হাই ভাইরাস! বাই ভাইরাস!

—আমার মোবাইলে ভাইরাস ঢুকেছে।

—বলিস কী?

—হ্যাঁ।

—কী রকম?

—কথা বলছি, মোবাইলে হঠাৎ একটা মেসেজ আসে, ‘ব্যাটারি লো’। তার পরই মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়।

এই কৌতুকটা শুনে সুবল বলল, মোবাইলে ভাইরাস থাকতেই পারে, থাকতে পারে কম্পিউটারে। এ আর নতুন কী?

আমি বললাম, থাকতে পারে মানুষেও। ও বলল, তা তো জানিই। সে যে জানে, এটা প্রমাণের জন্য আমাকে একটা গল্প বলল—

একদিন দুটি দুষ্ট ছেলে মোড়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। পাশ দিয়ে একটা মেয়েকে হেঁটে যেতে দেখে বেশি দুষ্ট ছেলেটি বলে উঠল, ওফ্, মেয়েটাকে দেখেছিস? একেবারে ডিভিডি প্রিন্ট!

মেয়েটি রেগে গিয়ে বলল, সিআইএইচ ভাইরাস কোথাকার! তোদের ঘরে কি মাদারবোর্ড নেই?

তখন অপর ছেলেটি ভয় পেয়ে বলে উঠল, এ তো দেখি পুরাই নর্টন অ্যান্টি-ভাইরাস! চল, জলদি রিবুট করি!

আমি বললাম, দেখ হাবল, আসলেই মানুষের শরীরে কিন্তু অনেক ভাইরাস থাকে, ফাইজলামি না।

ভাইরাস ছোট বলে আমরা খালি চোখে দেখি না।

কেন দেখা যাবে না? থ্রি ইডিয়টস সিনেমায় ভাইরাসকে আমি নিজ চোখে দেখেছি।

না, এই ছেলেকে নিয়ে পারা যাবে না। আমি বরং তোমাদেরই বলি, শোনো, এই মুহূর্তে কেবল তোমার পেটেই কমপক্ষে ২০ ধরনের ভাইরাস বসে আছে। শুনে আঁতকে উঠলে নাকি? না, ভয়ের কোনো কারণ নেই। এরা তোমার শরীরের খুব ভালো বন্ধু, এদের ছাড়া এমনকি তুমি খাওয়া পর্যন্ত হজম করতে পারবে না! এদের বলে নরমা ফ্লোরা।

তাই বলে সব ভাইরাসই তো আর তোমার বন্ধু না। এই যেমন ইবোলা ভাইরাসের কথাই ধরো না কেন। ইবোলা ভাইরাস যে রোগটির কারণ, তার নাম ইবোলা ভাইরাস ডিজিস (EVD), যা AIDS-এর চেয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।

ও হ্যাঁ, এইডসও কিন্তু ভাইরাল ডিজিজ। যেটা বলছিলাম, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ইবোলার প্রাদুর্ভাব দেখা যাওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। ইতিমধ্যেই এটি পাকিস্তান, আফ্রিকা, সিয়েরা লিওন, গিনি ও নাইজেরিয়ার মতো দেশগুলোতে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। ইবোলা আগে রক্তক্ষরণকারী জ্বর হিসেবে পরিচিত ছিল।

ঊউঠ রোগের প্রাদুর্ভাব প্রথম দেখা যায় ১৯৭৬ সালে। একই সঙ্গে নাইজেরিয়া, সুদান, ইয়াম্বুকু ও রিপাবলিকান কঙ্গোর ইবোলা নদীর ধারে অবস্থিত একটি গ্রামে মহামারি আকার ধারণ করে। এই ইবোলা নদীর নামেই এই ভাইরাসের নাম রাখা হয়েছে Ebola।

ফলভোজী বাদুড় মূলত এই রোগের প্রধান প্রাকৃতিক বাহক হিসেবে চিহ্নিত হলেও বাহক হিসেবে বনের শিম্পাঞ্জি, গরিলা ও শূকরের গুরুত্ব এড়ানো যাবে না।

এই ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের রক্ত, লালা বা যেকোনো নিঃসৃত রস থেকে ও শরীরের ক্ষতস্থানের মধ্য দিয়ে আরেকজনের শরীরে ছড়ায়।

বাংলাদেশের জন্যও এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, পশ্চিম আফ্রিকার লাইবেরিয়া ও সিয়েরা লিওনে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত আছেন প্রায় ৮০০ বাঙালি। গিনি ও নাইজেরিয়ায়ও কোনো বাংলাদেশি অভিবাসী নেই, এটা বলা যায় না। তাঁরা নিজেরা যেমন ইবোলার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, তেমনি তাঁদের কারও দেহে ভাইরাসটি প্রবেশের পর তিনি দেশে ফিরলে এখানেও ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। তবে আশার কথা, বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা এ নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। সীমান্ত এলাকায়, বন্দর এলাকায় মেডিকেল টিম বসানো হয়েছে। আমরা সভা-সেমিনার করছি।

সাংবাদিকেরা একে গুরুত্ব দিয়ে দেখার তাড়না তৈরি করছেন। ফলে, জনগণ ও সরকারকে সোচ্চার হতে হচ্ছে।

ইদানীং আবার বেশ জোরেশোরেই শোনা যাচ্ছে মার্সের কথা। না, আমি মঙ্গল গ্রহের কথা বলছি না। বলছি, মার্স ভাইরাসের কথা! এটি একটি ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ, যা মূলত আমাদের শ্বাসতন্ত্রে প্রদাহ তৈরি করে। ২০১২ সালে সর্বপ্রথম সৌদি আরবে এই রোগ ধরা পড়ে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশসহ ২২টিরও বেশি দেশে এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। সামনেই হজের মৌসুম। নিশ্চয়ই তোমার অনেক আত্মীয়স্বজন যাচ্ছেন সৌদি আরবে, কাজের সূত্রেও অনেকে সেসব দেশে যাচ্ছেন! তাঁদের বিদায় জানাতে গিয়ে তোমরা কিছু ডাক্তারি করতেই পারো। এই যেমন তাঁদের পইপই করে বলে দেবে, আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলার কথা ! বলতে পারো উটের মাংস ও দুধ পরিহার করার কথা। নিষেধ করতে পারো, যেন সম্ভব হলে উটজাত যেকোনো পণ্যও তাঁরা পরিহার করেন। এমনকি যথাযথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (মাস্ক, গ্লাভস) ছাড়া উটের কাছে না যাওয়ার কথাও বলতে ভুলবে না।

আর তুমি নিজে যেটা করবে, সেটা হলো সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যফেরত কোনো ব্যক্তি সর্দিজ্বরে আক্রান্ত জেনে থাকলে তিনি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে এড়িয়ে চলতে পারো! আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করার সময় মাস্ক ব্যবহার করতে পারো এবং সাক্ষাতের শেষে হাত-মুখ ভালো করে ধুয়ে ফেলো, ব্যস! আর হ্যাঁ, একজনের মাস্ক আরেকজন কখনোই ব্যবহার করবে না। মাস্ক ব্যবহারে মা-বাবা, ভাইবোনকেও ব্যবহারে উৎসাহিত করতে পারো। বলবে, দেখো, মাস্ক ব্যবহার করলে রাস্তায় পাওনাদারেরাও চিনতে পারবে না, জ্বালাতেও পারবে না! ডাক্তারেরা যেমন অপারেশনের সময় মাস্ক পরেন, যাতে রোগী চিনতে না পারে, কে তার শরীরে ছুরি বসিয়েছে। তেমন আরকি!

ছোটবেলায় এ বি সি ডি ই-এর কথা বললে প্রশ্ন জাগত, বড় হাতের নাকি ছোট হাতের। আর এখন প্রশ্ন জাগে, লিভারের রোগ না তো? হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই—এই পাঁচটি ভাইরাস আমাদের প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফিরছে। শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমে জন্ডিসের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস ই ভাইরাস। বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা ৪ দশমিক ৪ থেকে ৭ দশমিক ৮ ভাগ লোক দেহে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের জীবাণু বহন করে। সারা বিশ্বে প্রায় ১৮০ মিলিয়ন লোক হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে ১ শতাংশ লোকের দেহে সি ভাইরাসের জীবাণু রয়েছে।

হেপাটাইটিস বি ও সি মূলত রক্তরস, দূষিত সিরিঞ্জ, খতনা, নাপিতের খুর কিংবা মায়ের দেহে থাকলে শিশুর দেহেও ছড়ায়। তাই প্রয়োজন ছাড়া ইনজেকশন নেবে না। যেখানে সেখানে পানি ও খাবার খাবে না। ব্যস, তাহলেই তুমি কঠিন কঠিন এসব ভাইরাসের আক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। এখন আসো সাধারণ ভাইরাসের কথায়, লোকে এদের আক্রমণকে ফ্লু বলে! জ্বর, ঠান্ডা-কাশি, শরীর ম্যাজ-ম্যাজ করা বা ব্যথা হলেই যে চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠতে হবে তা নয়। যা ওষুধ খেলে সাত দিনে কমবে, না খেলে এক সপ্তাহে! এই তো। কম্পিউটারে ভাইরাস আছে শুনেই যেমন হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক লাগিয়ে কম্পিউটার ব্যবহারের দরকার নেই, তেমনি সাধারণ ফ্লুতেও অস্থির হওয়াটাও খুব একটা কাজের কথা না! বিশ্রাম নেবে, পুষ্টিকর খাবার খাবে, ওতেই হয়ে যাবে। কথায় কথায় অ্যান্টিবায়োটিক খাবে না, খাওয়ার মতো আরও অনেক কিছু এই দুনিয়ায় আছে, তাই না? আর এইডস, হেপাটাইটিসের মতো ভাইরাল রোগকেও তুমি ভয় পাবে না। কেননা, তোমার জীবনযাপন সুন্দর, তুমি অনৈতিক, অসামাজিক আর অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনকে ঘৃণা করো।

এক ভদ্রলোক ট্রেনে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলেন দেখে পাশেরজন তাঁকে জাগিয়ে দিলেন।

—এই যে মশাই উঠুন।

—কেন, কী হলো?

—আপনি নাক ডাকছিলেন।

—কে বলল?

—আমি নিজের কানে শুনলাম।

—ওই সব শোনা কথায় বিশ্বাস করবেন না।

বলে ফের ঘুমিয়ে পড়লেন।

এভাবে আমার কথাগুলো শুনে শোনা কথা বলে উড়িয়ে দিয়ো না কিন্তু, বিপদ তোমারই!

(কিশোর আলোর সেপ্টেম্বর ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)