ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।
সম্ভবত পিতারা বিছানায় জায়গা না পেয়ে শিশুদের অন্তরেই শয্যা পেতেছে। এখন তুমি বলো, শিশুর পিতারাই যদি ঘুমিয়ে থাকে, তাহলে শিশুরা আর কী-ই বা করবে?
কী আর করবে? ঘুমাবে।
আজকের যে শিশু সেই না আগামীর পিতা, তার কি ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলে চলবে? তুমি নিশ্চয়ই বলতে পারো, আমি তো দিনে মাত্র আট থেকে নয় ঘণ্টা ঘুমাই। এ আর এমন কী ঘটনা? আসলেই কি এটা এমন কোনো ঘটনা না? মনে করো তোমার বয়স ১৫ বছর। তোমার হিসাবে তুমি কিন্তু ইতিমধ্যেই পাঁচ থেকে ছয় বছর কাটিয়ে দিয়েছ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। ধরো তুমি ৯০ বছর বাঁচবে। সে হিসাবে তোমার জীবনের ৩০-এরও বেশি বছর কেটে যাবে শুধু ঘুমের মধ্যে। ব্যাপারটা কি মেনে নিতে একটুও কষ্ট হচ্ছে না, বলো? ৯০ বছরের বাকি যে ৬০ বছর জেগে থাকবে, তার মধ্যে নিজের জন্মদিন পালন, বন্ধুদের জন্মদিন পালন, বিয়ে করা, বিয়ে খাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিকে যাওয়া, পাড়ার মাঠে ম্যাচ খেলতে যাওয়া, নানা অনুষ্ঠান পালন করা, অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে-বসে কাটানো, বোনের বাড়িতে ঘুরতে যাওয়া, মামাবাড়িতে আম কুড়াতে যাওয়া—এতসব করে তোমার জীবনে বড় হয়ে ওঠার জন্য কটা বছরই বা বরাদ্দ থাকে। তুমিই বলো, তোমার নোবেল পাওয়ার পরিকল্পনার কী হবে? কিংবা কী হবে তোমার অস্কার জেতার স্বপ্নের?
সামাজিকতায় ঘাটতি রাখা তো আর চলে না কিংবা চলে না মামাবাড়ির আম কুড়ানোর সুখ থেকে বঞ্চিত হওয়াও। তাহলে কী করা যায়? যা করা যায় তা হলো, নিজের জীবনটাকে স্বপ্নের সমান বড় করে তুলতে বাড়তি সময় দেওয়া যায়। আর এই বাড়তি সময়টাকে কিন্তু ছিনিয়ে আনতে হবে বজ্জাত ঘুমকুমারের কাছ থেকেই।
কম ঘুম শরীরের পক্ষে একেবারেই ভালো নয়, বিশেষ করে হূদ্যন্ত্রের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ কথা আগে থেকেই জানা ছিল। কিন্তু নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত ঘুমও স্বাস্থ্যের জন্য সমান খারাপ। তাই, সামঞ্জস্যপূর্ণ ঘুম শরীরের জন্য অত্যন্ত দরকার। মনে করে দেখো, ছোটবেলায় তোমাকে কিন্তু তোমার বাবা-মা ‘ক্যাফেইন’ বলে ডাকতেন। কফিতে থাকা ক্যাফেইন যেমন ঘুমাতে বাধা দেয়, তুমিও তেমনি তোমার বাবা-মাকে জাগিয়ে রাখতে। অথচ সেই তুমিই কিনা আজ অতিরিক্ত ঘুমে কাতর।
এটুকু শুনে আদিল বলল, আমার তো উলটো ঘুমহীনতা রোগ আছে। আমি বললাম, কী করে বুঝলে? ও বলল, সহজেই বোঝা যায়। আমাদের স্কুলের সবচেয়ে বোরিং ক্লাসে বেশির ভাগ ছাত্র যখন ঘুমায়, তখনো আমি জেগে থাকি!
সম্প্রতি প্রায় ৫০ হাজার ব্যক্তির ওপর গবেষণা করে দেখা গেছে, অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঘুম মানুষের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। মার্কিন বক্সার জর্জ ফোরম্যান বলেছিলেন, স্কুলে সফল হওয়ার ক্ষেত্রে আমার একটাই বাধা ছিল, আর সেটি হলো ঘুম। আমার স্কুলটা যদি সকাল-সকাল শুরু না হয়ে বিকেল চারটায় শুরু হতো, তাহলে এত দিনে আমি স্কুলটা পাস করে যেতাম।
চেচিন্সকির মতো তুমিও বলতে পারো, স্বপ্নে দেখলাম যে আমি একটা বোরিং বক্তৃতার অনুষ্ঠানে আছি আর জেগে দেখি সত্যিই আমি বোরিং বক্তৃতার অনুষ্ঠানটাতেই আছি। এ ঘটনার চেয়ে খারাপ আর মাত্র একটা ঘটনাই ঘটতে পারে, তা হলো, আমি একটা বোরিং বক্তৃতার অনুষ্ঠানে আছি, কিন্তু আমি ঘুমাতে পারছি না।
হায়রে ঘুম!
আমেরিকান কমেডিয়ান স্টিভেন রাইটের কাছ থেকেই জানা গেল, তিনি নাকি একদিন একটা স্যাটেলাইট ডিশে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এটা সমস্যা নয়, সমস্যা হলো, তাঁর ঘুমের সময় দেখা স্বপ্নটা টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়ে গেছে।
বুঝতেই পারছ, মাত্রাতিরিক্ত ঘুম মানুষের জন্য তেমন একটা সুখকর নয়। এখন প্রশ্ন হলো, একজন মানুষের ঘুমের মাত্রা কতটুকু? বিখ্যাত টাইপোগ্রাফার ম্যাক্স কফমেন বলতেন, গড় মানুষের জন্য যে পরিমাণ ঘুম প্রয়োজন তা হলো, ... আর পাঁচ মিনিট! এটা অবশ্য তিনি মজা করে বলতেন। কিন্তু আসল কথা হলো, মানুষের বয়স, শারীরিক পরিশ্রম, জীবন যাপন, স্বাস্থ্য ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে মানুষের ঘুমের সময় কম-বেশি হতে পারে। তবে গড়পড়তায় একজন মানুষের সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমই যথেষ্ট। এর চেয়ে অতিরিক্ত ঘুম হওয়াটা একধরনের রোগ, যার নাম হাইপারসমনিয়া। হাইপারসমনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা খুব বেশি অলস হয়ে যায়, কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তাদের মেজাজও খিটখিটে হয়ে যায়। অতিরিক্ত ঘুম ডায়াবেটিস, স্থূলতা, মাথা ও শরীর ব্যথা এমনকি হতাশারও অন্যতম কারণ। এ ছাড়া অতিরিক্ত ঘুম হার্টের অসুখ, ব্লাড প্রেশার ও রক্তের কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দেয়। জরিপ বলে, হাইপারসমনিয়া দেহের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও কমিয়ে দেয়।
আমাদের অনেকেরই অভ্যাস হয়ে গেছে দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা আর রাতে দেরিতে ঘুমাতে যাওয়ার। ঘুম বিষয়ে বের হওয়া জার্নাল স্লিপ-এর গবেষকেরা জানিয়েছেন, দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার কারণে মানুষের দেহের ওপর যেসব নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে বিষণ্নতা। একইভাবে তাদের অন্য এক গবেষণায় প্রমাণিত, নয় ঘণ্টা বা তার বেশি ঘুমানো মানুষের মৃত্যুঝুঁকি সাত থেকে আট ঘণ্টা বা তার কিছু কম ঘুমানো মানুষের তুলনায় অনেক বেশি। সুতরাং বুঝতেই পারছ, ঘুমাতে যতই ভালো লাগুক, অতিরিক্ত ঘুম কখনোই নয়। আরেকটা কথা, শুধু ঘুমাতে ভালো লাগাই নয়, অনেকে আছে, যাদের রাতে পর্যাপ্ত ঘুমের পরও দিনে অতিরিক্ত ঘুম পায়। এটি কিন্তু থাইরয়েড হরমোনের সমস্যার কারণে হতে পারে, সে ক্ষেত্রে চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে দেরি করা যাবে না। আমি একটা জিনিস লক্ষ করেছি, তোমরা কম্পিউটার কিংবা গেম বক্স নষ্ট হলে যেমন দ্রুত সারাইয়ের দোকানে পাঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ো, নিজের শরীরের কোনো অংশ নষ্ট হলে কিন্তু অতটা করো না। এটা মোটেই ঠিক নয়।
.... এই... ওঠো, ওঠো বলছি। লেখাটা পড়ে শেষ করার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছ দেখছি। এত ঘুমিয়ে লাভ কী, বলো? বিখ্যাত রেডিও কমেডিয়ান এলেন ফ্রেড এমন এক ঘুমন্ত ব্যক্তিকে নিয়ে কী বলেছিলেন শোনো, তিনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যখন ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত, তখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। স্বপ্নে কেউ একজন তাঁর সামনে মজার একটা নরম রুটি তুলে দিয়েছে। তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে বিশাল রুটিটার অনেকটুকুই খেয়ে ফেললেন। তারপর যখন ঘুম ভাঙল, তখন দেখলেন, তাঁর নতুন কেনা কোলবালিশের অর্ধেকটাই নেই!