ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম অনেক কল্পনাপ্রবণ। যেমন ধরো, একদিন ডোরেমনের একটা পর্বে একটা গেজেট দেখলাম, যার সাহায্যে অদৃশ্য হওয়া যায়। তো আমার কাছে বিষয়টা খুবই মজার মনে হলো। সাড়ে তিন–চার বছর বয়সী আমি আমার নিজস্ব একটা অদৃশ্য জগৎ বানালাম। তখনো আমি স্কুলে ভর্তি হইনি, কিন্তু আমার ছোটাপ্পি–বড়াপ্পির স্কুলে যাওয়া দেখে অনেক ইচ্ছা ছিল আমিও স্কুলে যাব। তো, আমি বানালাম আমার নিজস্ব একটা অদৃশ্য স্কুল। সেখানে ছিল অদৃশ্য বন্ধুরা। আমার অদৃশ্য বেস্টফ্রেন্ডের নাম ছিল মিতা। একটা ব্যাগ ছিল আমার, আদর্শলিপি বই ছিল, সেগুলো নিয়ে অদৃশ্য স্কুলে (মানে ওই তো খাটের ওপরেই) যেতাম। আর যখন ছাদে গিয়ে ট্রাইসাইকেল চালানোর সময় কোনো সঙ্গী থাকত না, তখন কল্পনা করতাম আমার অদৃশ্য বেস্টফ্রেন্ড মিতা তার ট্রাইসাইকেল নিয়ে আমার পাশেই, আমার সঙ্গে খেলছে। তো এভাবেই ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম। ওইযে কল্পনা করার অভ্যাসটা, সেটা থেকে গেল। আমিও বড় হতে লাগলাম, আমার কল্পনাও আমার বয়স অনুযায়ী বড় হতে লাগল। পৃথিবীর অসম্ভব সব জিনিস আমার মনের মধ্যে সাজিয়ে, নিজের মতো কল্পনা করে তার স্বাদ নেওয়ার চেষ্টা আমার প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত হলো। মনের ইচ্ছাগুলোর সঙ্গে ‘যদি এমন হতো’ লাগিয়ে সেটাতে একটুখানি যুক্তি মিশিয়ে অনেক ধরনের ঘটনা সাজাই আমি, যা আমার জীবনে আসলে ঘটেনি। তবে ‘ঘটলে কী হবে’ তার স্বাদ কল্পনায় আমি পেয়ে যাই। ছয়-সাত বছর বয়স থেকে প্রথম আলোর ‘গোল্লাছুট’ ক্রোড়পত্রটি পড়ে লেখালেখির ইচ্ছা জাগে। আমার কল্পনাশক্তিটা কাজে লাগাই। সঙ্গে মনের মধ্যে থাকা নিজের লেখাকে কাগজপত্রে ছাপতে দেখার প্রবল আকাঙ্ক্ষাটা আমাকে অনেক উৎসাহ দেয়। এটা ঠিক যে আমার লেখা কোনো দিন ছাপানো হয়নি, তবে ছাপানোর আশায় প্রতিনিয়ত লেখা পাঠানোর মাধ্যমে আমার লেখালেখি করার অভ্যাসটির সূচনা ঘটে। ছোটবেলায় ছড়া লিখতাম একটি পাখি আর তার বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে, তারপর বড় হতে হতে লিখি প্রকৃতি নিয়ে, দেশ নিয়ে, জীবন নিয়ে। ছোটবেলায় যেসব হিজিবিজি দৃশ্য বানাতাম মাথার ভেতর, বড় হয়ে সেগুলোকেই একটু যুক্তি দিয়ে চিন্তা করে বিভিন্ন নামের চরিত্র বানিয়ে, গল্প লেখা শুরু করি। শুরু করি স্বপ্ন দেখা। এখন বাংলা বইয়ে যখন গদ্য-পদ্য পড়ি, লেখক পরিচিতি পড়ার সময় অনেক অনুপ্রাণিত হই। ভাবি, ‘আমিও কি হতে পারব তাঁদের মতো? আমাকেও কি পৃথিবী চিনবে আমার ভিন্ন কোনো চিন্তাধারার জন্য?
কোনো দিন কি আমার কল্পনা থেকে বেরিয়ে কাগজে-কলমে সাজানো সেই লেখাগুলো পড়ে অন্য মানুষ তার কল্পনার জগতে হারাবে? আমিও কি হতে পারব এমন কেউ, যার জীবনী পড়ে আজকের আমার মতো কোনো স্বপ্ন পোষণকারী কিশোর তার জীবনটাকে আমার মতো সাজাতে চাইবে? হতে পারব এমন কেউ, যার লেখা তার নিজের মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকবে? যার সর্বনাম লেখার সময় তাতে চন্দ্রবিন্দু দিতে হবে? যে স্মরণীয় থাকবে বইয়ের পাতায় চিরকাল?’ এই লেখক হওয়া নিয়ে কত স্বপ্ন, কত কল্পনা লুকোচুরি খেলে আমার মাথায়। কিশোর আলোতে বিভিন্ন গল্প পড়ি। মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন চিন্তায় হারিয়ে যাই। ভাবি, ‘আচ্ছা এই যে এই মানুষটা গল্পটা লিখেছে, গল্পটার মালিক সে। চরিত্রগুলোর স্রষ্টা সে। এই গল্পের ভেতরের যেই জগৎটা, এটা সম্পূর্ণ তার নিজের। এই জগৎটা ছিল তার মস্তিষ্কে, অথচ এখন তার সেই একান্ত নিজস্ব জগতের গল্পটা সবাই পড়ছে। তার সঙ্গে বেশির ভাগ পাঠকের কোনো সম্পর্ক নেই, তবে তার মস্তিষ্কে নির্মিত এই জগৎটা অনেকেরই প্রিয় হয়ে উঠেছে। আমিও কি তার মতো হতে পারব?
আমি কারও সঙ্গে ভালোমতো মিশতে পারি না, মনের কথা কোনো দিনই তেমন সুন্দর করে প্রকাশ করতে পারি না। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা, আমার মনে যে কথাগুলো, যে যুক্তিগুলো, যে গল্পগুলো, যে অনুভূতিগুলো বসবাস করে, তা একটা মানুষ জানবে, সবাইকে নিয়ে আমি হারাতে চাই আমার কল্পনার জগতে। তাই আমি আমার মনের কথাগুলো লিখি। আমি আমার কল্পনার জগতের দৃশ্যটা লেখায় ফুটিয়ে তুলি। আমার যা বলার আছে, সব আমার কলমটা বলে দেয়। আমি লিখি আমার নিজের কল্পনার বাস্তবায়নে, আর যখন কেউ তা পড়বে তখন সে আমার লেখাটাকে তার মনের জগৎ অনুযায়ী সাজিয়ে নিজের মতো কল্পনা করবে। এতে সে নিজেও সুন্দর একটা গল্প পড়ে তা কল্পনা করে তৃপ্তি পেয়ে আমার প্রতি ধন্য হবে, আর আমিও আমার নিজস্ব কল্পিত গল্পটি দিয়ে তাকে আনন্দ দিয়ে ধন্য হব। এটা হয়তো আমার আর আমার পাঠকের মধ্যে একটা টেলিপ্যাথির মতো কাজ করবে।
আমি বই পড়ি, কিআ পড়ি, তার মসৃণ পৃষ্ঠায় হাত বোলাই আর স্বপ্ন দেখি, কোনো দিন হয়তো এর অন্তত একটা পাতা আমার হবে। এ রকম সুন্দর করে টাইপ করে লিখে ছাপানো হবে আমার নিজস্ব কল্পনার জগতে তৈরি এক গল্প, যা হাজারো অপরিচিত মানুষ পড়বে আর আমাকে স্মরণ করবে। আমার নিজস্ব একটা পাতা। যেখানে লেখা থাকবে আমার নাম। হয়তো আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মানুষ আমার মনের কথাগুলো এ পাতায় পড়বে আর কখনো হাসবে, কখনো হয়তো তার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল পড়বে। আমার অজান্তেই হয়তো কখনো আমি হয়ে উঠব কোনো একজনের জীবনের সবচেয়ে বড় কোনো পরিবর্তনের কারণ।