ছেলেবেলাটা কেটেছে আমার ফেনী শহরে। সেখানে আমাদের বাসার কাছেই ছিল বিরাট এক দিঘি। তাতে মাছ ধরতেন আমাদের এক কমন দাদু। স্কুল ছুটি থাকলে সারাটা বিকেলই গিয়ে বসে থাকতাম তাঁর কাছে, আর গল্প শুনতাম। নানা রকম গল্প। দেশ-বিদেশের গল্প। কলকাতা, বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার), অনেক জায়গায় গিয়েছেন তিনি। তাঁর কাছে গিয়ে বসে থাকার আরও একটা বড় লোভ ছিল, গল্পের বই। কোনোমতে ভজিয়ে-ভাজিয়ে একটা বই যদি নিতে পারি, পড়ার জন্য।
এক গল্প বহুবার করে বলতেন তিনি। যেগুলো বেশি ভালো লাগত আমার, তার মধ্যে একটা ছিল ওই দিঘিরই গল্প। ওটাতে মাঝে মাঝে মানুষ ডুবে মারা যেত। এর কারণ হিসেবে তিনি বলতেন, দিঘির মাঝখানে পানির নিচে কারেন্ট আছে।
ওই কারেন্টটা যে কী জিনিস, তিনি বুঝতেন কি না, জানি না, তবে আমি বুঝিনি। কেবলই মনে হতো বৈদ্যুতিক কিছু তো পানির নিচে থাকতে পারে না, তাহলে এটা কী? জিজ্ঞেস করতে লজ্জা লাগত, পাছে আবার তিনি বোকা ভেবে বসেন। পাঠক হিসেবে আমাকে তিনি মূল্য দিতেন। তাই জ্ঞানের ব্যাপারে কোনো কারণে তাঁর কাছে ছোট হতে চাইতাম না।
যা-ই হোক, আমি ধরেই নিয়েছিলাম ওই কারেন্ট ভয়ংকর কোনো জলদানব কিংবা জলভূতগোছের কিছু। সুতরাং ভয়ে ভয়ে থাকতে হতো। কখন এসে সেই আজব ‘কিছুটা’ আমাকেও ধরে। তাই বলে পানিতে দাপাদাপি বন্ধ থাকত না আমার। স্কুল খোলা থাকলে তো বেশিক্ষণ পারতাম না, কয়েকটা সাঁতার আর গোটা পঞ্চাশেক ডুব দিয়েই উঠে চলে আসতে হতো। কিন্তু বন্ধ থাকলেই হয়েছে। সেই সকাল নটা-দশটায় গিয়ে যে নামতাম, আর ওঠার নাম নেই। দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে যেত। তিনটে বেজে গেলে আম্মা আর থাকতে না পেরে অস্থির হয়ে কাজের ছেলেটাকে পাঠাত আমাকে ডাকতে।
আমি এতক্ষণ পানিতে কী করেছি, নিশ্চয় প্রশ্ন জাগছে মনে? শুরুতে, আর কয়েকজন ছেলের সঙ্গে একটা বিশেষ খেলা খেলতাম। খেলাটার একটা স্থানীয় নাম, বল্লি। কয়েকজনে মিলে পানিতে ছোটাছুটি করে আর একজন তাদের ছোঁয়ার চেষ্টা করে। যাকে ছুঁয়ে দেয়, সে তখন আবার অন্যদের ছোঁয়ার চেষ্টা করে।
বল্লি খেলে আর সাঁতার কেটে ঘণ্টা দুই কাটানোর পর ওরা উঠে যেত। আমি উঠতাম না। ভেজানোর জন্য প্রচুর বাঁশ ফেলে রাখা হতো দিঘির পানিতে। কিংবা আস্ত কলাগাছ কেটে ফেলে দেওয়া হতো পানি পরিষ্কার রাখার জন্য। তারই কোনো একটা সম্বল করে ভেসে থাকতাম পানিতে—কখনো তার ওপর বসে, কখনো চিত হয়ে শুয়ে। কখনো ভেলার মতো তাতে চড়ে হাতকে দাঁড় বানিয়ে এপার-ওপার করতাম, কখনো মাঝদিঘিতে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকতাম আকাশের দিকে তাকিয়ে। কারেন্টের ভয় সারাক্ষণই থাকত মনে, তবে সেটা যতটা সম্ভব ভুলে থাকার চেষ্টা করতাম। মাঝে মাঝে ভয় হতো, এই বুঝি মাটির বাসা থেকে বেরিয়ে দিঘির কাজল কালো পানির গভীরতা ভেদ করে আমাকে নিতে আসছে কারেন্ট। আমার কল্পনায় ওটা ছিল কালো রঙের এক অতিকায় সিন্দুক। যার লম্বা শিকল আছে। সেটা দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে টেনে নিয়ে শিকারকে ভরে ফেলে নিজের পেটে। চলে যায় নিজের বাড়িতে। তারপর মানুষগুলোকে কী করে! গোলাম-টোলাম বানিয়ে রাখে না, এটা ঠিক। খেয়েও ফেলে না। তাহলে যারা ডুবত তারা আর ভেসে উঠত না। নিশ্চয় বনিবনা হয় না, তখন রাগ করে মেরে ফেলে। ভাবতাম, আমাকে ধরলে সিন্দুকের অবাধ্য হব না, যা বলবে তাই করব। তাহলে হয়তো খুশি হয়ে আমাকে পানির নিচে এক অচিনপুরীতেও নিয়ে যেতে পারে। যেখানে রয়েছে এক অসাধারণ রাজ্য। যেখানে বাস করে পরিরা। সোনার গাছে হীরার ফুল ফোটে, সোনালি টিয়ে খুঁটে খায় মোতির ফল। রূপকথার গল্পের মতো। ভাবতাম, ও রকম রাজ্য ছেড়ে কোনো দিন আর আসব না আমি। ওদের অনুরোধ করে থেকে যাব ওদেরই দেশে। কে যায় স্কুলে পণ্ডিত স্যার আর মওলানা স্যারের বেতের বাড়ি খেতে। আমি না ফিরলে আম্মার খুব শিক্ষা হবে। বকাবকি আর সময়ে-অসময়ে দু-চার ঘা উত্তমমধ্যম চর্চা করার লোক পাবে না তখন। মা কেন বকে, ছেলে কতটা যন্ত্রণা দিলে গায়ে হাত তোলে, বোঝার বয়স হয়নি তখনো।
মাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য আরেকটা কাজ করব, ভাবতাম। মার্ক টোয়েনের টম সয়্যারের মতো রাতের বেলা চুপিচুপি উঠে চলে আসব পানি থেকে। টম দ্বীপ থেকে নদী পেরোত সাঁতরে, আমি অচিনপুরী থেকে আসব সিন্দুকে করে। ওটা তখন আর ক্ষতি করে না আমার, বাহন এবং বন্ধু হয়ে গেছে। বাসায় এসে দেখব আম্মা কী করছে। শুনব, কাঁদছে আর আফসোস করছে এত দিন আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার জন্য। কেঁদে কেঁদে আপাকে বলছে: ছেলেটা খারাপ ছিল না। না হয় একটু-আধটু দুষ্টুমি করতই। তাতে কি? অযথাই মেরেছি ওকে, কারণে-অকারণে শাস্তি দিয়েছি...আমার তখন মনে হবে, কেমন মজা! এখন বোঝো! তবে মন নরম হয়ে যাবে আমার। কিন্তু দেখা দেব না। সরে চলে আসব। কারণ, ঠিকই তো করে ফেলেছি আর কোনো দিন ঘরে ফিরে যাব না। পরির রাজ্যে বাস করে কথার নড়চড় করা চলে না।
শুধু যে পরির রাজ্যে যাওয়ারই স্বপ্ন দেখতাম তা নয়। আরও অনেক জায়গায় যেতে ইচ্ছে করত। ভাবতাম, ইশ্, বড় হয়ে যদি দস্যু বাহরামের মতো বীর হতে পারতাম! কিংবা আফ্রিকার বনের রাজা টারজান!
আমি যখন পানিতে নামতাম, তখন অনেক মানুষ গোসল করতে আসত। হইচই, কথাবার্তা চলত। কখন যে সেসব থেমে যেত, নীরব হয়ে আসত আশপাশটা, অনেক সময়ই টের পেতাম না। আমি হয়তো তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে কিংবা চোখ মুদে বাঁশের ওপর ভাসছি আর ভাবছি। একটা মাত্র বাঁশ সম্বল করে তার ওপর ভেসে থাকার কৌশলটা রপ্ত করেছিলাম ভালোই। চমক ভাঙত কাজের ছেলেটার ডাকে, ‘দাদা গো, আমনে এহনও পানিত! আর আম্মায় অই দিকে চিন্তায় বাঁচে না!’
কী আর করব? স্বপ্নবিলাস ছেড়ে উঠে আসতেই হতো।
ওই দিঘিতে অনেক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। দুটোর কথা বলি।
দিঘির দুই কোণে দুটো সিঁড়ি ছিল। অনেক পুরোনো। একটা সিঁড়ি অনেক বড়, প্রায় তিরিশ-চল্ল্লিশ ধাপের। কিংবা বেশিও হতে পারে। মনে নেই। সম্ভবত ফাল্গুন-চৈত্র মাসের দিকেই পানি অনেক নিচে নেমে যেত। বেরিয়ে পড়ত সিঁড়ির অনেক ধাপ। ডুব দিয়ে সহজেই একেবারে শেষ সিঁড়িটার কাছে চলে যেতে পারতাম। সিঁড়ির তলায় ভেতরের দিকে মাটি খসে গিয়েছিল পানিতে ভিজে ভিজে। বিরাট এক ফোকর হয়ে ছিল। তার ভেতরেও পানি। প্রায়ই ওই ফোকরটার কাছে চলে যেতাম। দেখে ভয় লাগত আবার লোভও হতো ভেতরে কী আছে দেখার জন্য। মনে হতো, ঘড়া ঘড়া সোনার মোহর নিশ্চয় লুকানো রয়েছে ওর ভেতরে।
অনেক দিন কাছে গিয়ে ফিরে আসার পর আরেক দিন আর কৌতূহল দমাতে পারলাম না কিছুতেই। যা থাকে কপালে ভেবে ঢুকে পড়লাম। পানি আর ফুরায় না। আচমকা ভয় পেয়ে যাওয়ায় দম ফুরিয়ে গেল অসময়েই। মাথা ঠান্ডা রাখার প্রশ্নই ওঠে না। চিন্তার ক্ষমতা গুলিয়ে গেল। ফেরত যাব, না কী করব, ঠিক করতে পারলাম না। তবে একটা কাজ বহাল রেখেছিলাম, ওপরে ঠেলে ওঠা। যখন মনে হলো আর পারব না, ফুসফুস ফেটে যাবে, এই সময় ভুস করে ভেসে উঠল মাথা। শ্বাস নিয়ে বাঁচলাম।
ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুই চোখে পড়ল না। ততক্ষণে দেখার আগ্রহও আমার ফুরিয়েছে। ফিরে যেতে হবে এবার। লম্বা দম নিয়ে আবার দিলাম ডুব। নিরাপদেই বেরিয়ে আসতে পারলাম।
কতটা বোকামি করেছি ওই ফোকরে ঢুকে, তখন বুঝিনি। পরে, অনেক বছর পরে যখন ঠান্ডা মাথায় ভেবেছি, শিউরে উঠেছি ভয়ে। অনেকগুলো ভয়াবহ বিপদ ঘটতে পারত। ভেতরে পানির ওপরে ফাঁপা জায়গা না-ও থাকতে পারত। তাহলে আর ভেসে উঠতে পারতাম না। মাটিতে কিংবা সিঁড়িতে ঠেকে যেত মাথা। দম ফুরিয়ে গেছে তখন। ফিরেও আসতে পারতাম না। আবার বাতাসে অক্সিজেনও নাও থাকতে পারত। তার বদলে থাকতে পারত কোনো মারাত্মক বিষাক্ত গ্যাস। বদ্ধ জায়গায় যেমন থাকে। তাহলে বাঁচতে পারতাম না। এখন ভাবলে লোম দাঁড়িয়ে যায়। ওখানেই মরে পড়ে থাকতাম, কেউ আমাকে কোনো দিন খুঁজে পেত না, আমার লাশও না। কেউ কল্পনাই করতে পারত না, আমি ওই ফোকরের ভেতর গিয়ে ঢুকেছি।
ফোকর আবিষ্কার করার পর লুকানোর একটা চমৎকার জায়গা পেয়ে গেলাম। পানিতে বল্লি খেলার সময় কেউ তাড়া করলেই ডুব দিয়ে গিয়ে ওটার ভেতরে ঢুকে পড়তাম। আরেকটা প্রিয় খেলা ছিল আমাদের, ডুব দিয়ে কে কত বেশি সময় পানির নিচে থাকতে পারে তার প্রতিযোগিতা। স্বভাবতই আমি সবাইকে হারিয়ে দিতাম, শুধু হারিয়ে দেওয়াই না, তাজ্জব করে দিতাম। কারণ যতক্ষণ ইচ্ছে আমি ডুবে থাকতে পারতাম। আসলে তো ঢুকে থাকতাম ফোকরের ভেতরে। রহস্যটা কাউকে জানতে দিইনি। আরেকটা ব্যাপারে হুঁশিয়ার থাকতাম, বড়রা কেউ কাছাকাছি থাকলে ওই প্রতিযোগিতায় যেতাম না। তাহলে আমি নিশ্চিত, ওরা ব্যাপারটা ধরে ফেলত।
এসব প্রায় ষাট বছর আগের কথা। আজও সেই দিঘি আছে কি না, সিঁড়ির নিচের সেই ফোকর আছে কি না, জানি না। হয়তো মাটিতে ভরাট হয়ে গেছে, কিংবা দিনে দিনে সিঁড়ি নেমে গিয়ে, কিংবা ভেঙে গিয়ে ফোকরের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে, কিংবা হয়তো আরও বড় হয়েছে। আর দিঘিটা যদি না থাকে, ভরাট করে বাড়ি তুলে ফেলা হয়, তাহলে তো চিরতরেই হারিয়ে গেছে ওই ফোকর। তবে আমার স্মৃতিতে এত বছর পরেও জ্বলজ্বল করছে ওটা।
এবার দ্বিতীয় ঘটনাটার কথা বলি। দিঘির অন্য কোণের ছোট সিঁড়িটার কাছ থেকে একটু দূরে একটা কাঁঠালগাছ ছিল। বেশি বড় না গাছটা। একেবারে পুকুরের পাড়ে ছিল। বড় একটা মোটা ডাল চলে এসেছিল পানির ওপরে। তাতে উঠে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়া একটা মজার খেলা ছিল আমাদের। গাছটা ছিল এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের। খুব গরিব ছিলেন। দুটো চোখই নষ্ট ছিল। একটা পুরোপুরি নষ্ট, আরেকটা দিয়ে অল্প অল্প দেখতে পেতেন। বই-খাতা একেবারে চোখের সামনে নিয়ে গিয়ে দেখতেন। লেখাপড়া খুব বেশি করেননি, তবে অ আ ক খ-এর ছেলেদের জন্য খুব ভালো শিক্ষক ছিলেন। আমাকেও তিনি পড়িয়েছেন। যখন আমি অনেকটা বড় হয়েছি, তাঁর বেতের আওতার বাইরে চলে গেছি, তখনো প্রায়ই তিনি আসতেন আমাদের বাসায়। বলতেন, তোমার পড়ালেখা কেমন হচ্ছে, দেখতে এলাম। আসলে যে কেন এসেছেন, তা তো আমি জানতাম। আম্মাও জানত। খবর পেলে চা-নাশতা পাঠিয়ে দিত। রান্নাঘরটা আলাদা ছিল, বসার ঘর থেকে বেশ দূরে। আম্মা খবর না পেলে, অপেক্ষা করে করে শেষে উসখুস করে বলেই ফেলতেন, কানা মাস্টার (ওই নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন), ‘কি রে, আম্মা নেই ঘরে? চা-নাশতা তো এখনো পাঠাল না।’
আমিই উঠে যেতাম তখন আম্মাকে খবর দিতে। যা-ই হোক, আসল কথায় আসি।
কাঁঠালগাছে রোজ একপাল ছেলে উঠে অত্যাচার করলে গাছের ক্ষতি হবে, এই আশঙ্কায় লাঠি নিয়ে তেড়ে আসতেন কানা মাস্টার। ও রকম একজন বুড়ো মানুষকে কে পরোয়া করে। আমরাও করতাম না। তিনি একদিক দিয়ে আসতেন, আমরা আরেক দিক দিয়ে ছুটতাম। এরই মাঝে চলত ডালে ওঠা আর পানিতে লাফিয়ে পড়া। কিছুতেই ঠেকাতে পারতেন না তিনি। দারুণ রোমাঞ্চকর হয়ে উঠত আমাদের খেলা। খেলাটা আমাদের কাছে মজার হলেও একজন বৃদ্ধ মানুষের কাছে যে কতটা নিষ্ঠুরতা, তা তখন বুঝতাম না।
একদিন, ও রকম খেলছি। সেদিন আমরা লোক কম। দু-তিনটা ছেলের বেশি হব না। কানা মাস্টারও খবর পাননি। আমাদের খেলা তেমন জমে ওঠেনি। হট্টগোলই যদি না হলো, মজা কিসের?
ওয়ান টু থ্রি বলে একে একে লাফিয়ে পড়ছি আমরা। খাড়া হয়ে পড়ছি। পা সোজা করে নেমে যাচ্ছি অনেক নিচে। মাটি ছোঁয়ার চেষ্টা করছি। পারছি না কিছুতেই। অনেক গভীর ওখানটায়। তা ছাড়া তখন বর্ষাকাল। কানায় কানায় ভরে গেছে দিঘি।
সোজা হয়ে নামার সময় হঠাৎ আমার এক পায়ে কী যেন লাগল। যখন বুঝলাম, তখন আটকে গেছে পা-টা। কিসে যেন ধরেছে! টান দিয়ে ছাড়াতে পারি না।
ভয়ে কেঁপে উঠল বুক। কারণ কিসে ধরেছে, আমি বুঝে ফেলেছি! নিশ্চয় কোনো তামার কলসি। যেগুলোতে সোনার মোহর ভরা থাকে। আর যেগুলো ভুতুড়ে হয়ে যায়। মানুষ, বিশেষ করে ছোটদের পেলে তাদের আটকে নিয়ে মেরে ফেলে। তারপর কলসির যক বানিয়ে রাখে।
পলকে অসংখ্য দৃশ্য খেলে গেল মাথায়। কী করব আন্দাজ করে ফেললাম। মনে পড়ল, দাদির হুঁশিয়ারি, খবরদার, পানিতে বেশি নামবি না। কোন দিন কলসির খপ্পরে পড়বি, তাহলে আর কোনো দিন উঠতে পারবি না। আমি ভাবতাম, আমি যাতে পানিতে বেশি না থাকি, সে জন্য আমাকে ভয় দেখায় দাদি। পাত্তাই দিতাম না। এখন আর দিয়েও লাভ নেই। মরে গিয়ে যক হয়ে অনন্তকাল থেকে যেতে হবে কলসির মধ্যে! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করার চেষ্টা করলাম। পানির নিচে স্বর ফুটল না। মরিয়া হয়ে লড়াই শুরু করলাম কলসির সঙ্গে। ওটা টানে নিচের দিকে, আমি টানি ওপর দিকে। শেষে আমারই জয় হলো। আমার সঙ্গে গায়ের জোরে পারল না কলসি। উঠে এল পায়ের সঙ্গে আটকে থেকে।
পানির ওপর মাথা তুলে চেঁচাতে শুরু করলাম। দেখি, কানা মাস্টার তখন পৌঁছে গেছেন। বেত নিয়ে তাড়া করছেন একটা ছেলেকে। থমকে দাঁড়ালেন তিনি। আমি চেঁচাচ্ছি, কলসে ধরেছে আমাকে, কলসে! তিনি কী বুঝলেন কে জানে, তবে চেঁচাতে শুরু করলেন। লোক ডাকাডাকি শুরু করলেন আমাকে বাঁচানোর জন্য। নিজে তো অক্ষম।
আমাকে তোলা হলো, সেই সঙ্গে কলসিটাও। সবাই তো হেসেই খুন। মোহর-টোহর কিচ্ছু নেই। পানি ভরে ভারী হয়ে গিয়েছিল। বছরখানেক আগে হারিয়ে যাওয়া লাতুর মায়ের কলসি। কী জানি কীভাবে পুকুরে হারিয়ে গিয়েছিল ওটা।
মাথা যখন গরম হয়ে যায় মানুষের, উল্টোপাল্টা কাজ করে বসে। আমারও হয়েছিল সেই অবস্থা। মাথা ঠান্ডা রাখলে কিন্তু আমি সহজেই মুক্তি পেয়ে উঠে আসতে পারতাম। লাফ দেওয়ার সময় পায়ের পাতা ছিল সোজা, আঙুলগুলো নিচের দিকে টানটান করা, ফলে ঢুকতে পেরেছিল কলসির মুখের ভেতর দিয়ে। কিন্তু নামার পর যেই পাতা স্বাভাবিক করেছি, অমনি আটকে গেল ওটা কলসির গলায়। প্রচণ্ড আতঙ্কে চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছিল। নইলে পায়ের পাতা নিচের দিকে করে সহজেই বের করে ফেলতে পারতাম। ভয় অনেক সময় সহজ বিপদ থেকেও বাঁচতে দেয় না মানুষকে।