নিহত হন। বাকিদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।’ মুহূর্তে দুর্ঘটনার খবর ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যান্ডের ভক্তরা স্তব্ধ হয়ে পড়েন এই সংবাদে।
প্রথম আলো নরসিংদী প্রতিনিধির পাঠানো খবর অনুযায়ী, ‘নরসিংদী সদর উপজেলার পাঁচদোনায় যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে অড সিগনেচারের ভোকাল আহাসান তানভীর পিয়াল (২৬) ও মাইক্রোবাসের চালক আবদুস সালাম (৪৩) নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনায় ব্যান্ড দলটির আরও তিন সদস্য আহত হয়েছেন। ১১ মে শনিবার ভোরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাঁচদোনার ড্রিম হলিডে পার্কের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। সিলেটের এমসি কলেজের একটি অনুষ্ঠানে গান গাইতে যাচ্ছিলেন তাঁরা। দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ব্যান্ডের সদস্য সাকিন (২৬), আকিব (২৬) ও অমিতাভ (২৭)। তাঁদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা মাইক্রোবাসটি সিলেটের দিকে যাচ্ছিল। অন্যদিকে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা হানিফ পরিবহনের যাত্রীবাহী বাস ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। ভোর পাঁচটার দিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাঁচদোনা এলাকার ড্রিম হলিডে পার্কের সামনে পৌঁছানোর পর গাড়ি দুটির মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ঘটনাস্থলেই নিহত হন মাইক্রোবাসের চালক আবদুস সালাম ও তাঁর পাশের আসনে বসা আহাসান তানভীর পিয়াল। স্থানীয় লোকজন মাইক্রোবাসের ভেতর থেকে আহত তিনজনকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে পাঠান। পরে খবর পেয়ে মাধবদী ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে দুমড়েমুচড়ে যাওয়া মাইক্রোবাস কেটে দুজনের লাশ উদ্ধার করেন। এর আগেই মাইক্রোবাসকে চাপা দিয়ে বাসটি পালিয়ে যায়।
মাধবদী ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন কর্মকর্তা খাইরুল আলম বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে দুজনের লাশ উদ্ধার করি। এর আগেই আহত তিনজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান স্থানীয় লোকজন। এর মধ্যে নিহত দুজনের লাশ ইটাখোলা হাইওয়ে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।’
ইটাখোলা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন বলেন, নিহত দুজনের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নরসিংদী সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হচ্ছে। তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। তাঁরা এলে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া হানিফ পরিবহনের ওই বাসটি ভুলতা এলাকা থেকে জব্দ করা হয়েছে। তবে এর চালক পলাতক।’
কিশোর আলোর পাঠক স্বেচ্ছাসেবকেরা ভালোবাসে অড সিগনেচারকে। কিশোর আলোর দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে মঞ্চ মাতিয়েছিল অড সিগনেচার। ‘আমার দেহখান’ গানের সুরে সুরে পর্দা নামে নগদ–কিআ কার্নিভ্যালের। সেদিন ছিল রোববার। সকাল থেকেই কিশোর-কিশোরীদের কোলাহলে মুখর হয়েছিল তেজগাঁওয়ের আলোকি কনভেনশন সেন্টার। দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের ইতি টানা হয়েছিল অড সিগনেচারের গান দিয়ে।
সবার শেষে মঞ্চে উঠেছিল অড সিগনেচার। কিশোর আলোর নিয়মিত পাঠকের কাছে অড সিগনেচার আগে থেকেই পরিচিত। আগস্ট মাসে কিআড্ডায় তাদেরকে কাছাকাছি পেয়েছিল তারা। কিআ কার্নিভ্যালের মূল মঞ্চে অড সিগনেচার নিজেদের জনপ্রিয় গানগুলো পরিবেশন করেছিল। কার্নিভ্যালে ‘তুমিও পারো’, ‘দুঃস্বপ্ন’, ‘ঘুম’, ‘প্রস্তাব’ ও ‘আমার দেহখান’ গানগুলো পরিবেশন করেন তাঁরা।
কিআ কার্নিভ্যালে অতিথি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন কিশোর আলোর লেখক ও স্বেচ্ছাসেবক সজিব-উজ-জামান। তিনি জানালেন, ‘কার্নিভ্যালে গানের সময় একদম মঞ্চের সামনে বসেছিলাম। পিয়াল ভাই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন একটা দারুন চশমা পরে। গান গাওয়ার সময় পিয়াল চশমা খুলে রেখেছিলেন। তখন আমি আর কিআর কার্টুনিস্ট মাহির ভাই চিৎকার করে বলেছিলাম, ভাই চশমাটা পরেন। চশমাটা কুল আছে। পিয়াল ভাই হেসে আবার চশমাটা পরে গিটার বাজিয়েছিলেন।’
কার্নিভ্যালে গান গাওয়ার সময় মঞ্চের খুব কাছাকাছি ছিলেন অড সিগনেচারের ভক্ত কিশোর আলোর স্বেচ্ছাসেবক রেজুওয়ানা ইসলাম। স্মৃতিচারণায় জানালেন, ‘আমি ছিলাম ব্যাকস্টেজের দায়িত্বে। অড সিগনেচার ব্যান্ডের সদস্যরা এলে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছিলাম আমি। কয়েক মাস আগেই কিআড্ডায় এসেছিল অড সিগনেচার। পিয়াল ভাই, রাকিব ভাইরা আমাকে দেখেই চিনতে পেরেছিলেন। বলেছিলেন, তোমাকে তো কিআড্ডায় দেখেছি। ওনারা যে আমাকে মনে রেখেছেন, এটা খুব ভালো লেগেছিল আমার। সেদিন কার্নিভ্যালে দারুণ গেয়েছিলেন পিয়াল ভাই। আমরাও গলা মিলিয়েছিলাম তাঁর সঙ্গে। গান শেষে কিআর পক্ষ থেকে তাঁদের হাতে উপহারও তুলে দিয়েছিলাম আমি। ভাইয়ারা বলেছিলেন, আবার দেখা হবে কিআড্ডায়। কিন্তু পিয়াল ভাইয়ের সঙ্গে আর কখনোই দেখা হবে না—এটা মানতে পারছি না।
কিশোর আলো বরাবরই অড সিগনেচারের সঙ্গে ছিল। শ্রীমঙ্গলে প্রথমবারের মতো কনসার্ট করতে গিয়েছিল অড সিগনেচার। গত বছর ২২ ডিসেম্বর শ্রীমঙ্গলের সংগীতপ্রেমীদের সামনে উপস্থিত হয়েছিল এই ব্যান্ড। এই আয়োজনে মিডিয়া পার্টনার ছিল কিশোর আলো।
কিশোর আলোর পক্ষ থেকে অড সিগনেচার ব্যান্ডের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা রইল। পিয়ালের মৃত্যুতে কিশোর আলো পরিবার গভীরভাবে শোকাহত। ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য আহাসান তানভীর পিয়ালের স্মৃতি আমাদের সবার মনে জেগে থাকবে। ব্যান্ডের বাকি সদস্যদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করছে কিশোর আলো পরিবার।