তারপর আমি কী দেখেছিলাম
একঝাঁক নীল মাছি, বড় বড়। ভনভন করে উড়ছে। ছেলেটার হাঁ হয়ে থাকা মুখে কিলবিল করছে কয়েকটা মাছি। কিছু মাছি নির্ভয়ে ঢুকে যাচ্ছে তার মুখের ভেতর, ঘুরে বেরোচ্ছে, আবার আরেক কাফেলা ঢুকছে। এ দৃশ্য দেখে আমার গা শিউরে উঠল। বারো-তেরো বছরের একটা ছেলে রাস্তার পাশে পড়ে আছে, দোকানের সামনের ফাঁকা জায়গায়। তার শরীর নিথর, মুখ হাঁ করে পড়ে আছে। মাছিদের প্রতি তার কোনো বিরক্তি নেই, যেন পৃথিবী থেকে তার সব অনুভূতি মুছে গেছে।
মরা মানুষের মুখ এমন হাঁ হয়ে থাকতে পারে, আমি কখনো ভাবিনি। এটা আমার জীবনে প্রথম দেখা। বড় বড় নীল মাছি ঢুকছে আর বেরোচ্ছে সেই মুখের ভেতর। এভাবে পড়ে থাকা একটা প্রাণ কি এতটাই মূল্যহীন হতে পারে?
রাস্তায় খুব বেশি লোকজন নেই। দু-একটা রিকশা টুংটাং শব্দ করে দ্রুত চলে যাচ্ছে। আমি এদিক-ওদিক দেখে রাস্তা পেরোলাম, ছেলেটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সাহস করে খুব কাছে যেতে পারলাম না। ছোটবেলা থেকেই লাশের প্রতি আমার একটা ভয় কাজ করত। ছেলেটার চেহারা বিবর্ণ, চুলগুলো এলোমেলো, শরীর প্রায় উদোম। শরীরে শুধু একটা পুরোনো ময়লা প্যান্ট আটকানো।
মাদ্রাসায় হাজিরার সময় হয়ে আসছিল। অনুপস্থিত থাকলে বড় বিপদ। ভাবছিলাম, ছেলেটাকে এভাবে ফেলে চলে যাব, নাকি স্থানীয় কাউকে জানাব? হঠাৎ খেয়াল করলাম, ছেলেটার শুকনো পেটটা হালকা কাঁপছে।
ও বেঁচে আছে।
প্রথমে শিউরে উঠলেও সামলে নিলাম দ্রুত। কিন্তু ওকে সাহায্য করার মতো তেমন কিছু আমার কাছে ছিল না। সঙ্গে ছিল একটা সাদা ব্যাগ—এক সপ্তাহের জামাকাপড় আর তিনটা আপেল। মাদ্রাসায় বিকেলে খাওয়ার জন্য এনেছিলাম।
ব্যাগ থেকে ব্যবহৃত একটা সাদা গেঞ্জি বের করলাম। গেঞ্জির ভাঁজে আপেলগুলো পেঁচিয়ে নিলাম। একটু কাছে গিয়ে ছেলেটার বুকে গেঞ্জিটা রেখে আস্তে আস্তে ওকে নাড়া দিলাম। কয়েক সেকেন্ড পর ছেলেটা চোখ খুলল। আমি দ্রুত ওর ডান হাতে গেঞ্জিটা গুঁজে দিয়ে বললাম, এইডার মইধ্যে আপেল আছে। খাইয়া নিস।
তারপর আর কিছু না বলে হাঁটা ধরলাম। সময়মতো মাদ্রাসায় না পৌঁছালে বড় বিপদ হবে। কিছুটা দূরে গিয়ে একবার পেছনে তাকালাম। ছেলেটা অপ্রকৃতিস্থ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। যেন বুঝতেই পারছে না, এই কয়েক মিনিটে কী ঘটল।
আমি আর দাঁড়ালাম না। হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো, আজকের এই ঘটনা আমার ভেতরে কোথাও একটা গভীর দাগ কেটে গেল। হয়তো ছেলেটার চেয়ে বেশি বেদনা নিয়ে আমিই এগিয়ে চলেছি।