রেজবান স্যারের বিদায়

বাকি দিনগুলোর মতো ১৪ নভেম্বরও স্কুলে অ্যাসেম্বলি হলো। ঘটনাটা ঘটল সর্বশেষ ক্লাসে, অর্থাৎ ষষ্ঠ পিরিয়ডে। ওই পিরিয়ডে আমাদের বিজ্ঞান ক্লাস ছিল। বিজ্ঞান ম্যাডাম আসতে দেরি করছিলেন, আমরা স্বভাবতই চিল্লাচিল্লি করছিলাম। হঠাৎ রেজবান স্যার এসে উপস্থিত হলেন। আমরা খুবই হতাশ হলাম।

রেজবান স্যার পুরোনো আমলের মানুষ। স্কুলের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী তাঁকে ভয় পায়। স্যার ক্লাসে আসতেই সবাই চিল্লাচিল্লি বন্ধ করে সোজা হয়ে বসল। স্যার বললেন বিজ্ঞান বই দিতে, গতি অধ্যায় পড়াবেন। আমরা অবাক হইনি। নির্ধারিত স্যার বা ম্যাডামদের অনুপস্থিতিতে স্যার এর আগেও কয়েকবার ক্লাস নিতে এসেছিলেন। স্যার মার্কার নিয়ে গতির সমীকরণের অঙ্কগুলো করাতে শুরু করলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে বিজ্ঞান ম্যাডাম এলেন। আমরা খুশি হলাম। রেজবান স্যারের ক্লাস আর করতে হবে না। কিন্তু বিজ্ঞান ম্যাডাম রেজবান স্যারকে দেখেই সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলেন যেন স্যার তাঁকে না দেখেন। আমরা তখনো কিছুই বুঝতে পারিনি।

আরও পড়ুন

রেজবান স্যার ক্লাস নিলেন এবং বেল পড়ার ১০ থেকে ১৫ মিনিট আগে তিনি অঙ্ক করা শেষে গল্প শুরু করলেন। হঠাৎ আমার এক বান্ধবী স্যারকে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, আপনি রিটায়ার করবেন কবে?’ প্রশ্নটা ও করেছিল শুধু জানার জন্যই। জানুয়ারি থেকেই শুনছিলাম স্যার এ বছর রিটায়ার করবেন। ভেবেছিলাম স্যার রাগ করবেন এ প্রশ্ন শুনে। কিন্তু একটু হেসে তিনি বললেন, ‘অপেক্ষা করো, বলছি।’ তিনি বললেন, ‘আমার জন্ম ১৯৬৫ সালের ১৭ নভেম্বর। সরকারি চাকরি শেষ হয় ৫৯ বছর বয়সে এবং ১ দিন আগে। সেই হিসাবে ১৬ নভেম্বর। কিন্তু ১৬ তারিখ শনিবার, আর ১৫ তারিখ শুক্রবার। তাই আজ আমার শেষ দিন এবং আজ ঘণ্টা দেওয়ার পর থেকে আমার অবসর।’ আমরা বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে আজই স্যারের শেষ ক্লাস!

পুরো ক্লাসরুমই যেন শেষ পাঁচ মিনিটে হয়ে উঠল বিষাদময়। অনেকেরই চোখে পানি এসেছিল। আমরা বুঝতেও পারিনি যে স্যারকে আমরা এত ভালোবাসি। তিনি আরও বললেন, ‘তোমাদের আমি অনেকবার বলেছি যে কোনো ক্লাস না হলে আমাকে ডেকে নিয়ে আসবে। আমি এসে ক্লাস নেব। তোমরা তো আমাকে কোনো দিন গিয়ে ডেকে আনলে না।’ শুনে আমাদের অনেকের মনেই একটা অপরাধবোধের সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি কোনো কোচিংয়ের শিক্ষক নন, নিছক একজন সিনিয়র স্কুলশিক্ষক, তা–ও আমাদের ক্লাস প্রায় নেন না বললেই চলে, তাঁকেও আমাদের ক্লাসের অনেক শিক্ষার্থী ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে।

আরও পড়ুন

বিদায়ের দিনে চোখের কোণে জল তার জ্বলন্ত সাক্ষী। আমিও বহু কষ্টে স্কুলে কান্না আটকে রেখেছিলাম, কিন্তু বাড়ি ফিরে তা আর আটকাতে পারিনি। আজ ১৭ নভেম্বর। স্যারের ৫৯তম জন্মবার্ষিকীতে লেখাটি লিখছি। যদিও এটা ছাপা হবে ডিসেম্বর মাসের ৫ তারিখের পর, তবু স্যারের উদ্দেশে বলতে চাই, স্যার, আপনি ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং জীবনের বাকি সময়টা সুন্দরভাবে উপভোগ করুন—এই প্রত্যাশা করি।

লেখক: শিক্ষার্থী, নবম শ্রেণি, মিঠাপুকুর সরকারি মডেল উচ্চবিদ্যালয়, রংপুর

আরও পড়ুন