প্রিয় মনোবন্ধু,
২০০৮ সালের কথা, আমি তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। অর্ধবার্ষিকীর ছুটি চলছে। এক রাতে মা তাঁর ছোটবেলার গল্প বলছিলেন। গল্প শেষে হঠাৎ বললেন, ‘সব স্মৃতি যেন মুছে যাচ্ছে।’ এ কথা শুনে হঠাৎ ধাক্কা লাগল। মনে হলো, সত্যিই তো, আগের মতো এখন আর কিছুই নেই। না আছে খোলা মাঠ, না আছে ছোটদের স্বাধীনতা। আস্তে আস্তে এটা কষ্ট দিতে শুরু করল। এমনকি জলবায়ুও পরিবর্তন হচ্ছে, যা একেবারে ঠিক না। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কী যেন অস্থির করে তুলছে আমাকে। কিছু ভালো লাগত না। খুব একা লাগত। কান্না পেত সারাক্ষণ। মাকে বলতাম, বোঝাতাম। ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও মা বুঝতেন না, রাগারাগি করতেন।
একসময় নানা ব্যস্ততায় ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিলাম। বর্তমানে এমনই একটা সমস্যায় পড়েছি আমি। খালাতো বোনের বাসায় বেড়াতে গিয়ে একটা কার্টুন সম্পর্কে জেনে সেটা দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ি। দেখার পর আমার আরও ভালো লাগে। আমি ঠিক করি শেষ পর্যন্ত দেখব। ইন্টারনেটে দেখতাম ওটা। একটা পর্ব দেখার পর ইচ্ছা করত আরেকটা দেখি। দু–এক দিনের মধ্যে আমি এর নেশায় পড়ে যাই। কিছুক্ষণ না দেখলেই অস্থির লাগে। এই অস্থিরতা কাউকে দেখাতে পারতাম না। নিজেকে ঘরে বন্দী করে রাখতাম। তাতে আরও অস্থির লাগত আমার। কান্নাকাটি করতাম। মাকে বলতাম, যথারীতি মা বুঝতেন না, রাগারাগি করতেন। তাই কষ্ট পেতাম আরও। দয়া করে আমাকে এর সমাধান দিন। আমি আর পারছি না।
উত্তর: কোনো একটি বিশেষ চিন্তা তোমার মাথায় ঢুকলে তুমি সেটা নিয়েই ভাবতে থাকো। এটা তোমার সংবেদনশীলতার প্রকাশ। আবার তুমি একটা কার্টুন দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ো, না দেখলে অস্থির লাগে এবং সেটার নেশায় পড়ে যাও। এই অতিসংবেদনশীলতা, একই চিন্তা মনের মধ্যে বারবার আসা এবং একই কাজ করার জন্য ব্যাকুল বা অস্থির হয়ে পড়া একধরনের বাধ্যতাধর্মী চিন্তা আর আচরণ। সাইকিয়াট্রির ভাষায় এটা অবসেশন কম্পালশন ডিসঅর্ডারের লক্ষণ। কিন্তু তুমি সত্যিই এই অবসেশন কম্পালশন সমস্যায় ভুগছ কি না, জানার জন্য অবশ্যই তোমাকে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। তোমার মা যেহেতু ডাক্তার, তাই তাঁকে বুঝিয়ে বলো। তিনি নিশ্চয়ই তোমাকে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাবেন। আর হ্যাঁ, নিজেকে ঘরে বন্দী রাখা বা কান্নাকাটি করা কোনো সমাধান নয়। সব সময় আনন্দে থাকার চেষ্টা করো, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাও, বই পড়ো, গান শোনো এবং নিয়মিত কিআ পড়ো।
প্রিয় মনোবন্ধু,
আমার সমস্যাটা সম্ভবত দুই-তিন বছর আগে থেকে শুরু হয়েছে। আমি একসময় লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিলাম। ডাক্তার হতে চাইতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার মানসিক পরিবর্তন হয়। আর আমি পার্থিব জীবন জিনিসটা এখন বুঝতে পারি না। পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে কষ্ট হয়। শুধু পদার্থবিজ্ঞান আর জীববিজ্ঞান ছাড়া অন্য সব বিষয় পড়াকে অপ্রয়োজনীয় মনে হয় আমার। বলতে গেলে ওই বিষয়গুলো পড়ায় মনোযোগ বেশি দিলেও পরীক্ষার সময় লিখতে ইচ্ছা করে না। বিষয়গুলো পছন্দ করি না, তা নয়। একসময় এই বিষয়গুলোতে খুব ভালো নম্বর পেতাম, তবে এখন পাই না।
অন্য সবার ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছা থাকে, কিন্তু আমার তেমন কোনো ইচ্ছা নেই। আমি গান গাইতে পারি, গল্প–কবিতা লিখতে পারি। নিজেকে প্রকাশ করার কথা ভাবি, কিন্তু পারি না। বড় হয়ে প্রিয় বিষয়গুলো নিয়ে থাকতে চাই আমি। কিন্তু মা-বাবার মুখ দেখে মনে হয় পড়তে হবে, কিছু একটা করে দেখাতে হবে। আবার এই ভাবনায় কাজ করতে গেলে আমার পৃথিবী ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করে। ক্লাসের সবাই বলে আমি খুব ইউনিক। অন্যদের যা ভালো লাগে, আমার তা ভালো লাগে না। সব সময় ভাবনার মধ্যে ডুবে থাকি, পার্থিব কোনো জিনিস নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে না। মাঝেমধ্যে মনে হয়, মাথার কোনো রোগ আছে। কারণ, প্রায়ই অপছন্দের কোনো বিষয় নিয়ে ভাবলে বা করলে আমার মাথা ব্যথা করে। আর তখন কোনো লেখা আবছাভাবে দেখি। সামনে আমার এসএসসি পরীক্ষা। এই রোগটা থেকে আমি নিস্তার পেতে চাই।
দশম শ্রেণি, ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়
উত্তর: তোমার ভাবনাগুলো খুব সুন্দর এবং অনবদ্য। কিন্তু তোমার পৃথিবী ছেড়ে দেওয়ার ভাবনাটি মোটেই সঠিক নয়। তুমি বাঁচবে তোমার নিজের জন্য। তোমার যা করতে ভালো লাগে, সেটিই খুব মন দিয়ে করবে। তোমার যদি পদার্থবিজ্ঞান বা জীববিজ্ঞান ভালো লাগে, তবে সেগুলো খুব মন দিয়ে পড়ো। ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার চেয়ে একজন বড় বিজ্ঞানী কোনো অংশেই কম নয়। আর অপছন্দের বিষয় নিয়ে না ভেবে পছন্দের বিষয় বেশি করে ভাবো। তুমি যদি বড় হয়ে নিজের প্রিয় বিষয়গুলো নিয়ে থাকতে চাও, তবে তোমোকে প্রস্তুত হতে হবে। তুমি আগে তোমার প্রিয় বিষয়গুলোর একটা তালিকা তৈরি করো। তোমার বয়স আর সক্ষমতা অনুযায়ী সেগুলোর চর্চা তুমি করতে পারো। তবে যেকোনো কিছু চর্চা করার জন্য ন্যূনতম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন আছে। তাই প্রিয় বিষয়গুলোকে কাছে পেতে চাইলে, সেগুলোর ওপর দক্ষ হতে চাইলে তোমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাহায্য লাগবেই। তাই সামনে তোমার এসএসসি পরীক্ষার জন্য নিজেকে তৈরি করো—ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য নয়, জিপিএ–৫ পাওয়ার জন্য নয়, তোমার পছন্দের বিষয়ে দক্ষ হওয়ার জন্য তুমি মন দিয়ে এসএসসি পরীক্ষা দাও। মাথাব্যথার জন্য তুমি প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম, রিলাক্সেশন থেরাপি (ইউটিউব থেকে দেখে নিতে পারো) ইত্যাদি করতে পারো। তোমার জন্য শুভকামনা।
এই বিভাগে তোমরা তোমাদের মানসিক নানা সমস্যা, যা তোমার শিক্ষক, মা-বাবা বা অন্য কাউকে বলতে পারছ না, তা আমাদের লিখে পাঠাও। পাঠানোর ঠিকানা—মনোবন্ধু, কিশোর আলো, ১৯ কারওয়ান বাজার, ঢাকা। ইমেইলে পাঠাতে হলে সাবজেক্টে লিখবে - ‘মনোবন্ধু’, তারপর তোমার সমস্যাটি ইউনিকোড ফরম্যাটে লিখে পেস্ট করে দেবে মেইলের বডিতে। নাম, বয়স লিখতে ভুলবে না। তোমার সমস্যা বোঝার ক্ষেত্রে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ।