উফ্! আবারও ঠোকাঠুকি! একটু যে আরাম করে লিখব, সেটাও হচ্ছে না—ভীষণ বিরক্ত রাইসা। ওর বন্ধু মাহিন লেখে ডান হাতে আর রাইসা লেখে বাঁ হাতে। কিছুক্ষণ রাইসা মাহিনের ডান হাতের ধাক্কা খায়, আবার কিছুক্ষণ মাহিনকে ওর বাঁ হাতের ধাক্কা দেয়। প্রায় সময়ই হাত রাখার জায়গা ঠিকমতো না পেয়ে খুব কষ্টে লিখতে হয়, তাই লেখার গতিটাও অন্যদের থেকে কমে যায়। এটা অবশ্য রাইসার একার সমস্যা নয়। বরং যারা বাঁহাতি, অর্থাৎ বাঁ হাতে সব কাজ করে অভ্যস্ত, তাদের সবাইকেই নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়, সেটা কম্পিউটারের মাউস ব্যবহারেই হোক আর স্পাইরাল করা খাতায় লেখার ব্যাপারই হোক না কেন!
অনেকেই মনে করে, কাজের ক্ষেত্রে ডান বা বাঁ হাতের ব্যবহার নির্ভর করে ছোটবেলার অভ্যাসের ওপর। কিন্তু আসলে অভ্যাসের চেয়ে এ ক্ষেত্রে জন্মগত বৈশিষ্ট্যের প্রভাব অনেক বেশি। সাধারণত ছয় বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের ডান ও বাঁ দিক সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকে না, প্রায় সব কাজই দুই হাত দিয়ে করতে চায়। এরপর ধীরে ধীরে কোনো একটা হাত বেশি ব্যবহারের প্রবণতা বেড়ে যায়।
ব্যাপারটা আর একটু বুঝিয়েই বলি। মানুষের বাঁহাতি হওয়ার কারণ খুব নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে বেশির ভাগ গবেষকের ধারণা, এ ক্ষেত্রে পরিবেশগত প্রভাবের তুলনায় জিনগত কারণই মুখ্য। গবেষণা করে দেখা গেছে, আমাদের মস্তিষ্কের দুটি অংশ রয়েছে। একটা হলো ডান দিকের অংশ যেটা নিয়ন্ত্রণ করে আবেগ, কল্পনা, ঘুম, বিশ্বাস, স্বপ্ন, আধ্যাত্মিক ভাবনা, সৃজনশীলতা ইত্যাদি। আরেকটা হলো বাঁ দিকের অংশ, যেটা নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তি, ভাষা, কথা ও নানা ধরনের বৈষয়িক চিন্তাভাবনা ও কাজ। এই দুই অংশের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষেরই বাঁ অংশ তুলনামূলকভাবে বেশি সক্রিয় থাকে। এ ধরনের মানুষই হয় ডানহাতি। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের ডান অংশ বাঁ অংশের তুলনায় বেশি সক্রিয় হয়। তাই যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে তাদের বাঁ হাত ব্যবহার সুবিধাজনক। তাই বলা যায়, ডানহাতি বা বাঁহাতি হওয়াটা নির্ভর করে মস্তিষ্কের সক্রিয়তার ওপর। তবে এর মানে কিন্তু এমন নয় যে ডানহাতি মানুষের আবেগ-অনুভূতিতে ঘাটতি আছে অথবা বাঁহাতি মানুষজন যুক্তি, তর্ক ও বৈষয়িক ভাবনায় পিছিয়ে আছে।
ডান হাত ও বাঁ হাত নিয়ে দ্বন্দ্ব কিন্তু নতুন নয়, বরং বহু আগে থেকেই চলে আসছে। বাঁ হাত সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণাটাই বেশি। ‘ডান হাতের কাজ’ শুনলে মনে হয় দান-খয়রাত বা কোনো পুণ্যের কাজ। অপর দিকে, ‘বাম হাতের কাজ’ শুনলেই মনে হয় ঘুষ, খুন বা গুমসম্পর্কিত কাজ হয়তো! কাউকে বেশি গুরুত্ব দিতে হলে বলা হয়, আরে ও তো আমার ডান হাত! ওকে ছাড়া কাজটা চলবেই না। বাঁ হাত কিন্তু কখনোই বলা হয় না। বাঁ হাতটাকে যেন সব সময়ই একটা অবজ্ঞার মধ্যে রাখা হয়। অনেকটা যেন কী আর করা, আছে, থাকুক! কালো জাদু, অশুভ শক্তি, তাবিজ-কবচ, মন্ত্রতন্ত্র—সবকিছুই যেন বাঁ হাতের কাজ। একটা সময় ছিল, যখন বাঁ হাতে করা শপথও বিশ্বাস করা হতো না। বাঁ হাতের প্রতি কিছু মানুষের এসব নেতিবাচক চিন্তা বিপদে ফেলে দেয় বাঁহাতিদের। কোনো গুরুজনকে যদি বাঁ হাত বাড়িয়ে কিছু দেওয়া হয়, তাতে নির্ঘাত তিনি মনে মনে বলবেন, কী বেয়াদব মেয়ে রে বাবা, ভদ্রতা কিছু শেখেনি। শুধু কি তা-ই, অনেক সময়ই শুনতে পাওয়া যায়—এই এই, বাঁ হাত লাগায় না এখানে, বাঁ হাতে বই ধরে না। ছি ছি! বাঁ হাতে খেতে হয় না—এমন আরও কত-কী!
আর সে জন্যই বাঁহাতি ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাদের মা-বাবা বেশ চিন্তিত থাকেন। অনেক সময়ই চেষ্টা করেন জোর করে ডান হাত দিয়ে কাজ করানোর। বিশেষজ্ঞরা বলেন, জোর করে এই অভ্যাস পরিবর্তন করানো একদমই উচিত না। এতে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণায় দেখা গেছে, হাজার হাজার বছর আগে পাথরযুগে মানুষ যখন পাথরের হাতিয়ার তৈরি করত, তখন কোনো বিশেষ হাতের পক্ষপাতিত্ব ছিল না। কিন্তু ব্রোঞ্জ ও লৌহযুগে এসে যন্ত্রপাতিতে ডান হাতের ব্যবহার বেশি হতে লাগল। আর বর্তমান যুগে তো ডানহাতিরাই একচেটিয়া কর্তৃত্ব করছে। তাই কষ্ট করে হলেও ডানহাতিদের পণ্যদ্রব্য ও যন্ত্রপাতির সঙ্গে বাঁহাতিদের খাপ খাইয়ে চলতে হয়। পণ্য প্রস্তুতের সময় বাঁহাতিদের কথা প্রায় ভাবাই হয় না। কাঁচি, দরজা, বিভিন্ন মিউজিক্যাল যন্ত্রপাতি ইত্যাদিতেই এর প্রমাণ মেলে।
বিশ্বের মাত্র ৭ থেকে ১০ শতাংশ লোক বাঁহাতি। প্রতিদিন তাদের যেসব অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, সে সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্যই ১৯৭৬ সাল থেকে প্রতিবছরের ১৩ আগস্ট বিশ্ব বাঁহাতি দিবস পালন করা হয়। ‘লেফট হ্যান্ডারস ইন্টারন্যাশনাল’ নামে বাঁহাতিদের একটা সংঘ রয়েছে।
বাঁহাতি মানুষের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের ডান অংশের প্রভাব একটু বেশি থাকায় তারা বেশ বুদ্ধিমান ও সৃজনশীল হয়। জ্যাক ফিঞ্চার তাঁর বই লেফটিস-এ জনপ্রিয় কিছু মানুষের কথা বলেছেন, যাঁরা সবাই বাঁহাতি। সম্রাট আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, জুলিয়াস সিজার, লেওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জেলো, চার্লি চ্যাপলিন, বিল ক্লিনটন, প্রিন্স উইলিয়াম, বিল গেটস, ম্যারাডোনা, ব্রায়ান লারা, সাকিব আল হাসান, অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, টম ক্রুজ, অমিতাভ বচ্চন, অপরাহ উইনফ্রেসহ আরও অনেক জনপ্রিয় প্রতিভাবান আছেন বাঁহাতি তালিকায়।
তাই তুমি বাঁহাতি হলে বা বাঁহতে কাজ করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলে একদমই চিন্তা কোরো না। তোমার মা-বাবাকেও চিন্তা করতে মানা কোরো। বাঁ হাতে কাজ করার সঙ্গে ভালো-মন্দ বা বেয়াদবির কোন সম্পর্ক নেই। নিজের মাথাটাকে বেশি বেশি খাটাও, এই বাঁহাতি তারকাদের তালিকায় তোমার নামও যুক্ত হয়ে যাবে একদিন।