বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছিল তীব্র চায়ের নেশা। সে এমনই নেশা, সময়মতো চা পান না করলে মন আইঢাই করে, গানবাজনা করতে পারেন না, লেখাটেখাও আসে না কলমে। নজরুল দ্রোহের কবি। ব্রিটিশদের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে ছিলেন সব সময় সোচ্চার। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা তো নাড়িয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের ভিত। সেই নজরুল ভাবলেন, শুধু কবিতা লিখলেই চলবে না, ব্রিটিশদের এ দেশ থেকে তাড়াতে হলে নামতে হবে রাজনীতিতে। সুতরাং একবার সংসদ নির্বাচনে দাঁড়ালেন। তাঁর নির্বাচনী এলাকা ফরিদপুরসহ ঢাকার আশপাশের অঞ্চল। নজরুলের তখন তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা। ভারতজুড়েই—পূর্ববঙ্গেই বেশি। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, কবি হিসেবে তাঁর এই জনপ্রিয়তাই তাঁকে জিতিয়ে দেবে। সে সময় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ফুটছে বাঙালি আমজনতা। নজরুলের কবিতা তাঁদের প্রেরণা জোগায়। সুতরাং নজরুল ধরেই নিলেন ভোটে তিনি জিতবেন; বিপুল ব্যবধানেই জিতবেন।
ভোটে দাঁড়ালে নির্বাচনী এলাকায় যেতে হয়, জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে মাঠ গরম করতে হয়। নজরুল এলেন ফরিদপুর। বেশ কিছু জনসভা করবেন। এ জন্য বেশ কিছুদিন ফরিদপুর থাকতে হবে নজরুলকে। থাকার জায়গা হলো কবি বন্ধু জসীমউদ্দীনের বাড়িতে, ফরিদপুরের কাছেই তাম্বূলখানা গ্রামে।
নজরুল এসেছেন আর গানবাজনা থাকবে না, তা কি হয়! সুতরাং একদিন রাতে আয়োজন করা হলো সংগীত জলসার। রাতভর গান হবে। সময়মতো শুরু হলো গান। প্রচুর লোক জড়ো হয়েছে। কিন্তু বিদ্রোহী কবির চায়ের তেষ্টা পেল মাঝরাতে। গান বন্ধ করে দিলেন তিনি। চা ছাড়া আর একটি গানও নয়, জানিয়ে দিলেন সাফ। জসীমউদ্দীন পড়লেন বিপাকে। এখন চা পাবেন কোথায়!
রাত ১২টা পার হয়েছে। ঘুমিয়ে গেছে পুরো গ্রাম। কিন্তু কবির তো চা চাই-ই চাই। গাঁয়ের লোকে চা খেতে শেখেনি তখনো। তবু জসীমউদ্দীন সারা গ্রামের লোককে জাগিয়ে তুললেন, কাঁচা ঘুম ভাঙানোর অপরাধে কেউ রেগে গিয়েছিল কি না কে জানে। কারও বাড়িতে চা পাওয়া গেল না। যখন সবাই হতাশ, এক ভদ্রলোকের ভাঁড়ারে পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া গেল অল্প কিছু চায়ের লিকার। ভদ্রলোক শৌখিন গোছের, কিন্তু চা নিজে খান না, অতিথি আপ্যায়নের জন্য জমিয়ে রেখেছেন কয়েক বছরের পুরোনো চা। সেগুলো দিয়েই তেষ্টা মেটালেন নজরুল। তারপর রাতভর গান হলো। কিন্তু যার জন্য এত আয়োজন, সেই নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছিল বিদ্রোহী কবির।