“মেয়ে বলে পারব না কেন?” —স্কুলের ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে শুরু করে টেবিল টেনিস টুর্নামেন্ট সব কিছুতে নিজের সাফল্যের প্রমাণ রাখা ১৩ বছর বয়সী দীপা (ছদ্মনাম) এমনটাই ভাবত। অথচ আজকাল যেন ধারণাটা খানিকটা পাল্টে যাচ্ছে ওর। পরপর দুবার আন্তঃস্কুল ভলিবল টুর্নামেন্টে বিজয়ী দলকে নেতৃত্ব দেয়া দীপা এবার অংশই নিচ্ছে না এ প্রতিযোগিতায়। শুধু তা-ই নয়, গত মাসে যখন স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হলো তখনও ফাইনাল রাউন্ডে শেষ পর্যন্ত অংশ নেয়নি সে। বদলে গেছে তার আচরণও, আগে যেমন বিজ্ঞান মেলা এবং বসন্ত উৎসবের মঞ্চে সমান উৎসাহে ছুটে বেড়াতে দেখা যেত দীপাকে, এখন সেই উৎসাহও যেন নেই তার। দীপার বন্ধু এবং শিক্ষকেরাও তার বদলে যাওয়া এমন আচরণে বেশ অবাক। এমন সময় দীপার সাথে এ ব্যাপারে সরাসরি কথা বলতে এগিয়ে এলেন স্কুলের ক্রীড়াশিক্ষক মনোয়ারা চৌধুরী। আর সেই কথোপকথন থেকেই যেন দীপা ফিরে পেল নিজেকে। স্কুলের মাঠে আবারও নিয়মিত ছুটে বেড়াতে দেখা গেল তাকে।
কেন বদলে যাচ্ছিল দীপা? আর কীভাবে শিক্ষিকার সাথে কথোপকথন তাকে আবারও ফিরিয়ে আনল নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গায়? এটাই ভাবছ তো? তার আগে নিজেকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখো তো মেয়ে, ৯ থেকে ১৩ বছর বয়সের এ সময়টাতে তুমিও কি খানিকটা বদলে গিয়েছিলে? মাসের কিছুদিন তুমিও কি স্বাভাবিক কাজকর্ম থেকে নিজেকে বিরত রাখো? অনেকের ক্ষেত্রেই উত্তর হবে ‘হ্যাঁ’। দীপার ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই হয়েছিল। স্বাভাবিক নিয়মেই ৯ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে মেয়েদের শরীরে ঘটে বেশ কিছু পরিবর্তন, যার মাঝে মেনস্ট্রুয়েশন একটি। মেনস্ট্রুয়েশনের ফলে মেয়েদের যেসব শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয় সেসবের সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে এক ধরনের মানসিক অবসাদ, নিজেকে সব কিছু থেকে দূরে রাখার ভাবনা ঘিরে ধরেছিল তাকে। দীপার মনে হয়েছিল তার সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হিসেবে কাজ করছে এ বিষয়টি। তাই এক ধরনের অবসাদে ভুগছিল সে। আর এমনটা হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হলো মেনস্ট্রুয়েশন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকা, এর স্বাভাবিকত্বের বিষয়টি উপলব্ধি করতে না পারা।
হাত ধোয়া থেকে শুরু করে পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়া—স্বাস্থ্য সম্পর্কিত এমন বিষয়গুলো নিয়ে পরিবার এবং শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়মিত আলোচনা আর পড়াশোনার মাধ্যমেই আমরা শৈশব থেকে সচেতন হয়ে উঠেছি। কিন্তু যখন বিষয়টি “মেনস্ট্রুয়েশন” তখন অনেক সময়ই আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করা সহজ হয়ে ওঠে না। আলোচনার ক্ষেত্র তৈরির এ দায়িত্ব যেমন বাবা-মা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের রয়েছে, তেমনি শিক্ষকেরাও এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। কারণ একজন শিক্ষার্থী দিনের এক বিশাল অংশ কাটায় তাঁদের সান্নিধ্যে। হতাশাজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এ ব্যাপারে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মাঝে কোনো ধরনের আলোচনাই হয় না। এ ব্যাপারে সিরাজগঞ্জ জেলার সালেহা ইসহাক সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষার্থী জানায়, “আমাদের পাঠ্যবইয়ে ঋতুস্রাব নিয়ে যে অধ্যায়টি রয়েছে সেটিও খুব ভালোভাবে পড়ানো হয় না, আর এ ব্যাপারে এর বাইরের আলোচনা বা পরামর্শ কখনও শিক্ষদের কাছে আমরা পাইনি।” তবে ভিন্নচিত্রও আছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী লামিয়া নওরীন জানায়, “ক্লাস সেভেনের শুরুতেই এ ব্যাপারে আমাদের ক্রীড়া শিক্ষিকা আমাদেরকে সচেতন করেছিলেন। তিনি বারবার বলেছিলেন যেন আমরা মেনস্ট্রুয়েশনকে ভয়ের কারণ না ভাবি। কেন মেনস্ট্রুয়েশন হয় এবং এটি যে একটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া সেটি বারবার বলে আমাদের এ সংক্রান্ত সব ভয় তিনি দূর করে দিয়েছিলেন।”
শিক্ষকদের করণীয়
১। মেনস্ট্রুয়েশন কী এবং কেন হয়, এ নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত এবং যথাযথ তথ্য শ্রেণীকক্ষেই শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তকে মেনস্ট্রুয়েশন সংক্রান্ত যে অধ্যায়গুলো রয়েছে তা যত্ন নিয়ে পড়ানো হতে পারে সচেতনতা শুরুর প্রথম ধাপ।
২। মেনস্ট্রুয়েশন নিয়ে কিশোরীদের যে ভয় বা অবসাদ তার পেছনে আমাদের সমাজে এ নিয়ে যে ট্যাবু বা কুসংস্কার রয়েছে তা অনেকাংশেই দায়ী। তাই শিক্ষকদের উচিত মেনস্ট্রুয়েশনের স্বাভাবিকত্ব, এ সময় পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্য পরিচর্যার যে নিয়মগুলো মেনে চলা উচিত তা নিয়ে যথাসম্ভব সচেতনতা তৈরি করা।
৩। মেনস্ট্রুয়েশন নিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। অর্থাৎ কোনো শিক্ষার্থী মেনস্ট্রুয়েশন সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন করতে চাইলে বা কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে যেন নির্দ্বিধায় শিক্ষকের কাছে আসতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।
৪। কোএডুকেশন বা ছেলেমেয়ে এক সঙ্গে পড়ে এমন স্কুলগুলোতে অনেক সময় শিক্ষকেরা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি এড়াতে মেনস্ট্রুয়েশন নিয়ে আলোচনা এড়িয়ে যান। কিন্তু মেনস্ট্রুয়েশনের মতো একটি স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া নিয়ে যথাযথ সচেতনতা তৈরি করতে চাইলে ছেলে-মেয়ে উভয়েরই এ ব্যাপারে জানা প্রয়োজন। “পিরিয়ড শেমিং” অর্থাৎ হঠাৎ পিরিয়ড বা মেনস্ট্রুয়েশন হয়ে গেলে রাস্তায় বা ঘরের বাইরে যেকোনো জায়গায় মেয়েরা যে অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হয়, তাও রোধ করা সম্ভব যদি শৈশব থেকেই সবাই এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের করণীয়
১। সদ্য বয়ঃসন্ধিতে পা রাখা শিক্ষার্থীদের জন্য মেনস্ট্রুয়েশন বিষয়ক সেমিনার, আলোচনা সভার আয়োজন করতে হবে। এসব আয়োজনে শিক্ষার্থীদের জন্যও প্রশ্ন করার, মুক্ত আলোচনার ব্যবস্থা রাখতে হবে। হলি ক্রস বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ আরো কিছু স্কুলে এ ধরনের সেমিনারের আয়োজন করা হয় প্রতি বছর।
২। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসা শিক্ষার্থীরা যেন পরিবার থেকেও মেনস্ট্রুয়েশনের সময় যথার্থ সহায়তা পায়, তা নিশ্চিত করতে অভিভাবকদের জন্যও সচেতনতামূলক সেমিনারের আয়োজন করা উচিত।
৩। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেনস্ট্রুয়েশন-বান্ধব টয়লেট থাকতে হবে, যেখানে থাকবে পর্যাপ্ত স্যানিটারি ন্যাপকিন, স্যানিটারি ন্যাপকিন ফেলবার যথাযথ ব্যবস্থা, সাবান, পানিসহ অন্যান্য সুবিধা।
৪। তবে প্রথমেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ হতে হবে এমন যেখানে মেনস্ট্রুয়েশন নিয়ে কোনো ট্যাবু নেই, যেখানে এ নিয়ে হতে পারে মুক্ত আলোচনা, যেখানে এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের থাকবে স্পষ্ট ধারণা।
মেনস্ট্রুয়েশন কোনো শারীরিক অস্বাভাবিকতা বা অসুস্থতা নয়, যা তোমাকে পিছিয়ে দেবে, যা তোমার সামনে এগিয়ে যাবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। অন্যান্য সব বিষয়ের মতোই মেনস্ট্রুয়েশন নিয়ে জানতে চেষ্টা করো, পরিবার ও শিক্ষাক্ষেত্রে এ নিয়ে করো মুক্ত আলোচনা। কারণ আলোচনার পথ ধরেই আসে সমাধান, দূর হয় ভয় ও অবসাদ।