আমরা যারা বাংলায় ভাবি, বলি, লিখি; ভালোবাসি বাংলা এবং বাংলায় ভূতের গল্প পড়তে চাই, তাদের সৌভাগ্য যে বাংলা ভাষার তাবত বড় সাহিত্যিকই দুরন্ত সব ভূতের গল্প লিখে গেছেন, লিখছেন প্রতিনিয়ত। বিদেশে সাধারণত কিছু লেখকই ভূতের গল্প লেখেন; বাংলায় তেমন নয় মোটেও। আমাদের প্রায় সব লেখকই নানা রকম গল্প লেখেন, তার মধ্যে ভূতের গল্পও থাকে। এর পেছনে একটা কারণ মন খারাপ করা—যেহেতু বাংলায় লিখে লেখকেরা পয়সা পান খুব কম, তাই তাঁদের লিখতে হয় বিস্তর গল্প, বিস্তর বিষয়ে। এই চাপে পড়েও হয়তোবা কখনো কখনো বেরিয়ে পড়ে মুক্তোর মতো ঝলমলে সব গল্প। এমনকি নিখুঁত সব ভূতের গল্পও!
ভূতের গল্পের বইয়ের সংখ্যা তাই কম নয় মোটেও। তেমনই কয়েকটা বইয়ের সুলুকসন্ধান দেওয়ার চেষ্টা করব আমি।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্যিক লীলা মজুমদার। কলকাতার এই লেখকের জন্ম আরেক কিংবদন্তি শিশুসাহিত্যিক—তাঁর জ্যাঠা— উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বাড়িতে। একগুচ্ছ অসামান্য ভূতের গল্প লিখেছেন এই লেখক। তাঁর ভূতেরা ভয়ংকর নয়, বরং ভারি মায়াঝরা। কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স থেকে বেরোনো তাঁর অসামান্য গ্রন্থ সব ভুতুড়ে না পড়লেই নয়।
বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ। দুহাতে লিখেছেন এই লেখার জাদুকর। বড়দের জন্য যেমন লিখেছেন উপন্যাস, গল্প তেমনি একই রকম গুরুত্ব দিয়ে লিখেছেন শিশু-কিশোরদের জন্যও। এই লেখকের আরও অনেক বইয়ের মধ্যে পড়া চাই-ই চাই ভয়ংকর ভুতুড়ে, বোতল ভূত এবং ভূত ভূতং ভূতৌ—এই তিনটি বই। পড়তেই হবে তাঁর ভয় এবং ছায়াসঙ্গী—বই দুটি।
বাংলা ভাষার জীবিত সাহিত্যিকদের মধ্যে ভূত নিয়ে সমানতালে, সমান পরিমাণ সক্রিয় আছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তাঁর অসংখ্য গল্প আছে ভূতের। তবে তাঁর কিশোর উপযোগী অদ্ভুতুড়ে সিরিজের অন্য সব বইয়ের মধ্যে যে কয়েকটার কথা তোলা যায়, তার মধ্যে অন্যতম গোঁসাইবাগানের ভূত, যদিও অন্যগুলোও কম যায় না। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অসংখ্য গল্পই ভূতের আনাগোনা, একসঙ্গে সব না পেলেও কলকাতার পত্রবারতী প্রকাশনী থেকে বেরোনো তাঁর কুড়িটি গল্পের সংকলন ভৌতিক গল্পসমগ্রটি পাঠক সংগ্রহ করতে পারো। যদিও এটি মোটেও তাঁর সমস্ত গল্পের সংগ্রহ নয়, এর বাইরেও রয়ে গেছে অন্য সব ভূতের গল্প।
আমাদের খুব প্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলন ভূত নিয়ে লিখেছেন অসংখ্য গল্প। অনন্যা থেকে বেরোনো ভূতের নাম রমাকান্তকামার (যে ভূতটির নাম উল্টো করে পড়লেও একই থাকে!), পাঞ্জেরী থেকে বেরোনো ভৌতিক, অনন্য প্রকাশিত মায়াঘর—আর অনেক অনেক মনে রাখার মতো বইয়ের মধ্যে কটি মাত্র।
কিশোর পাঠকদের সবচেয়ে প্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। কিশোরদের কাছে হিমালয়ের চেয়েও উঁচু তাঁর জনপ্রিয়তার সিঁড়ি। হালকা চালে বলা গল্প নয়, রীতিমতো সিরিয়াস সব ভূতের গল্প লিখেছেন এই লেখক। তাঁর নিশিকন্যা, প্রেত, ও, অন্য জীবন, পিশাবিনী, ছায়ালীন—এই বই কটা ভূতপ্রেমীদের অবশ্যপাঠ্য। আর হাসতে হাসতে ভূতের গল্প পড়তে চাইলে পড়তে হবে ভূতের বাচ্চা কটকটি।
আজ থেকে ১০০-এরও বেশি বছর আগে, ১৯১৬ সালে জন্ম হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের। দারুণ সব ভূতের গল্প লিখেছেন এই লেখক। ‘পেছনের জানালা’, ‘ভুতুড়ে কাণ্ড’, ‘ভূত নেই’, ‘হমর-ধাম’—এমন সব ভয় ধরানো গল্প একত্রে মিলবে ভূত শুধু ভূত বইতে। কলকাতার দে’জ পাবলিশিং থেকে এই বছরই বেরিয়েছে এই সংগ্রহযোগ্য বইটি।
তুষারকান্তি ঘোষের আদি নিবাস যশোরে। ১৮৯৮ সালে জন্ম নেওয়া এই সংবাদকর্মীর রীতিমতো ক্ল্যাসিক দুটি বই—বিচিত্র কাহিনী এবং আরও বিচিত্র কাহিনী। ভৌতিক রসে ডোবানো গল্প খুঁজতে চাইলে এই দুটিও বই সংগ্রহ করা চাই।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকৃতিপ্রেমের পাশাপাশি ভৌতিক জগৎও উঠে এসেছে অনন্য দক্ষতায়। তাঁর অসামান্য চরিত্র ‘অরূনাথ তান্ত্রিক’-এর নামেই রয়েছে অনন্য এক গল্প সংকলন। তবে বিভূতিভূষণের অসামান্য ভূতের গল্প মায়া; বাংলা সাহিত্য কেন, সমগ্র বিশ্বসাহিত্যেই এমন নিখুঁত ভূতের গল্প বিরল। বাংলাদেশের বর্ণায়ন প্রকাশনী থেকে বেরোনো তাঁর ভৌতিক ও অলৌকিক গল্পটি না থাকলে ভূতের বইয়ের সংগ্রহ পরিপূর্ণ হবে না।
ধ্রুব এষকে আমরা চিনি কিংবদন্তি প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে; কিন্তু অসামান্য গল্পও লেখেন এই শিল্পী। তাঁর সকলেই ভূত নয় কেউ কেউ ভূত কিংবা ভয় পাবে তুমি—অসামান্য সব বই। একটু খটমট বড়দের মতো লেখা—কিন্তু একবার ধরলে শেষ না করে ওঠা মুশকিল।
আহসান হাবীবকে আমরা চিনি বিখ্যাত কার্টুনশিল্পী, উন্মাদ সম্পাদক হিসেবে। একই সঙ্গে দারুণ সব ভূতের গল্পও লিখেছেন এই লেখক। ঢাকার শুভ্র প্রকাশ থেকে বেরোনো তাঁর ভূতসমগ্র বইটি সংগ্রহযোগ্য।
একগুচ্ছ সফল ও পরিণত ভূতের গল্প লিখেছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। আমরা শরদিন্দুকে মূলত চিনি গোয়েন্দা সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ-এর জন্য। কিন্তু আমি তাঁর অন্তত গোটা বিশেক অসাধারণ ভৌতিক গল্পের খোঁজ জানি। আলাদা করে তাঁর ভৌতিক গল্পগুলো না পেলেও কলকাতার অন্য পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত গল্প সংগ্রহতেই রয়েছে আকাশবাণী, মরণ-ভোমরা, নিরুত্তর, অশরীরী, নীলকর, দেহান্তর, রাতের অতিথি, পিছু পিছু বলে, কামিনী—এমন সব দুর্দান্ত ভূতের গল্প। একটু পয়সা জমিয়ে এই মোটাসোটা বইটি জোগাড় করলে পয়সা মার যাবে না, এ কথা হলফ করেই বলছি।
মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের আদি নিবাস বিক্রমপুরে। জন্ম ১৮৮৮ সালে। তাঁর ভূতের গল্পে ভয়, হাস্যরস সবই রয়েছে। তাঁর বিখ্যাত দুটি গল্প কঙ্কালের টঙ্কার এবং হরতনের গোলাম। তাঁর উল্লেখযোগ্য একটি বই ভূতুড়ে কাণ্ড।
যকের ধন, আবার যখের ধন—দিয়েই অমর হয়ে আছেন হেমেন্দ্রকুমার রায়। একগাদা ভালো ভূতের গল্প আছে তাঁর। কলকাতার পত্রভারতী থেকে তাঁর তিন খণ্ডে ভৌতিক সমগ্র বেরিয়েছে। ‘ঝণ্ডি আত্মার কাহিনী’, ‘কঙ্কাল সারথি’, ‘যমেনের মমি’, ‘ভূতের রাজা’ ওগুলো তাঁর চিরস্মরণীয় গল্প।
প্রেমেন্দ্র মিত্রকে আমরা চিনি ‘ঘনাদা’র সৃষ্টা হিসেবে। কিশোর উপযোগী দারুণ সব ভৌতিক গল্প রয়েছে তাঁর। মেজকর্তা নামের এক চরিত্রকে নিয়ে তাঁর বেশ কটা ভূতের গল্প আছে। কলকাতার দে’জ পাবলিশিং থেকে বেরোনো তাঁর ভূত-শিকারী মেজকর্তা এবং পড়া চাই ভূতপ্রেমী সম্ভার।
এহসান চৌধুরী কাঠি মামার ভৌতিক গল্প, ভূতের নাচন খুঁজে পেতে হলেও পড়া চাই-ই চাই। আবদুুল হাই মিনারের ফতেহগড়ের তান্ত্রিক বেরিয়েছে জাগৃতি থেকে—এটিও অবশ্যপাঠ্য।
আরও মনে পড়ছে খসরু চৌধুরীর মামার যত ভৌতিক অভিজ্ঞতা (ঐতিহ্য, ঢাকা), ভূত পেত্নী সত্যি দানা (দেব সাহিত্য কুটির, কলকাতা), সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ভৌতিক গল্প সমগ্র (পত্রভারতী, কলকাতা), সজীব চট্টোপাধ্যায়ের কিশোর ভৌতিক সমগ্র (পত্রভারতী কলকাতা), মিজানুর রহমান কল্লোলের ১৫টি হরর গল্প (শিখা প্রকাশনী, ঢাকা), মশিউর রহমানের পরছায়া (প্রতীক, ঢাকা)। আর বিশেষ করে বলতেই হয় অনীশ দাস অপুর কথা। মূলত অনুবাদ করেন কিংবা ছায়া অবলম্বনে লেখেন। কিন্তু তাঁর সাবলীল লেখনীতেই বিশ্বের তাবত গা শিউরানো ভূতের গল্প বাংলায় পড়ার যে সৌভাগ্য, তার মূল্যও কম নয় মোটেও।
আর বাদ পড়ল কোন কোন বই?
কোন কোন লেখক?
অনেক লেখকই বাদ পড়লেন, বাদ পড়ল অনেক বই-ই।
কে কে?
কোন কোন?
উঁহু, বলব না আমি! ওই সব খুঁজে খুঁজে বের করার দায়িত্ব তোমাদের ঘাড়ে দিয়ে আপাতত বিদায় নিই আমি! ভূত ঘাড় মটকানোর আগেই পড়ে ফেলো এই সব ‘আনপুটডাউনেবল’ ভুতুড়ে বই!