দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে সব সময় যে যুদ্ধ করতে হবে, বিষয়টা এমন না। যার যার জায়গা থেকে ঠিকভাবে দেশের জন্য প্রয়োজনীয় কাজটা করতে পারাই দেশপ্রেম। একঝাঁক স্বপ্নবাজ শিশু–কিশোরের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত কিশোর আলোর ৯০তম মাসিক সভা ‘কিআড্ডা’য় এমন কথাই শোনালেন নাট্যনির্মাতা, চলচ্চিত্রকার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। বিজয়ের মাসে কিআড্ডার আসরে এসেছিলেন তিনি, শুনিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প। অতিথি হিসেবে আরও ছিলেন আলোকচিত্রী প্রীত রেজা। ‘না’-কে ‘না’ বলার মন্ত্র শিখিয়ে অংশগ্রহণকারী কিআ পাঠকদের অনুপ্রাণিত করেন তিনি।
২৩ ডিসেম্বর, শনিবার ঠিক বেলা ৩টায় কিশোর আলোর সম্পাদক আনিসুল হক ৯০তম কিআড্ডার সূচনা করেন। শুরুতেই সভায় উপস্থিত কিশোর আলোর খুদে পাঠকেরা সম্পাদকের সঙ্গে মতবিনিময় করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কথা স্মরণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন আনিসুল হক।
‘না’ বলার হাতেখড়ি দিলেন প্রীত রেজা
ছোটবেলা থেকে ‘না’ শব্দটি শুনতে শুনতে অনেকেই বিরক্ত। কিন্তু আলোকচিত্রী প্রীত রেজার প্রিয় শব্দই ‘না’। শব্দটি তাঁর কাজের উদ্যম দ্বিগুণ করে দিতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ২০ টাকার বিনিময়ে ছবি তুলে দিতেন প্রীত রেজা। স্বপ্ন দেখতেন দেশ-বিদেশ ঘুরে কাজ করবেন, ছবি তুলবেন। এই স্বপ্ন শুনে তাঁর নিজের বন্ধুরাও ঠাট্টা করতেন। কারও কথায় দমে যাননি তিনি। পরিশ্রম করেছেন এবং নিজের স্বপ্নকে সত্যি করেছেন। তিনি সভায় উপস্থিত সবার উদ্দেশে বলেন, ‘স্বপ্ন সব সময় এমন দেখবে, যা শুনে অন্যরা হাসবে। বলবে, এ তো সম্ভব না! স্বপ্ন দেখার ওপর কোনো ট্যাক্স নেই। তাই বড় স্বপ্ন দেখলে কোনো ক্ষতি নেই।’ অন্যের বলা ‘তুমি পারবে না’ বাধাকে ‘না’ বলতে আহ্বান জানান প্রীত রেজা।
মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে নাসির উদ্দিন ইউসুফ
১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। সে বছর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। কিশোর আলোর পাঠকদের তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে সাধারণ মানুষ যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানত না। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে উন্নত অস্ত্রের মজুত ছিল। ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে নিরীহ বাঙালিদের ওপর হামলা করে তারা।
২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা আসার পর থেকেই নাসির উদ্দিন ইউসুফ যোগ দেন স্বাধীনতার লড়াইয়ে। মুক্তিযুদ্ধের একটি বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৪-১৫ বছর বয়সী একজন কিশোরের গল্প শোনান। যার নাম ছিল টিটু। রাজাকারদের হাতে নিজের ভাইয়ের মৃত্যু দেখার পর কিশোর টিটু প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে নাসির উদ্দিন ইউসুফের বাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় থাকতে শুরু করে টিটু। ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দুই দিন আগে রেডিওতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হচ্ছিল। সেই রেডিও বার্তা শুনে টিটু বাকিদের চোখ এড়িয়ে হাতে অস্ত্র নিয়ে পৌঁছে যায় সমরাঙ্গনে। টিটু যুদ্ধের জটিল নিয়ম বুঝত না। একটি খবর পৌঁছে দিতে গিয়ে জোরে কথা বলে ফেলে। টিটুর গলা শুনে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করতে দ্বিধা করেনি। আহত টিটুর আর্তনাদ শুনে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু টিটুর রক্তক্ষরণ বন্ধ করা যায়নি। মারা যাওয়ার আগে টিটু তার কমান্ডারকে বলে, ‘বাচ্চু ভাই, আমি কি স্বাধীনতা দেখব না?’ বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। টিটু স্বাধীন বাংলাদেশ দেখার আগেই মারা যায়। তার কবর এখন আছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে।
মুক্তিযুদ্ধের আরও কিছু গল্প শোনান তিনি। কিআড্ডায় উপস্থিত সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনেছে সেসব হৃদয়স্পর্শী গল্প। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ শেষে নিজের মায়ের বুকে ফিরতে পেরেছি, এই আমার সৌভাগ্য।’ প্রসঙ্গক্রমে তিনি জানান তাঁর থিয়েটার করার কথা। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়েও তাঁর একটি থিয়েটার আছে। নাম সুন্দরম থিয়েটার।
অতিথিদের কথা শুনে মন্ত্রমুগ্ধ ছিল কিআড্ডায় উপস্থিত সবাই। দিনটিকে স্মরণীয় করতে অতিথিদের সঙ্গে দল বেঁধে ছবি তুলেছে তারা। আর প্রতিবারের মতো এই সভায়ও কিশোর আলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনা শেষে কুইজের প্রশ্ন করা হয় কিআর ডিসেম্বর মাসের সংখ্যা থেকে। উত্তর দিয়ে সেভয়ের পক্ষ থেকে বাক্সভর্তি আইসক্রিম জিতে নেয় পাঁচজন। আর বাড়ি ফেরার পথে সবার জন্য আইসক্রিম তো ছিলই।