অনেক নিচের ক্লাসে পড়ি তখন। বাসা থেকে বেরিয়ে একা একা কোথাও যাওয়া নিষেধ। একা কেবল স্কুলে যাওয়ার অনুমতি ছিল। আর যেতে পারতাম দিঘির চারপাশে আমার বন্ধুদের বাড়িতে। নানা রকম ভয় দেখানো হতো আমাকে। একলা বাড়ি থেকে বেরোলে ছেলেধরায় নিয়ে যাবে, হাত-পা ভেঙে পঙ্গু করে ভিক্ষে করাবে, রক্ত, কিডনি, চোখ এসব খুলে নিয়ে বিক্রি করে দেবে বিদেশিদের কাছে, এমনই নানা ভয়। বিশ্বাস করতাম না। আমার চোখের সামনেই দেখতাম, আমার চেয়ে কম বয়সী ছেলেরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে যেখানে সেখানে। আমার চেয়ে স্বাস্থ্য ওদের কারোরই খারাপ না। তাহলে ওদের ধরে নিয়ে যায় না কেন? ছেলেধরারা যেন আমাকে ছাড়া আর কাউকে চোখে দেখে না। আমার আর কোনো ভাই না থাকায় ভীষণ রাগ হতো। কেন আরেকটা ভাই হলো না? তাহলেই তো আর আমাকে নিয়ে এত ভয় থাকত না আম্মার। এত বাধা দিত না। যা-ই হোক, বেশি দূরে যেতে সাহস পেতাম না। ছেলেধরার ভয়ে নয়, আম্মার ভয়ে।
কিন্তু ওই ভয় আর কত দিন থাকে? একদিন ভয় কাটালাম।
স্কুল ছুটি। সম্ভবত দুর্গাপূজা কিংবা গরমের ছুটি হবে, ঠিক মনে নেই। পড়ারও চাপ নেই। সকালবেলায়ই বেরিয়ে পড়লাম বাসা থেকে। খানিকক্ষণ অহেতুক ঘোরাফেরা করলাম দিঘির পাড়ে। কথা বলার কাউকে পেলাম না। ননু, কামাল, কাশেম, কচি, শওকত, কেউ নেই। হতাশ হয়ে এসে বসলাম দিঘির ঘাটে। যদি কেউ আসে।
কেউ এল না। গেল কোথায় আজ ওরা সব? ঘাটে বসে বসে দেখছি, শানবাঁধানো সিঁড়ির কাছে পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে শত শত ডানকানা মাছ। বেলে মাছগুলো ভালো মানুষ সেজে এসে চুপটি করে শুয়ে পড়ছে সিঁড়িতে। মনে হয় কিচ্ছু জানে না। পানিতে হাত ডুবিয়ে চেপে ধরলেও কিছু বলবে না। কিন্তু আমি জানি, ধরতে গেলেই চোখের পলকে সুড়ুত করে ছুটে পালাবে। কাজেই সে চেষ্টা করলাম না।
কিন্তু মাছগুলো ক্রমেই লোভ দেখাতে লাগল আমাকে। ভাবলাম, যাই, দুই পয়সা দিয়ে একটা বড়শি কিনে ছিপ বানিয়ে নিয়ে আসি।
ওঠার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি প্রায়, এই সময় সেখানে এসে হাজির ইদ্রিস ভাই। ভালো নাম ইদ্রিস আলী। পড়ালেখা বিশেষ করেনি, খালি বাউণ্ডুলেপনা করে বেড়ায়। সে জন্য বড়রা তাকে পছন্দ করে না। ইদ্রিস ভাইয়ের আব্বাও না। অনেক চেষ্টা করেছেন ছেলেকে ভালো করার। হয়নি দেখে রেগেমেগে শেষে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। ছেলের জন্য নীরবে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেন ইদ্রিস ভাইয়ের আম্মা। ইদ্রিস ভাইয়ের আব্বা যখন বাজারের দোকানে চলে যান, তখন লুকিয়ে-চুরিয়ে বাড়িতে আসে ইদ্রিস ভাই। মায়ের কাছে ভাত চায়। তাড়াতাড়ি নাকেমুখে গুঁজে দিয়ে বাপ আসার আগেই পালিয়ে যায় আবার। রাত কাটানোর কোনো ঠিকঠিকানা নেই। যেখানে সুযোগ পায় শুয়ে থাকে। পাড়ার গার্জেনরা কেউ দেখতে পারে না তাকে।
কিন্তু এহেন ইদ্রিস ভাইকে আমার ভারি পছন্দ। প্রচণ্ড স্বাধীন মনে হয় তাকে। যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়াতে পারে, বাধা দেওয়ার কেউ নেই। আমার মতো বন্দী নয়। বেশি ভালো লাগে তার গল্প শুনতে। অনেক রোমাঞ্চকর গল্প জানা আছে তার, অনেক অভিজ্ঞতা। কী জানি কেন, তাকে পছন্দ করি বলেই হয়তো, কিংবা তার গল্প মন দিয়ে শুনি বলে, আমাকেও ভালোবাসে ইদ্রিস ভাই।
ইদ্রিস ভাই কেমন লোক, সেটা বোঝানোর জন্য আগে ছোট্ট একটা ঘটনা বলে নিই। একদিন সকালবেলা ইদ্রিস ভাইকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘যাচ্ছেন কোথাও?’
‘হ্যাঁ। যাবি?’
‘কোথায়?’
‘রেলরাস্তার ধারে।’
এই রেলরাস্তাটা আমার জন্য এক বিরাট আকর্ষণ। আব্বার সঙ্গে দু-একবার হাঁটতে গেছি। অন্য কারও সঙ্গে যাইনি, একা যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। বিষণ্ন ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললাম, ‘না, আম্মা শুনলে বকবে।’
‘খালাম্মা শুনবে কী করে? আমি তো আর বলব না।’
‘যদি কেউ দেখে ফেলে?’
‘আরে দূর, কে আসছে দেখতে। আয়।’
লোভটা সামলাতে পারলাম না। তা ছাড়া স্কুলও সেদিন ছুটি। রাজি হয়ে গেলাম।
আমার একটা হাত ধরে নিয়ে চলল ইদ্রিস ভাই। কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। এত দূরে যাচ্ছি! যদি কেউ দেখে গিয়ে আম্মাকে বলে দেয় তাহলে আস্ত রাখবে না। তা ছাড়া একটা অপরাধবোধ চেপেই রইল মনে। সারাক্ষণ মনে হতে লাগল আম্মাকে না জানিয়ে নিষিদ্ধ এলাকায় চলেছি। কাজটা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু পিছিয়ে আসতেও ইচ্ছে করছে না।
রাস্তাটা খুব সুন্দর। অনেক গাছপালা, পাখি, ফড়িং, প্রজাপতি আছে। কিন্তু পুরোপুরি মন দিতে পারছি না সেসবের দিকে। আসলে অপরাধী মন নিয়ে আনন্দ পাওয়ার জন্য কোনো কাজ করা উচিত নয়, আনন্দ তো লাগেই না তখন, বরং সবকিছু মাটি হয়।
রেলরাস্তার পাশেই একটা চায়ের দোকান ছিল। সেখানে এসে থামল ইদ্রিস ভাই। বলল, ‘আয় চা খাই।’
বললাম, ‘আমি চা খাই না।’
‘তাহলে বিস্কুট খা।’
‘না খাব না।’
‘আরে খা,’ বলতে বলতে নিজেই টিন থেকে বড় বড় গোল দুটো সাদা বিস্কুট বের করে আমার হাতে গুঁজে দিল। চালের গুঁড়ো দিয়ে বানানো হতো সেসব বিস্কুট। খুব মজা লাগত আমার।
ইদ্রিস ভাই ভেতরে বসে চা খাচ্ছে, আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম চারপাশটা। প্রায় মাইল দুই দূরে রেলের একটা পুল আছে। তার ওপারে দেখা যাচ্ছে একটা ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনের অংশ। চিটাগাংয়ের দিক থেকে মালগাড়ি আসছে।
দোকানটার অন্য পাশে টেলিগ্রাফের তারে বসে আছে অনেকগুলো মুনিয়া পাখি। ওগুলোর মাঝে মাঝে দু-চারটা চড়ুই আর শালিক। মহা কিচিরমিচির জুড়েছে।
দোকানের সামনের সরু কাঁচা রাস্তাটার পর থেকেই শুরু হয়েছে ধানের খেত। ধান কাটা সারা, আবার চষার অপেক্ষায় পড়ে আছে জমিগুলো। কয়েকটা জমির পরে একটা উঁচুমতো জায়গায় কে যেন একটা মরা গরু ফেলে গেছে। শকুনে টেনেছিঁড়ে খাচ্ছে ওটাকে।
শকুনের গরু খাওয়া দেখতে আমার ভালো লাগে না। ভয়াবহ, নিষ্ঠুর মনে হয় দৃশ্যটা। রক্তাক্ত একটা দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে কতগুলো কুৎসিত পাখির ঠোঁটের আঘাতে, কেমন নারকীয় ব্যাপার মনে হয়।
আম্মাকে না বলে বাসা থেকে বহুদূরে চলে এসেছি—হোক না সেটা মাত্র আধমাইলের কিছু বেশি—এমনিতেই ভারী হয়ে আছে মন, তার ওপর ওই সাংঘাতিক দৃশ্য! ভয় করতে লাগল। নিজেকে গরুটার জায়গায় কল্পনা করলাম। মৃত্যু! ভীষণ ভয় করতে লাগল। আম্মার জন্য মন কেমন করে উঠল। কান্না পেতে লাগল। আর এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে করল না ওখানে। দোকানের দরজার কাছে এসে প্রায় কঁকিয়ে উঠলাম, ‘ইদ্রিস ভাই, বাসায় যাব!’
অবাক হয়ে বলল সে, ‘সে কী রে, এই মাত্র তো এলি!’
‘না, আমি চলে যাব!’
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কী বুঝল ইদ্রিস ভাই কে জানে, আর কিছু বলল না। দুই ঢোঁকে কাপের চাটুকু শেষ করে পিরিচে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল। ‘দামটা লিখে রাখো’ দোকানদারকে বলে, দোকানদার কী জবাব দিল সে তোয়াক্কা না করেই বেরিয়ে এল। আমাকে বলল, ‘চল’। তারপর লাইনের দিকে চোখ পড়তেই চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে, মরল তো!’ বলেই দিল দৌড়।
লাইনের ওপর বসে খেলা করছে একটা তিন-চার বছরের বাচ্চা। ওর মা ভিক্ষে করে। লাইনের ধারে নিচু জায়গায় নেমে শাক তুলছে। খেয়ালই করেনি তার ছেলেটা লাইনের ওপর চলে গেছে। ট্রেনও চলে এসেছে। উঠে গিয়ে ছেলেকে যে বাঁচাবে, তারও আর সময় নেই। দিশেহারা হয়ে চেঁচিয়ে উঠল আতঙ্কিত মা।
ঘনঘন হুইসেল দিচ্ছে ট্রেন। ড্রাইভারও দেখতে পেয়েছে বাচ্চাটাকে। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। তাই বাঁশি বাজিয়ে ছেলেটাকে সরানোর চেষ্টা করছে।
ভয় পেয়ে গেছে বাচ্চাটা। সরছে না বরং একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে জোরে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছে।
ঝড়ের গতিতে ছুটে যাচ্ছে তখন ইদ্রিস ভাই। লাফ দিয়ে গিয়ে পড়ল লাইনের ওপর। ছেলেটাকে জাপটে ধরে প্রায় ডাইভ দিয়ে সরে চলে গেল ওপাশে। ঠিক ওই মুহূর্তে তার পাশ কাটাল ইঞ্জিনের সামনের চাকা। হয় খুলে গিয়েছিল, কিংবা চাকায় আটকে গিয়ে টান লেগে খুলে এসেছিল ইদ্রিস ভাইয়ের লুঙ্গিটা। চাকার তলায় পিষে, কেটে সেটা টুকরো টুকরো হয়ে গেল। ভাগ্যিস লুঙ্গির নিচে হাফ প্যান্ট পরা ছিল।
লাইনে আর পাথরে লেগে ইদ্রিস ভাইয়ের অনেক জায়গায় কেটে-ছিঁড়ে গেছে। রক্ত বেরোচ্ছে। লাইনের পাশ থেকে তোলা কী এক জাতের গাছের কষ সেগুলোতে লাগিয়ে দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা সাঙ্গ করল সে। তারপর আমাকে বলল, ‘চল, বাড়ি যাই।’
সেদিন থেকে আমার হিরো হয়ে গেল ইদ্রিস ভাই।
একটা ঘোরের মধ্যে যেন বাসায় ফিরে এলাম।
বাসায় ফিরে আম্মাকে বললাম সব কথা।
না বলে ও রকম একটা জায়গায় গিয়েছিলাম বলে আম্মা আমাকে বকতে লাগল। চুপ করে রইলাম। শেষে বলল, ‘ইদ্রিসের সঙ্গে ওখানে যে গেলি, গাড়ির নিচেও তো পড়তে পারতি। ওই ছেলেটা না হয়ে তুইও থাকতে পারতি ওখানে। তখন কী হতো?’
অবাক হয়ে বললাম, ‘কী আর হতো? আমাকেও বাঁচাত ইদ্রিস ভাই!’
জবাব দিতে পারল না আম্মা।
যা-ই হোক, আসল যে গল্পটা বলতে বসেছি, সেটা বলি। অনেক ভূতের গল্প জানে সে। শ্মশানের ভূত, তাল আর তেঁতুলগাছের জিন, আন্ধা-পুকুরের মেছোজিন, মোট কথা এমন কোনো জিন-ভূত নেই, যার সঙ্গে ইদ্রিস ভাইয়ের সাক্ষাৎ হয়নি।
ইদ্রিস ভাই আমার পাশে বসল। বায়না ধরলাম, ‘ইদ্রিস ভাই, একটা ভূতের কিচ্ছা বলেন না। ওই যে নান্দু ফকিরের ভূত...।’
মুচকি হাসল ইদ্রিস ভাই। ‘ভূতের গল্প শুনবি? তো ওই পুরোনোটা কেন? দাঁড়া, আজ একটা মেছো ভূতের গল্প শোনাব।’
‘মেছো ভূত?’
‘হ্যাঁ। দুলালদের পুকুরের।’
চমকে গেলাম। ওই পুকুরটার অনেক বদনাম। চারপাশে গাছপালা, শিমুলগাছ আছে অনেক। কালো পানি। রোদের চেয়ে ছায়াই বেশি থাকে। ফলে দেখলেই ভয় ভয় লাগে। পুকুর, দিঘি এসব বদ্ধ জলাশয়ের ব্যাপারে আমার যেমন আকর্ষণ, তেমনি একটা ভয়ও ছিল। ছোটবেলায় নানির কাছে ভুতুড়ে সিন্দুকের গল্প শুনতে শুনতে একটা বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গিয়েছিল আমার, আন্ধা-পুকুর মানেই ভুতুড়ে সিন্দুকের বাসস্থান। সিন্দুকেরা কেন ভূত হয়, তারও একটা চমৎকার ব্যাখ্যা আছে নানির। অনেক কিপটে লোক সোনা-রুপা টাকাপয়সা সিন্দুকে ভরে রাখে, খরচ করে না। দামি জিনিস বদ্ধ জায়গায় অনেক দিন আটকে রাখলে নাকি সেগুলোর ওপর জিনের আসর হয়ে যায়। আর তখন ঘরে থাকতে চায় না। কাছাকাছি পুকুর থাকলে সিন্দুকটাকে নিয়ে ঘরের বেড়া ভেঙে হলেও পানিতে গিয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে সে সিন্দুকের শিকল গজায়। পানিতে মানুষ নামলেই আস্তে করে শিকল এসে পেঁচিয়ে ধরে তার পা। এত আলতো করে ধরে প্রথমে কিছু বুঝতেই পারে না মানুষ। কিন্তু যখন বোঝে, তখন আর কিছু করার থাকে না। টেনে নিয়ে চলে যায় তাকে সিন্দুক। তারপর তাকে কী করে সেটা আর কেউ জানে না। ফলে শুধু যে পানির সিন্দুক তাই নয়, কারও ঘরে চাকাওয়ালা কালো রং করা কোনো সিন্দুক দেখলেও তার কাছ থেকে দশ হাত দূরে থাকতাম আমি।
দিঘির সিন্দুকের এ রকম গল্প অবশ্য বাংলাদেশের অনেক জায়গায়ই শোনা যায়। ফেনী শহরের কাছেই আরেকটা দিঘি আছে, তার নাম বিজয় সিং দিঘি। অনেক উঁচু উঁচু পাড়। ওখানে দাঁড়িয়ে পানির দিকে তাকালে সত্যিই ভয় লাগত, আমার তো অন্তত লাগত। ওই দিঘিটা নিয়েও অনেক কিংবদন্তি আছে, সিন্দুকের গল্প চালু আছে। বহুদিন আগে নাকি কোনো এক জমিদারের ছেলে নতুন বউকে নিয়ে চলেছিল ওই দিঘির ধার দিয়ে। পিপাসা পেল বউয়ের। পানি খেতে নামল দিঘিতে। তার পা এসে পেঁচিয়ে ধরল চুলের মতো সরু শিকল। ভয় পেয়ে পানি থেকে উঠে এল বউ। তারপর শুরু হলো সেই শিকল টেনে তোলার পালা। যতই টানে ততই ওঠে, যতই টানে ততই ওঠে, শেষ আর হয় না। কাটতে গেলে কাটে না, এতই শক্ত। বরং কোপ দিলেই ফোঁস ফোঁস শব্দ করে আর আগুন বেরোতে থাকে তা থেকে। সাত দিন পর স্বপ্নে দেখল জমিদারের ছেলে, শিকল তোলার চেষ্টা করে লাভ নেই, বরং এ রকম করতে থাকলে তার বংশ নির্বংশ হয়ে যাবে। দিঘি যা চাইছে সেটা তাকে দিয়ে দেওয়াই ভালো। কী আর করবে? হাল ছেড়ে দিল বেচারা। একটানে তার বউকে পানিতে নামিয়ে নিয়ে গেল শিকল। তারপর থেকেই নাকি মাঝেমধ্যে দিঘির একটা বিশেষ কোণে গিয়ে পানিতে তাকালে অপূর্ব একটা সুন্দরী মেয়েকে দেখা যায়, কখনো পানির নিচে ঘুরে বেড়াতে, কখনো চুল আঁচড়াতে। কিছুটা বড় হয়ে, বাড়ি থেকে একলা বেরোনোর অনুমতি পাওয়ার পর বহুবার গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওই দিঘির পানির দিকে তাকিয়ে থেকেছি আমি, মেয়েটাকে খুঁজেছি, কখনো দেখতে পাইনি।
ইদ্রিস ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দুলাল ভাইদের পুকুরে নাকি সিন্দুক আছে?’
‘আছে। রাতের বেলা ভেসে ওঠে। নীল আলো জ্বলে।’
দৃশ্যটা কল্পনা করে নিজের অজান্তেই গায়ে কাঁটা দিল আমার। বললাম, ‘বলেন।’
‘দাঁড়া, একটা বিড়ি ধরিয়ে নিই,’ বলতে বলতেই কোমরে হাত দিল ইদ্রিস ভাই। একটা চ্যাপ্টা টিনের বাক্সে পাতার বিড়ি আর ম্যাচ রাখে।
বিড়ি ধরিয়ে জোরে জোরে কয়েকটা টান দিয়ে শুরু করল, ‘গরমও পড়েছে সেদিন। এমন গরমের গরম, গায়ে কাপড় রাখতে পারি না। দুলালদের পুকুরপাড়টায় খুব ঠান্ডা। গিয়ে বসলাম মাদার (শিমুল) গাছের নিচে। দেখি, মাছে বড় বড় ঘাই মারে। আর বছর রুই-কাতলার পোনা জিইয়েছিল, সেগুলোই বড় হয়েছে। এ ছাড়া আগের পুরোনো অনেক মাছ আছে পুকুরটায়। দিনের বেলা বড়শি কিংবা জাল নিয়ে গেলে লুঙ্গি কাছা মেরে লাঠি নিয়ে তাড়া করবে দুলালের আব্বা। ঠিক করলাম, রাতেই কাজটা সারব।
‘বাড়ি গিয়ে নতুন জালটায় গাবের কষের মাঞ্জা লাগানো শুরু করলাম। মাঞ্জা লাগালে সুতা শক্ত হয়, বড় মাছও আর সহজে ছিঁড়তে পারে না। লাগিয়ে, শুকিয়ে-টুকিয়ে রেডি করে রাখলাম। রাতে সকাল সকাল খেয়ে ফেললাম সেদিন। তখন জাল বের করতে দেখলেই আব্বা শুরু করবে চেঁচামেচি। ঘাটলায় এসে বসে রইলাম। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে পা টিপে টিপে গিয়ে বের করে আনলাম জালটা, তারপর সোজা রওনা হলাম দুলালদের পুকুরের দিকে।
‘দুলালদের বাড়িঘরও সব অন্ধকার। ওরাও সব ঘুমিয়ে পড়েছে। তবু একটা মাদারগাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইলাম চুপচাপ। বলা যায় না, দুলালের বাপ হয়তো তখনো ঘুমায়নি। অনেক রাত পর্যন্ত নামাজ-কালাম পড়ে তো।
‘দিনের বেলাতেই পুকুরটার পানি যেন কেমন লাগে, দেখিসনি? আমার জানামতেই দু-তিনজন ডুবে মরেছে। তা-ও গেছি, কেবল বড় মাছের লোভে। দুনিয়ার যত আজেবাজে পাখির বাসা ওখানে। একটা প্যাঁচা ডাকতে শুরু করল একেবারে মাথার ওপর। ঘুপুৎ ঘুপুৎ করে একটু পরপরই এখানে ওখানে মাছে ঘাই মারে।
‘একটা যমকুলি ডেকে উঠল। চিনিস পাখিগুলোকে? লাল লাল চোখ, যেন শয়তানের চ্যালা। কাকের মতোই দেখতে অনেকটা, তবে ঠোঁট অন্য রকম, পালকগুলো বাদামি। কারও বিপদ দেখলেই নাকি টের পেয়ে যায় ওরা, ডেকে ডেকে হুঁশিয়ার করে। একবার কলেরায় মানুষ মরা শুরু হয়েছিল, সে বছর সারারাত খালি ওই পাখির ডাক শুনেছি। পুকুরপাড়ে ওটার ডাক শুনে ঘাবড়ে গেলাম। মনে হতে লাগল, আজ বিপদেই পড়ব, ফিরেই যাই।
‘যাওয়ার কথা ভাবছি, হঠাৎ ঘুপ্পুৎ করে এমন জোরে এক ঘাই মারল একটা মাছ, আমার পায়ের কাছ থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে। লেজের বাড়ি দেখেই বুঝে গেলাম রুই মাছ। পাখিপুখি সব উধাও হয়ে গেল মাথা থেকে, ভূতের ভয়ও গায়েব। মাছের নেশা বড় নেশা। এই সুযোগ ছাড়া যায় না। জাল ঘুরিয়েই মেরে দিলাম।
‘কিন্তু মেরে তো দিলাম, তারপর থেকেই যা শুরু হলো না! টেনে জাল আর তুলতে পারি না। হ্যাঁচকা টান লাগল। টানটা কেমন বোঝাতে পারব না। মনে হলো একটা দৈত্য-টৈত্য কিছু আমাকে টেনে নিয়ে যেতে চায়। ইয়া বড় বড় ভোগলা ছাড়ছে, দুই হাত ছড়িয়ে ভোগলাগুলোর সাইজ দেখাল সে, তাতে মনে হলো পাঁচ-ছয় ফুটের কম না। ‘বাঁ হাত দিয়ে মাদারগাছটাকে জড়িয়ে ধরে ফেললাম, জাল ছাড়লাম না। যা থাকে কপালে, ছাড়ব না। জালের দড়িটা পেঁচিয়ে ফেলতে লাগলাম একটা কাটা ডালের গোড়ায়। এই টানাটানিতে আমার লুঙ্গি খুলে পড়ে গেল (ইদ্রিস ভাইয়ের এই লুঙ্গি খুলে পড়াটা নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে। কীভাবে লুঙ্গি পরে কে জানে, খালি খুলে যায়), তোলার সময় নেই, চেষ্টাও করলাম না।
‘হঠাৎ চোখ পড়ল মাঝপুকুরে। ধড়াস করে এক লাফ মারল বুকের মধ্যে। চোখ উল্টে যে পড়ে যাইনি এটাই বেশি। আর দাঁড়ালাম না। নিচু হয়ে লুঙ্গিটা তুলে জালটাল ফেলেই দিলাম দৌড়। সোজা একেবারে বাড়িতে। ভীষণ ভয় পেয়েছি। এই দেখ, এখনো কেমন লোম খাড়া হয়ে গেছে,’ হাত উঁচু করে হাতের লোম দেখাল ইদ্রিস ভাই। অবাক কাণ্ড! সত্যিই দাঁড়িয়ে গেছে। বলল, ‘বাড়িতে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে দায়ের আগায় করে অনেক লবণ খেলাম। লাভ হলো না কিছু। ভয় যা পাওয়ার তো পেয়েই গেছি। লবণে আর কিছু করতে পারল না। পেটে চিপ মেরে এক্কেবারে আমাশয়। এক মাস ভুগেছি তারপর। রক্ত আমাশয়ে।
‘পরদিন ভোরবেলা আব্বা ওঠার আগেই উঠে আবার চলে গেলাম দুলালদের পুকুরে। আজান হয়ে গেছে। ভূত-টূত আর বেরোবে না। জালটা এনে না রাখলে কার কাজ ঠিক বুঝে যাবে আব্বা। ধোলাই আছে কপালে। সে জন্যই গেলাম। গিয়ে দেখি আগের মতোই গাছের সঙ্গে বাঁধা আছে জালটা। ধরে টান দিলাম। জোর লাগল না, উঠে চলে এল। এল তো, কিন্তু ওই জাল আর ব্যবহারের উপযুক্ত নেই। ছিঁড়ে ফালাফালা। ওটাই এনে চুপে চুপে রেখে দিলাম আগের জায়গায়।’
চুপ হয়ে গেল ইদ্রিস ভাই। আমি তখন মহা উত্তেজিত। মাঝপুকুরে কী দেখেছিল সে, জিজ্ঞেস করলাম।
আমার কথা যেন শুনতেই পেল না ইদ্রিস ভাই। চুপচাপ বিড়ি টেনে চলেছে।
‘কী দেখেছিলে?’ আবার জিজ্ঞেস করলাম।
‘আরে বলছি, দাঁড়া না, বিড়িটা খেয়ে নিই।’
গল্পের একটা বিশেষ জায়গায় এনে ঝুলিয়ে রাখা তার স্বভাব। মজা পায়।
জোরে জোরে কয়েকটা সুখটান দিয়ে জ্বলন্ত গোড়াটা পানিতে ছুড়ে মারল ইদ্রিস ভাই। ছ্যাঁৎ করে নিভল আগুন। আমার দিকে তাকিয়ে আচমকা একটা প্রশ্ন করে বসল, ‘আমার গল্প শুনতে তোর ভালো লাগে, না রে?’
‘লাগে!’
‘আমাকেও লাগে?’
‘লাগে,’ এত স্বাধীন আর এত সুন্দর গল্প যে বলতে পারে তাকে ভালো না লাগার প্রশ্নই ওঠে না। ‘ও ইদ্রিস ভাই, বলো না, কী দেখেছিলে?’
হাসল সে। তারপর নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, ‘নীল আলো!’
ঠিক এই কথাটাই শোনার আশা করছিলাম আমি।
ইদ্রিস ভাইয়ের গল্পের কথা পরে বলেছিলাম আম্মাকে। শুনে বলল, ‘ওর কথা শুনতে যাস কেন? একটা মিথ্যুক।’
আম্মার কথা ভালো লাগল না আমার। তর্ক শুরু করলাম, ‘কিন্তু আমাকে ছেঁড়া জালটা দেখিয়েছে তো। কী করে ছিঁড়ল?’
‘জাল ছেঁড়ার জিনিসের অভাব আছে নাকি পানির নিচে? গাছটাছ কেটে ফেলে রেখেছিল হয়তো...।’
‘ওখানে গাছ থাকলে ইদ্রিস ভাই খুব ভালো করেই জানত।’
‘হয়তো জানে। তোকে বলেনি।’
‘তাহলে বলার সময় হাতের লোম দাঁড়াল কেন?’
রেগে গেল আম্মা, ‘তোকে না কতবার মানা করেছি ইদ্রিসের সঙ্গে না মিশতে? যাস কেন?’
বুঝলাম, এবার মানে মানে সরে যাওয়াই ভালো। নইলে উটকো সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে, যেগুলোর জবাব দিতে গেলে বিপদে পড়ে যাব। তাড়াতাড়ি সরে গেলাম।