একটা অনুষ্ঠান শুরু হবে সকাল নয়টায়। কতটা আগ্রহী হলে সকাল সাতটায় তুমি হাজির হবে ভেন্যুতে? ঘুম থেকে উঠে চোখেমুখে একটু পানি দিয়েই ছুট। চলে এলে সাতটায়। দেখলে, ছেলেমেয়েরা হাজির হয়ে গেছে তোমার আগেই।
এমন ঘটনাই ঘটেছে নগদ কিআ কার্নিভ্যাল ২০২৩-এ। শ্যামলী থেকে এসেছে দুই ভাই আরিয়ান ও সোহান। এসওএস হারম্যান মেইনার স্কুলে পড়ে ওরা। ঠিক সকাল সাতটায় চলে এসেছে কার্নিভ্যালের ভেন্যু তেজগাঁওয়ের আলোকি কনভেনশন সেন্টারে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণিপড়ুয়া দুই ভাইয়ের মুখে হাসি। জানাল, কিশোর আলোকে ভালোবাসে বলেই কার্নিভ্যালে এসেছে ওরা। প্রতি মাসে কিশোর আলো পড়ে তারা দুজন । মিস করতে চায় না কোনো আয়োজন। ওদের আগ্রহ দেখেই মনে হচ্ছিল, দারুণ কিছু অপেক্ষা করছে কার্নিভ্যালে।
কার্নিভ্যাল উদ্বোধনের আগেই শুরু হয়ে গেছে কিআ পাঠকদের আনাগোনা। সাজানো–গোছানো জায়গাটা ঘুরে দেখছে সবাই। ফটো বুথে গিয়ে তুলছে ছবি। ভোরেই চলে এসেছেন কিশোর আলো সম্পাদক আনিসুল হক। প্রিয় লেখককে কাছে পেয়ে কেউ ছবি তুলছে। কেউ নিচ্ছে অটোগ্রাফ।
সকাল ৯টায় সবার অপেক্ষা ফুরোল। শিল্পী বিজন চন্দ্র মিস্ত্রীর নেতৃত্বে মঞ্চে এল মণিকুন্তলা সংগীত বিদ্যায়তনের শিশুরা। মিলনায়তনের সবাই মিলে গাইল জাতীয় সংগীত। শুরু হয়ে গেল নগদ কিআ কার্নিভ্যাল ২০২৩। কিশোর আলোর দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এ আয়োজন। মণিকুন্তলা সংগীত বিদ্যায়তনের শিশুরা আরো গাইল দেশাত্মবোধক গান ‘সূর্যোদয়ে তুমি, সূর্যাস্তেও তুমি’। গান চলল আরো কিছুক্ষণ। সুরের সাম্পানে ভেসে ভেসেই এগিয়ে গেল অনুষ্ঠান। বিশ্বজোড়া যুদ্ধ আর অশান্তির অবসান প্রত্যাশায় সাদা পায়রা উড়িয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করলেন অতিথিরা।
পায়রা ওড়ানোর আগে মূল মঞ্চে এলেন কিআ সম্পাদক আনিসুল হক। দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের সফল ও গুণী ব্যক্তিদের স্বাগত জানালেন তিনি। শিশুকিশোরদের সামনে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বললেন গুণীজনেরা। দিলেন অনুপ্রেরণা। চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অভিনয়শিল্পী নুসরাত ইমরোজ তিশা, সাফজয়ী নারী ফুটবল দলের সদস্য মারিয়া ও সানজিদা, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার এবং আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন শুভেচ্ছা জানান সবাইকে।
একই সঙ্গে তিন জায়গায় চলেছে অনুষ্ঠান। মূল মঞ্চে ছিল প্রধান আয়োজন, কিআ কর্মশালা চলেছে দোতলার মিলনায়তনে, গ্রিন হাউজে ছিল কিআড্ডা। মঞ্চ থেকে নেমে ফারুকী ও তিশা গেলেন কিআ পাঠকদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। সেখানে দুই অতিথিকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে পাঠকেরা। ষষ্ঠ শ্রেণিপড়ুয়া সামিহা জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি অভিনেত্রী না হলে কী করতেন?’ উত্তরটা শুনে হয়তো অবাক হবে তুমি। তিশা হতে চেয়েছিলেন ডাক্তার! কিআড্ডা, কর্মশালা জর্জরিত হয়েছিল সামিহার প্রশ্নবাণে। একজন তো বলেই ফেলল, ‘সাহস আছে বটে মেয়েটার।’
ছোট থেকেই কিশোর আলো পড়ে সামিহা। এই প্রথম এসেছে কিশোর আলোর বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে। বড় বোনের হাত ধরে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলা থেকে ঢাকার আলোকিতে চলে এসেছে বাদশাগঞ্জ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী। সে কিন্তু লেখাপড়াতেও দারুণ। এ বছরের শুরু থেকে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে উপবৃত্তি পাচ্ছে। মূল মঞ্চে ‘নগদ গেম শো’ অনুষ্ঠানে প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে পুরস্কারও জিতে নিয়েছে সে। সারা দিন ঘুরে বেড়িয়েছে কিআড্ডা, কর্মশালা আর মূল মঞ্চে। সুযোগ বুঝে নিয়েছে বিখ্যাতদের অটোগ্রাফ।
কিআড্ডায় এসেছিলেন জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। মূল মঞ্চে খালি গলায় ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটির কিছু অংশ গেয়েই সোজা চলে এসেছেন পাঠকদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। কিআর পাঠকেরা একেকজন হয়ে উঠেছিল খুদে সাংবাদিক। কঠিন কঠিন প্রশ্ন করেছে চঞ্চল চৌধুরীকে। চলচ্চিত্র নিয়েও ছিল অনেক প্রশ্ন। একই সময় দোতলায় চলছিল কিআ কর্মশালা। সেখানে চলচ্চিত্র কর্মশালা পরিচালনা করেছেন হাওয়া সিনেমাখ্যাত মেজবাউর রহমান সুমন।
দ্বিতীয় তলায় সারা দিনই চলেছে কর্মশালা। আলোকচিত্র কর্মশালা নিয়েছেন নাসির আলী মামুন, কার্টুনিস্ট মেহেদী হক নিয়েছেন কার্টুন কর্মশালা, ভাষা নিয়ে কর্মশালা পরিচালনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তারিক মনজুর। লেখালেখি কর্মশালায় লেখক হবার উপায় বাতলে দিয়েছেন আনিসুল হক। কিশোর-কিশোরীদের মঞ্চে ডেকে শিখিয়েছেন কবিতার ছন্দের খুঁটিনাটি।
মঞ্চে এসে কেউ আবৃত্তি করছিল ‘দুই বিঘা জমি’র লাইন।
শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, ‘বুঝেছ উপেন, এ জমি লইব কিনে।’
আনিসুল হক বুঝিয়ে দিলেন, এটা ৬ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা।
আবার, আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে—
এটা লেখা হয়েছে ৪ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে।
এভাবে কবিতা ধরে ধরে কোনটা কোন ছন্দ তা বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন আনিসুল হক। যদিও তাঁর পরামর্শ—মাত্রা বুঝতে হবে না। ভালো কবিতা গোটা ত্রিশেক কবিতা মুখস্থ করে ফেললে ছন্দ আপনা–আপনিই তোমাদের লেখায় এসে যাবে।
নিচতলার চত্বর জমজমাট হয়ে ছিল কিআর স্টলে। সেখানে কেউ খেলছে বিশেষ লুডু, চাল দিলেই জিতে নেওয়া যায় পুরস্কার। পাশেই বিজ্ঞানচিন্তার স্টল। হরেক রকম খেলা খেলে, প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সেখানে পাওয়া যায় সেভয় আইসক্রিমের কুপন। সামনেই ছিল ক্যারিকেচার স্টল। কাগজ-কলম নিয়ে বসে ছিলেন কার্টুনিস্টরা। নিজের বিচিত্র ক্যারিকেচার আঁকিয়ে নিতে লম্বা লাইন ধরে অপেক্ষা করেছে সবাই। অডিটোরিয়ামের বাইরে ছিল আরও অনেকগুলো স্টল। ইস্পাহানির স্টল থেকে গিফট ব্যাগ পেয়েছে নিবন্ধন করে কার্নিভ্যালে আসা সবাই!
কার্নিভ্যালে ঘুরতে ঘুরতেই এক কিশোরের দেখা মিলল। ডায়েরি হাতে গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সে। মনে হলো, হয়তো কার্টুনিস্টরা তার অবয়ব এঁকে দেওয়ায় ছেলেটি আহ্লাদিত। কিন্তু ভুল ভাঙল অচিরেই। জানা গেল, তার নাম আল মামুন। দশম শ্রেণির এই শিক্ষার্থী চাঁদপুর থেকে এসেছে শুধু কার্নিভ্যালে অংশ নিতে। জানাল, পাঁচ বছরের ব্যবধানে তার মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান তৈরি হয়েছে। যে ছেলে আগে বই পড়াকে সময়ের অপচয় ছাড়া কিছু ভাবত না, তারই লক্ষ্য এখন লেখক হওয়া। এই বদলে যাওয়ার কৃতিত্ব সে দিল কিশোর আলোকে। পাশাপাশি প্রিয় ম্যাগাজিনের জন্মদিনের উৎসবে অংশ নেওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। ফলাফল, দূরত্ব পরোয়া না করে মামুন আজ আলোকিতে হাজির। কার্নিভ্যাল শেষে ধরবে বাড়ি ফেরার পথ। স্বপ্ন পূরণ হওয়ায় সে আনন্দিত। প্রিয় লেখকদের অটোগ্রাফ নিতে পারায় সেই আনন্দ এখন রূপ নিয়েছে গর্বে।
কার্নিভ্যাল চত্বরে দুই ভাই–বোনকে হেঁটে বেড়াতে দেখা গেল। ভাই জানালেন, কিশোর বয়সে তিনি কিআর পাঠক ছিলেন। কিশোর আলোর শুরুর দিকের কথা। ২০১৪, ’১৫ হবে। প্রতিষ্ঠবার্ষিকীর উৎসবে অংশ নিতেন আগ্রহ নিয়ে। এখন কিআর একনিষ্ঠ পাঠক ছোট বোন। ভাই আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন বোনের সঙ্গে কার্নিভ্যালে আসবেন বলে।
দুপুরের বিরতির পর ছিল আনন্দ আয়োজন। মূল মঞ্চে শুরু হয় জাদু ও গান। শুরুতেই বিটবক্সিংয়ে দর্শকদের মাতিয়ে তোলে বিটমসফিয়ার। বিটবক্সিংয়ের তালে তালে জনপ্রিয় গানগুলো পরিবেশন করে তারা। এরপরই জাদু দেখাতে মঞ্চে ওঠেন জাদুকর স্বপন দিনার। দর্শক থেকে উৎসুক কিশোরদের মঞ্চে ডেকে নিয়ে জাদু দেখান তিনি। এরপর মঞ্চে গান পরিবেশন করতে আসে আরেফিন ফয়সাল। কিশোর আলোর মাসিক আয়োজন কিআড্ডা আর বিভিন্ন আয়োজনে গান গেয়ে বেশ পরিচিতি পেয়েছে কিআর এই স্বেচ্ছাসেবক। এরপর গান শোনান মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারজয়ী শিল্পী আতিয়া আনিসা। আইয়ুব বাচ্চুর বিখ্যাত ‘সেই তুমি’ ও পরাণ সিনেমার ‘চল নিরালায়’সহ কয়েকটি গান গেয়ে শোনান তিনি। সংগীতশিল্পী এরফান মৃধা শিবলুর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে কিআ কার্নিভ্যালে উপস্থিত সবাই গেয়েছে ‘বকুল ফুল’, ‘সাদা সাদা কালা কালা’ ও কোক স্টুডিও বাংলার জনপ্রিয় গান ‘কথা কইয়ো না’।
সবার শেষে মঞ্চে ওঠে জনপ্রিয় ব্যান্ড অড সিগনেচার। কিশোর আলোর পাঠকদের জন্য অড সিগনেচার বেশ পরিচিত একটি নাম। গত আগস্ট মাসে কিআড্ডায় এসেছিল এই ব্যান্ডের সদস্যরা। কিআ কার্নিভ্যালের মূল মঞ্চে তাদের জনপ্রিয় গানগুলো পরিবেশন করে ব্যান্ডের সদস্যরা। ‘তুমিও পারবে’, ‘দুঃস্বপ্ন’, ‘ঘুম’, ‘প্রস্তাব’ ও ‘আমার দেহখান’ গানের সঙ্গে গলা মেলায় পুরো মিলনায়তন। সারা দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর কিআর স্বেচ্ছাসেবকেরাও ছুটে এসে যোগ দেয় অড সিগনেচারের সঙ্গে গান গাইতে। গলা ফাটিয়ে গান গেয়ে, ছবি তুলে বাড়ি ফেরার পথ ধরে সবাই।
সারা দিনের আয়োজন ছিল জমজমাট। আনন্দে ভেসেছে কিআপ্রেমীরা। কিশোর আলোর পাঠক, স্বেচ্ছাসেবক আর অভিভাবকদের স্মৃতিতে নিশ্চয়ই অনেকদিন থাকবে এই দিনটি।
আলোকচিত্র দল : আব্দুল ইলা, মাসানিউল হক, রিফাত হাসান, সাদমান ইয়াসির, সায়ীদা ইসলাম, হাবীবুল মোস্তফা ও সাফা জেরিন