কিশোর আলোর সবাই জানে যে আমার বাসাভর্তি বই। আর এ-ও জানে যে আমার সাড়ে তিন ফুটি ছেলে লাঠি হাতে বাবার বই পাহারা দেয়। কেউ বইয়ের দিকে হাত বাড়ানো তো দূরের কথা, চোখ তুলে তাকালেই ঠান্ডা গলায় হুমকি দেয়—মারব কিন্তু ঘুষি; কত্ত বড় সাহস, আমার বাবার বইয়ের দিকে তাকাও!
একমাত্র ব্যতিক্রম আমাদেরই প্রতিবেশী টুনটুনি। আসল নাম আনুশকা। আদর করে ওকে টুনটুনি ডাকি আমরা। আনুশকা পড়ে ক্লাস সিক্সে। বইয়ের পোকা। তাই কায়দা করে ঠিকই চকলেট-টকলেট দিয়ে সাড়ে তিন ফুটিকে হাত করে ফেলেছে। আমার বইয়ের স্তূপে তার অবারিত হস্তক্ষেপ। তো, ওই টুনটুনিই সেদিন অভিযোগের সুরে বলল, ‘শোনো আংকেল, তোমরা লেখকেরা বড্ড পচা। যত গল্প লেখো সবেতেই নায়ক হয় ছেলেরা! এটা কোনো কথা হলো! মেয়েদের নিয়ে গল্প লেখো না কেন তোমরা?’ আমি আমতা আমতা করে বলি, ‘আসলে আমরা যারা ছেলে লেখক, তারা তো ছেলেদের কথাই ভালোমতো জানি, তাই হয়তো মেয়েদের কথা কম আসে।’
‘উঁহু’, রাজি হয় না টুনটুনি। ‘আমি মেয়ে লেখকদের লেখাও পড়ে দেখেছি। ওখানেও বেশির ভাগ সময় নায়ক ছেলেরাই!’
তখন কোনোমতে ওকে উল্টাপাল্টা কিছু একটা বুঝিয়ে দিলেও পরে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখেছি, বইয়ের জগতে ছেলে চরিত্রের তুলনায় মেয়ে চরিত্র আসলেই কম। পার্শ্বচরিত্র হিসেবে মেয়েরা এলেও প্রধান চরিত্র হিসেবে কমই আছে তাদের আনাগোনা। মানতেই হয়, লেখকদেরও বড় একচোখা নীতি! দুনিয়ার অর্ধেক মানুষ যেখানে মেয়ে, সেখানে বইয়ের প্রধান চরিত্র হিসেবে মেয়েদের সংখ্যা কম হবে কেন?
তবে একেবারেই যে নেই, তা নয়। যেমন আমাদের সবার ভারি প্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের মেয়েপ্রধান বই অনেক। এমনকি আমাদের টুনটুনির নামেও রয়েছে তার এক চরিত্র ‘টুনটুনি’। তোমরা তো জানোই, কারণ টুনটুনি আর ছোটাচ্চুর অভিযানের গল্পগুলো শুরু হয়েছিল কিশোর আলোতেই। টুনটুনি ও ছোটাচ্চু, আবারো টুনটুনি ও আবারো ছোটাচ্চু, আরও টুনটুনি আরও ছোটাচ্চু এমন আরও বই আছে প্রিয় এই লেখকের। মুহম্মদ জাফর ইকবালের রাশা, বৃষ্টির ঠিকানা, সায়েরা সায়েন্টিস্ট, নিতু ও তার বন্ধুরা, বকুলাপ্পু, নায়ীরা, শান্তা পারিবার, আঁখি এবং আমরা ক’জন এমন কয়েকটি বইয়ের প্রধান চরিত্র হিসেবে হাজির হয়েছে মেয়েরা।
খুব মমতায় মেয়েদের প্রধান চরিত্র করে লিখেছেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদও। মেয়ে চরিত্র প্রধান করে বড়দের জন্য রচনা করেছেন বিস্তর উপন্যাস। যখন সময় হবে তখন খুঁজে খুঁজে পড়ে ফেলো বইগুলো। আমি কোনো নাম বলে দেব না। খোঁজার দায়িত্ব তোমাদের। একই রকম কথা খাটে লেখক আনিসুল হক এবং ইমদাদুল হক মিলনের ক্ষেত্রেও; মেয়েপ্রধান লেখা তাঁদেরও অনেক।
আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক সেলিনা হোসেনের ছোট্ট বই কুড়কুড়ির মুক্তিযুদ্ধ বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। তানজিনা হোসেনের খুব সম্প্রতি বেরোনো এলিনাও ভালো লাগবে। শাহরিয়ারের গ্রাফিক নভেল লাইলীর দুটি খণ্ড বেরিয়ে গেছে, দারুণ মজার এই বই দুখানা। মনে পড়ছে শাহরিয়ার কবিরের রত্নেশ্বরীর কালো ছায়া বইটির কথাও। রত্নেশ্বরীর কালো ছায়ার তানিয়ার কথা ভোলা খুব দায়। খুব সম্প্রতি কিশোর আলোতেই রকিব হাসান শুরু করেছেন নতুন গোয়েন্দা সিরিজ ‘তিন কন্যা’। জারা-সারা-লরা প্রধান তিন চরিত্র। এই সিরিজের দুটো কিস্তি তো বেরোল, দেখা যাক কাহিনি কত দূর গড়ায়।
লেখক সুচিত্রা ভট্টাচার্য তাঁর নারী গোয়েন্দা চরিত্র প্রজ্ঞাপারমিতা তথা মিতিনমাসি নিয়ে লিখে ফেলেছিলেন জমজমাট অনেক কাহিনি। তাঁর এই চরিত্র সম্পর্কে লেখক লিখেছেন, ‘আমি মিতিনকে...আজকালকার দিনের একজন শিক্ষিতা বুদ্ধিমতী সাহসী অথচ ঘরোয়া গৃহবধূ হিসেবেই সৃষ্টি করেছি সাধ্যমতো। যে কি না ছেলেকে হোমটাচও করায়, প্রয়োজনে রান্নাবান্নাও করে আবার ব্যাগে রিভলবার পুরে খুনে-বদমাশদের ধাওয়াও করে অনায়াসে...।’ আফসোস, অনন্য এই চরিত্রটির স্রষ্টা হঠাত্ করেই হারিয়ে গেলেন ২০১৫ সালে।
লরা ইঙ্গলস ওয়াইলডারের ক্লাসিক সৃষ্টি তাঁর শৈশব-কৈশোরের বেড়ে ওঠাভিত্তিক অনবদ্য লিটল হাউস সিরিজ। এই সিরিজে মোট ৮টা বই (নবম বইটা অসমাপ্ত আকারে বের হয় তাঁর মৃত্যুর পর) ইংরেজিতে তো বটেই, বাংলা অনুবাদেও সহজলভ্য। জার্মান লেখক এরিখ্ কাস্টনারের বই দাগ ডপেটে লোটকেন অর্থাত্ ‘একজোড়া লোটি’, ইংরেজিতে লোটি অ্যান্ড লিসা, বাংলায় লোটি ও লিসা। জন্মের সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দুই যমজ বোন কীভাবে পরে এক সামার ক্যাম্পে মিলিত হয়, তার মনোহর গল্প এটি।
মনে পড়ছে শার্লট ব্রন্টির জেন আয়ার লুইসা মে অ্যালকটের লিটল উইমেন ‘উইলিয়াম মেকিপস থ্যাকারের ভ্যানিটি ফেয়ার-এর কথা। চিরায়ত এই উপন্যাসগুলো ঠিক শিশু-কিশোর উপযোগী না হলেও এগুলোর কিশোর সংস্করণ যেমন সহজলভ্য, তেমনি অবশ্যপাঠ্যও। গোয়েন্দা সম্রাজ্ঞী আগাথা ক্রিস্টির অনন্য গোয়েন্দা চরিত্র মিজ্ মার্পালকে নিয়ে রয়েছে ১২টি অনবদ্য উপন্যাস, ২০টি গল্প।
টুনটুনির রাগ ভাঙানোর জন্য মেয়ে চরিত্রপ্রধান বইপত্রের নাম খুঁজছি বসে বসে। আর কোনো নাম মনে পড়ছে তোমার? পড়লে জানিয়ো, কেমন? আমি একটু মনোযোগ দিয়ে খুঁজি।