সংগীত, কবিত্ব আর ল্যাজ (লেজ) কারও ভেতরে থাকলে, সেটি নাকি ভেতরে আটকে রাখা যায় না। কোনো না কোনোভাবে সেটি বেরিয়ে এসে সবাইকে জানান দেবে তার অস্তিত্ব। কথাটা অনেক আগে বলেছিলেন প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক। তাও এলেবেলে কাউকে নয়, বলেছিলেন সাক্ষাৎ লেখক শিবরাম চক্রবর্তী ওরফে শিব্রাম চক্কোত্তিকে। শিবরামের তখন একেবারেই কচি বয়স। কিন্তু তখন থেকেই তাঁর ভেতরে সব সময় কিছু একটা লেখার ইচ্ছা ভুড়ভুড়ি কেটে উঠতে শুরু করেছে। সেই জ্বালা সহ্য করতে না পেরে একদিন তিনি লিখেও ফেললেন একটা কবিতা। সেটি টাটকা থাকতে থাকতেই পাঠিয়ে দিলেন সে সময়ের নামকরা প্রবাসী পত্রিকায়। নিজের আত্মজীবনী ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা’তে এ কথা জানিয়েছেন শিবরাম।
কিন্তু সেই কবিতাটি পত্রিকায় না ছাপিয়ে সরাসরি শিবরামের কাছে ফেরত পাঠালেন সম্পাদক। সঙ্গে উপদেশে ভরা এক চিঠি। তাতে লেখা, ‘সংগীত, কবিত্ব আর ল্যাজ কারও ভেতরে থাকলে, তা আটকে রাখা যায় না। তোমার মধ্যে যদি সেটি থাকে, প্রকাশ পাবেই। যথাকালে দেখা দেবেই। অযথা জোর করে অসময়ে তাকে টানাটানি করে বার করার কোনো দরকার নেই।’
সম্পাদকের কাছ থেকে এই মর্মান্তিক উপদেশ শুনে (মানে পড়ে) শুরুতে বেশ দমে গিয়েছিলেন শিবরাম। লজ্জা-অপমান নাকি রাগ-অভিমানে অনেক দিন লেখালেখি থেকে দূরে দূরেই ছিলেন। শেষে পরিণত বয়সে একবার এক নাছোড়বান্দা কাবুলিওয়ালার ঋণের টাকা শোধ করতে গিয়ে আবারও হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম। এভাবেই শুরু। সত্যিই যথাকালেই দেখা গিয়েছিল তাঁর ভেতরেই সেই প্রতিভা। লেজের মতোই তাঁকেও নিজের ভেতরে আটকে রাখা কোনোমতেই সম্ভব হয়নি শিবরাম চক্রবর্তীর পক্ষে। এর পর থেকেই তাঁর সেই অবিনাশী কলম থেকে বের হতে থাকে মজার মজার রাশি রাশি গল্প, উপন্যাস, কবিতা আরও কত কী! এভাবেই একদিন হঠাৎ করেই শিব্রাম চক্কোত্তির মাথায় পাঠকেরা পরিয়ে দিতে বাধ্য হন হাসিসম্রাটের মুকুট।
বিচিত্র এক জীবন ছিল তাঁর। জেল খেটেছেন, রাস্তায় কাগজ ফেরি করেছেন, বাড়ি থেকে পালিয়ে ফুটপাতে রাত কাটিয়েছেন। রাজনীতি করেছেন, করছেন সাংবাদিকতাও। আর চিরকুমার পুরো জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন মেসে। তাঁর জীবনের সঙ্গে অনেকটা মিল পাওয়া যায় মার্কিন লেখক জ্যাক লন্ডনের সঙ্গে। তবে আরেক মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েনকে মেনে নিয়েছিলেন গুরু হিসেবে। তাই টোয়েনের মতোই তাঁর লেখাতেও রম্য আর রসের ছড়াছড়ি।
শোনা যায়, নানা ধরনের রসাল মিষ্টি খেতে খুবই পছন্দ করতেন শিবরাম চক্রবর্তী। রাবরি, রসগোল্লা, চমচম এসব আরকি। আর তার খাইখরচ মেটাতেও হাতের ওই সবেধন নীলমণি কলমকেই কাজে লাগিয়েছেন তিনি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তিনি যেমন রসাল মিষ্টি ভালোবাসতেন, তেমনি পাঠককেও তিনি ঠকাননি। তাঁর গল্প মানেই রসে একেবারে টইটম্বুর অবস্থা। ওই রাবরি, রসগোল্লা, চমচমের মতোই মজাদার। তাই যারা একটু সিরিয়াস পাঠক, তাদের শিবরামের কাছেপিঠে না ঘেঁষাই মঙ্গলজনক। তবে যারা গল্প পড়ে পেট পুরে হাসতে চাও, তাদের জন্য শিবরাম অবশ্যপাঠ্য।
শিবরামের একগাদা গল্প থেকে সেরা গল্পগুলো বাছাই করেছেন লেখক ও সম্পাদক আবদুর শাকুর। একেকটি গল্প একেক স্বাদের। তবে সবগুলোর বিশেষত্বই হচ্ছে, সেগুলো পড়ে না হেসে পারবে না। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত বইটির চমৎকার প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ। যারা হাসিসম্রাট শিবরামকে জানতে চাও, তারা একবার বইটি পরখ করে দেখতে পারো। একঝাঁক অনাবিল আনন্দের গ্যারান্টি রইল।