বড় হওয়া বা গ্রোথ একটা চলমান প্রক্রিয়া। মায়ের পেট থেকেই আমাদের এই বড় হওয়া শুরু। তোমরা নিশ্চয় জানো যে মায়ের পেটের ভেতরে আমরা প্রথমে মাত্র দুটো কোষ নিয়ে জন্মগ্রহণ করি, তারপর কোষ বিভাজন হতে থাকে। দুটো থেকে চারটা, চারটা থেকে আটটা, আটটা থেকে ষোলোটা—এভাবে কোষের সংখ্যা বাড়তে থাকে আর আমরা সাইজে বড় হতে থাকি। জন্মের সময় গোটা হাত, পা, মাথা, নাক, মুখ, চোখ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একেকজন মানুষ জন্ম নিই আড়াই থেকে চার কেজি ওজন নিয়ে। তারপর পরমুহূর্ত থেকেই আবার বাড়তে থাকা শুরু। দিনে দিনে আমরা সাইজে যেমন বড় আর লম্বা হই, তেমনি আমাদের ভেতরে–বাইরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোও বড় হয়। বুদ্ধির বিকাশ হয়। স্কিল বা দক্ষতা বাড়তে থাকে। তবে কৈশোরে পৌঁছানোর পর হঠাৎ করেই এই বৃদ্ধি বা গ্রোথ যেন জেটপ্লেনের গতি পায়। একে বলা হয় পিউবারটি স্পার্ট বা কৈশোরের উল্লম্ফন। এই সময় আমরা হঠাৎ করে যে লম্বা হতে থাকি তা নয় শুধু, আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বড় হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। যেমন—ছেলেদের গলার স্বর ভারী হয়ে ওঠে, ঠোঁটের ওপর পাতলা গোঁফের রেখা দেখা দেয়, পেশিবহুল হয় শরীর। আর মেয়েদের শরীরের গড়নে পরিবর্তন আসে, ব্রেস্ট ভারী হয়, তারপর ঘটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যার নাম মেনার্কি বা রজঃস্বলা হওয়া। আজকে আমরা জেনে নেব কীভাবে কেন এসব পরিবর্তন ঘটে, এর পেছনের বৈজ্ঞানিক ভিত্তিগুলো কী। আর এ সময় শরীরের যত্নই বা কীভাবে নিতে হয়।
শারীরিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক যেকোনো বৃদ্ধি বা গ্রোথের জন্য তিনটি বিষয় জরুরি: জেনেটিকস বা বংশগতি, সঠিক পুষ্টি আর রক্তে নানান হরমোনের ওঠানামা। যেসব হরমোন বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গ্রোথ হরমোন, থাইরয়েড হরমোন ও কয়েক রকমের সেক্স হরমোন। ছেলেদের বেলায় সেক্স হরমোনের নাম টেস্টোস্টেরন—যা তৈরি করে শুক্রাশয়, আর মেয়েদের বেলায় দুটো—ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন—এদের উত্স হলো ওভারি বা ডিম্বাশয়। এই সেক্স হরমোনকে নিয়ন্ত্রণ করার চাবিকাঠি কিন্তু মাথার ভেতর ছোট্ট মটরদানার মতো পিটুইটারি গ্রন্থিতে—সেই তৈরি করে লুটিনাইজিং হরমোন (এলএইচ) এবং ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন (এফএসএইচ) যারা কিনা সময়মতো সেক্স হরমোন তৈরিকে উদ্দীপনা দেয়। তো কৈশোরের শুরুতে মানে ৯–১০ বছর বয়স থেকে এই এলএইচ ও এফএসএইচের মাত্রা বেড়ে যেতে থাকে, ফলে মেয়েদের ডিম্বাশয় থেকে ইস্ট্রোজেন প্রজেস্টেরন তৈরির হারও বেড়ে যায়। এরই ফলে মেয়েদের শরীরের গড়নে পরিবর্তন আসতে থাকে, দেহের বিভিন্ন জায়গায় চুল গজায়, ব্রেস্টের গঠনে পরিবর্তন হয়। এরই চূড়ান্ত রূপ হলো মেনস্ট্রুয়েশনের শুরু বা রজঃস্বলা হওয়া। মোটামুটি ১২–১৩ বছর বয়সে গিয়ে চূড়ান্ত বিকাশটি ঘটে। তার ঠিক আগে আগে হঠাৎ করে পিটুইটারি অত্যধিক মাত্রায় এলএইচ তৈরি করতে থাকে, একে বলে এলএইচ সার্জ, আর এ ঘটনাই রজঃস্বলা হওয়ার জন্য দায়ী। কিন্তু এই ঘটনার কি দরকার ছিল? হ্যাঁ, অবশ্যই দরকার ছিল। কেননা এ ঘটনাটি না ঘটলে মানবজাতির অস্তিত্বই যে হুমকির মুখে পড়ে যায়। কেন সেটা বলি।
শারীরিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক যেকোনো বৃদ্ধি বা গ্রোথের জন্য তিনটি বিষয় জরুরি: জেনেটিকস বা বংশগতি, সঠিক পুষ্টি আর রক্তে নানান হরমোনের ওঠানামা।
ওভারি বা ডিম্বাশয় তত দিনে ডিম্বাণু তৈরি শুরু করে দিয়েছে। এই ডিম্বাণু হলো ভবিষ্যৎ শিশুসন্তানের মা কোষ। বাবার কাছ থেকে আসা বাবা কোষ শুক্রাণুর সঙ্গে মিলেই না একদিন তৈরি হবে একটা দুকোষী ভ্রূণ, ওই যে শুরুতে যার কথা বলেছিলাম। কিন্তু সে তো অনেক দেরি। এখন এই বালিকার ডিম্বাশয় থেকে প্রতি মাসে যে ডিম্বাণু তৈরি হচ্ছে আর পরিপক্ক হচ্ছে তারা কোথায় যাবে? একটা ২৮ দিনের চক্রের মোটামুটি ১৪তম দিনে ডিম্বাণুটি বেশ একটা ভ্রূণ তৈরি করার মতো বড়সড় আর পরিপক্ক হয়ে ওঠে। এ সময় যদি শুক্রাণুর সাথে তার দেখা হয় তবে তো হয়েই গেল। দুজন মিলে একটা ছোট্ট ভ্রূণ তৈরি করবে আর সেটা একটা চিকন নালি ফেলোপিয়ান টিউব বেয়ে চলে যাবে জরায়ুর ভেতর। ইস্ট্রোজেন আর প্রজেস্টেরন হরমোন জরায়ুকে তত দিনে প্রস্তুত করে দেবে এই ভ্রূণকে দশ মাস লালন–পালন করার জন্য, যাতে তার কোনো ক্ষতি না হয়। কিন্তু যদি তা না হয় তবে এই অনিষিক্ত ডিম্বাণু তখন করপাস লুটিয়াম নামের একটা দলা পাকানো জিনিস তৈরি করে। আরও ১২ থেকে ১৪ দিন অপেক্ষা করার পর এই করপাস লুটিয়াম জরায়ুর দেয়ালের কোষ ও রক্তসহ বেরিয়ে আসে। এটাই হলো মেনস্ট্রুয়েশন। মেনস্ট্রুয়েশনের প্রথম দিনটিকে ধরা হয় ২৮ দিনের চক্রের প্রথম দিন। ৪ থেকে ৫ দিন থাকে এই অবস্থা। জরায়ুর ভারী দেয়াল পাতলা হয় এই কদিনে, নষ্ট হয়ে যাওয়া ডিম্বাণুটাও বেরিয়ে যায়। তারপর আবার হরমোনের মাত্রা বাড়তে থাকে, আবার জরায়ুর দেয়াল ভারী হয়ে গড়ে উঠতে থাকে, আবার একটা ডিম্বাণু পরিপক্ক হতে থাকে ও ১৪তম দিনে গিয়ে আবার চূড়ান্ত বৃদ্ধি হয়। এভাবে চক্রাকারে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকে। এটা অনেকটা পুরাণে বর্ণিত আগুনে পুড়ে যাওয়া ফিনিক্স পাখির আবার নতুন করে জন্ম নেওয়ার মতো। প্রতি মাসে একইভাবে ডিম্বাণুর জন্ম–মৃত্যুর খেলা চলতে থাকে যত দিন না একটা শুক্রাণুর সঙ্গে তার দেখা হয়। তো এই চক্র যদি না চলে তবে সেই মেয়েটি কোনো দিনই নিজের শরীরের ভেতর একটা ভ্রূণ তৈরি ও তা বড় করতে পারবে না। তার মানে শিশুর জন্ম হবে না। আর নতুন শিশুর জন্ম না হলে একদিন মানবজাতির পথচলা যাবে থেমে। পৃথিবী হয়ে যাবে জনশূন্য মরুভূমি। তাই সত্যি বলতে কি মানবজাতির টিকে থাকার স্বার্থেই এই চক্রাকার মেনস্ট্রুয়াল সাইকেলের আবির্ভাব।
কিশোরী মেয়েদের প্রথম রজঃস্বলা হওয়ার ঘটনার নাম মেনার্কি। এর মাধ্যমে সে এবার সত্যিকারের বড় হয়ে উঠল, মানে একটা নতুন শিশুর জন্মদানের উপযোগী হয়ে উঠছে সে ধীরে ধীরে। এটা লজ্জার কিছু তো নয়ই, বরং গর্বের ব্যাপার। কেননা মানবজাতিকে রক্ষার দায় নিয়েই সে এবার পথ চলতে শুরু করবে। এই মেনার্কির সময় তাদের কী করা উচিত–অনুচিত তা নিয়ে পরে আরও আলোচনা হবে। আজ তবে এইটুকুই রইল।