কিশোর আলোর নানা আয়োজনে অংশগ্রহণের সুবাদে কিশোর আলোর পাঠক বন্ধুদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বেশ গভীরই বলা যায়। প্রায় সময়ই কিশোর আলোর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এসে তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে টের পেলাম যে তোমাদের কারও কারও নাকি পড়তে বসলেই ঘুম পায়। কেউ কেউ আবার পাঠ্যবইয়ের নীরস তত্ত্ব, সূত্র আর নিয়ম পড়তে পড়তে মহাবিরক্ত। একই জিনিস হাজারবার পড়েও তোমাদের কারও কারও নাকি সেগুলো কোনোভাবেই মনে থাকছে না…এবং এমন আর কত কী...
পড়াশোনা নিয়ে প্রায় আমাদের সবারই এ রকম কতশত অভিযোগ! অথচ গল্পের বইগুলো নিয়ে বসলে তো সেই বিরক্তি টুক করে পালিয়ে যায়। অনেককাল আগে পড়ে আসা ঠাকুরমার ঝুলি, ঈশপের গল্প কিংবা গোপাল ভাঁড় আর নাসিরুদ্দীন হোজ্জার আজব কীর্তিগুলো তো ঠিকই মনে আছে! সেই বইগুলো আবারও পড়তে দেওয়া হলে কিন্তু মোটেও তেমন বিরক্ত লাগবে না; বরং ঠিক সেই আগের মতো মজা নিয়েই পড়া শুরু করবে তোমাদের কেউ কেউ।
পড়াশোনা নিয়ে যখন আমাদের এত শত অভিযোগ। আর যাবতীয় গন্ডগোল যখন ঘুরেফিরে সেই পড়তে বসলেই এসে হাজির হচ্ছে, তখন ভাবলাম একবার বরং চেষ্টা করেই দেখি তোমাদের করা অভিযোগগুলোর সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় কি না। কখনো কি ভেবেছ এমনটা কেন হয়? কেন পাঠ্যবই পড়তে এত বিরক্তি আমাদের আর গল্পের বইয়ে এতটা আনন্দ?
আচ্ছা, বলেই দিচ্ছি নাহয়। পাঠ্যবই আমরা পড়ি, মূলত পরীক্ষার খাতায় লিখে নম্বর পাওয়ার জন্য। গৎবাঁধা পড়াশোনার চাহিদাটুকু কেবল প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়াতেই আজও আটকে আছে। অথচ পাঠ্যবইয়ের পড়াগুলোকে যদি আমরা পরীক্ষার জন্য না পড়ে পড়তাম জানার জন্য, বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কারের আদ্যোপান্ত যদি শেখা হতো গল্পে গল্পে, তাহলে কতই না ভালো হতো। বোরিং পড়াশোনা তখন হয়ে যেত অনেক অনেক আনন্দের।
কখনো কি চেষ্টা করে দেখেছ যে কীভাবে এই নীরস পড়াশোনাটাকে একটু মজার করে তোলা যায়? পড়াশোনা যেহেতু করতেই হবে, তো চলো একটু ভেবে দেখি কী করে বোরিং পড়াশোনায় একটুখানি আনন্দের স্পর্শ দেওয়া যায়। তোমাদের জন্য রইল কিছু পরামর্শ—
পড়ার জায়গা হোক নির্ধারিত
আমি মাঝেমধ্যেই একেক সময় একেক জায়গায় পড়তে বসে যাই। কখনো দেখা যায়, গাড়িতে পড়ছি। কখনো আবার বসার ঘরের সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে পড়া শুরু করে দিই। কখনোবা খাবারের টেবিলেও বসে পড়ি বই নিয়ে। একেক সময় একেক জায়গায় পড়তে বসার কারণে মাঝেমধ্যেই পড়ায় মনোযোগ আসতে অনেক সময় লেগে যায়।
তা আমার মতো তুমিও কি একেক সময় একেক জায়গায় পড়তে বসো? কখনো বসার ঘরের সোফায়, কখনো খাবারঘরের টেবিলে কিংবা কখনো শোবার ঘরের বিছানায়?
এ রকম হলে কিন্তু চলবে না। পড়ায় মনোযোগ ধরে রাখতে কোথায় পড়া হচ্ছে, সেই জায়গাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সেটা হতে পারে তোমার বাসার একটা কোলাহলহীন, নির্জন আর পরিচ্ছন্ন জায়গায় রাখা তোমার পড়ার টেবিলটা কিংবা জানালার পাশে রাখা বিছানা! জায়গাটা এমন হতে হবে, যেখানে তুমি পড়তে অভ্যস্ত, যাতে সেখানে যাওয়ামাত্রই মনোযোগ চলে আসে।
তাই পড়ার জন্য চমৎকার একটা জায়গা নির্ধারণ করে ফেলো আজই।
একটু শারীরিক কসরতে মিলবে সতেজতা
ছোটবেলায় বিকেলবেলা খেলতে রোজ বাসার সামনের মাঠে যেতাম। তবে হ্যাঁ, সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরতে হবে, সে শর্তটা কখনো ভুলে যেতাম না। খেলা শেষে বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে স্কুলের হোমওয়ার্ক করতে বসতে হতো। শৈশবটা বেশ রঙিন আর চমৎকারই ছিল বলা যায়। তখন অনেক খেলাধুলা করা হতো বলে ব্যায়ামের প্রয়োজন ছিল না খুব একটা। এমনিতেই মন-মেজাজ, শরীর বেশ সুস্থ-সবল আর সতেজ থাকত।
এখন তো আর শহরের এলাকাগুলোতে তেমন খেলার মাঠ আর চোখে পড়ে না। ভিডিও গেম আর টেলিভিশন সিরিজেই মত্ত সবাই। চেষ্টা করো যাতে পড়তে বসার আগে অন্তত একটু হালকা ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করে নিতে। এতে দেখবে অনেকটা সতেজ লাগবে পড়ার সময়। গোসলও করতে পারো। ব্যায়ামে আগ্রহ না থাকলে পুরো বাসায় একটা চক্করও দিতে পারো। রান্নাঘরে গিয়ে খোঁজ করতে পারো মা দুপুরের খাবারের জন্য কী রান্না করছেন।
প্রফুল্ল আর সতেজ মন নিয়ে পড়তে বসলে সেই পড়াটা মনেও থাকবে বেশি। তাই পড়ার আগে একটুখানি শারীরিক কসরত করে নেওয়া যেতেই পারে।
Stay Hydrated
সেই ছোট্টবেলা থেকে শুনে এসেছ যে ‘পানির অপর নাম জীবন’। আর তাই বেশি বেশি পানি খেতে হবে। কিন্তু পানি খেতে তো ভালোই লাগে না। কী করা যায়? ফলের রস কিংবা শরবত বা লাচ্ছি তো খাওয়া যেতেই পারে। পানি কম খেলেও পানিজাতীয় খাদ্য কিংবা ফল খাওয়ার মাধ্যমে শরীরের প্রয়োজনীয় পানির ঘাটতি পূরণ করতে হবে। পানিশূন্যতা আমাদের মস্তিষ্কের ওপরেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
মনোযোগ স্থির রাখতেও এই পানির ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
এ জন্য পড়তে বসার আগে আমিও অন্তত এক গ্লাস পানি খেয়ে নিতাম। আর পড়ার টেবিলের এক পাশে আম্মু সব সময় একটা পানির বোতল আর গ্লাস রেখে দিতেন।
তোমরাও প্রতিবার পড়তে বসার আগে এক গ্লাস পানি পান করে নিয়ো। এতে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা অনেকখানি বেড়ে যায়। এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত তথ্য।
পড়ার জন্য সময়সীমা আর লক্ষ্যমাত্রা হোক নির্ধারিত
অনেক সময় দেওয়া হলেও আমাদের অধিকাংশেরই পড়তে বসার কথা মনে পড়ে সেই পরীক্ষার আগের রাতেই। ছয় মাস সময়ব্যাপী করতে দেওয়া রিসার্চের রিপোর্ট লেখার কথা মাথায় আসে ঘুরেফিরে সেই সাবমিশনের ঘণ্টা কয়েক আগেই। আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আমাদের হুঁশ ফেরে একদম শেষ মুহূর্তে।
‘Procrastination’ বা দীর্ঘসূত্রতা হলো এই প্রজন্মের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটা।
সময়সীমা শেষ হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে ফেরা এই হুঁশটাকে সব সময় যাতে কাজে লাগানো যায়, সে জন্য সাধারণ পড়াশোনা কিংবা কাজ করার ক্ষেত্রেও এই সময়সীমা আর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের অভ্যাস করতে হবে। কারণ, এতে আমাদের মধ্যে কাজ বা পড়া শেষ করার তাড়না কাজ করবে। এই ছোট্ট ছোট্ট সময়সীমা আর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ আর সেগুলো অনুসরণ করার মাধ্যমে আমাদের সময়ের কাজ সময়ে করার অভ্যাসটাও গড়ে উঠবে। তাই এখন থেকে পড়ার আগে সময়সীমা আর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে তবেই পড়তে বসো। লক্ষ্যমাত্রা যদি পূরণ করতে পারো, তখন ছোটখাটো পুরস্কারও দিতে পারো। হতে পারে সেটা একটা চকলেট।
পড়ার সময় প্রিয় বন্ধু থাকুক নিরাপদ দূরত্বে—
ডিজিটাল সময়ের ডিজিটাল প্রজন্ম আমরা। সে হিসাবে আমাদের প্রিয় বন্ধু আর সার্বক্ষণিক সঙ্গী মুঠোফোন বললে খুব একটা ভুল হবে না। যদিও মুঠোফোন আমার নিজেরও সদা সর্বদা সঙ্গী। খানিক পরপর নোটিফিকেশন চেক করার ভূত মাঝেমধ্যে আমার ঘাড়েও চেপে বসে।
তা তোমাদের মধ্যে অনেকেরই তো পড়তে বসলেও আমার মতো খানিক বিরতি দিয়ে দিয়ে এই প্রিয় বন্ধুর সান্নিধ্যের দরকার পড়ে।
কী, ঠিক বলিনি?
কিন্তু সমস্যা হলো, এই প্রিয় বন্ধু যখন পড়াশোনার সময় বিরক্ত করে বসে, তখন কি তাকে আর প্রিয় বন্ধু বলা সাজে? তাই পড়ার সময় এই প্রিয় বন্ধু মহাশয়ের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হবে।
কিন্তু এই মুঠোফোন থেকে দূরে থাকা তো চাট্টিখানি কথা নয়। তো কী করা যায় বলো তো?
মুঠোফোন মানেই তো ফেসবুক নয়তো চ্যাটিং। তাই পড়তে বসো বিকেলবেলায় কিংবা এমন একটা সময়ে, যে সময়টায় মানুষ সাধারণত অনলাইনে থাকে না।
মুঠোফোনটাকে রাখো হাতের নাগালের বাইরে। অর্থাৎ এমন একটা জায়গায়, যাতে হাত বাড়ালেই পাওয়া না যায়। জায়গা থেকে উঠে গিয়ে আনতে হবে, এমন জায়গায় রেখে তবেই পড়তে বসো। মায়ের কাছেও জমা রাখতে পারো।
পড়ার ফাঁকের বিরতিটাকে বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজে লাগাও। পড়ার ফাঁকে বিরতি নিলে সাধারণত সবার আগে সেই মুঠোফোনটাকেই হাতে নেওয়া হয়। এই জিনিসটা করা যাবে না।
এই ট্রিক তিনটাকে কাজে লাগিয়ে পড়ার সময় দূরে থাকো মুঠোফোন থেকে।
ভুলে যাওয়া এড়াতে নিমোনিক হোক টেকনিক—
ছোট্টবেলায় করে আসা ‘সরল’ নামের জটিল অঙ্কগুলোর কথা মনে আছে? তা তোমাদের মতোই আমারও সরল অঙ্ক দেখামাত্রই গলা শুকিয়ে যেত একসময়। নামখানা সরল হলেও ইয়া বড় অঙ্কগুলো করতে গিয়ে ঘেমেনেয়ে অস্থির হওয়ার জোগাড় হতো আমার। কারণ, একটুখানি ভুলেই পুরো হিসাবে গরমিল হয়ে যেত যে। তারপর একদিন ক্লাসে স্যার বললেন মহামতি BODMAS–এর কথা। এক BODMAS–এ সব জটিল সরলের সমাধান মিলে গেল অতি সহজেই।
এই BODMAS হলো একটি অতি পরিচিত নিমোনিক।
সহজ কথায়, নিজেদের পড়া মনে রাখার সুবিধার্থে বানিয়ে নেওয়া কৌশলগুলোই হলো নিমোনিক।
ছোট্টবেলায় পরিমাপের একক শিখতে গিয়ে শেখা আরেকটা মজার নিমোনিক হলো—
কিলায়ে হাঁকায়ে ডাকাত মারিলে দেশে শান্তি মিলিবে।
এ রকম মজার মজার নিমোনিক তৈরি করে সহজেই মনে রাখা সম্ভব হবে ইংরেজির আতঙ্ক ভোকাবুলারি, পদার্থবিদ্যা বা গণিতের যেকোনো কঠিন আর হিজিবিজি সূত্র কিংবা রসায়নের নীরস আর তিতকুটে তত্ত্ব বা বিক্রিয়া।
বই পড়া হোক পাতাতেই, নোট নেওয়া হোক খাতাতেই—
বই পড়তে বেশ ভালো লাগে আমার। তবে আমি যখন মুঠোফোনে কোনো বইয়ের পিডিএফ পড়তে যাই, তখন টুং করে আসা নোটিফিকেশনের ধাক্কায় কখন যে বই থেকে বেরিয়ে ফেসবুকের নিউজ ফিডে হারিয়ে যাই। আর যখন হার্ড কপি নিয়ে পড়ি, তখন অনায়াসেই একটানা অনেকক্ষণ পড়ে যেতে পারি। একই ঘটনা ঘটে যখন বিভিন্ন মিটিং বা প্রেজেন্টেশন দেখার সময় সেটার খুঁটিনাটি মোবাইলে টুকে রাখতে যাই। বেশির ভাগ সময়ই মিটিং থেকে হারিয়ে যেতাম মহাবজ্জাত নোটিফিকেশনের প্ররোচনায়। সেই দুঃখেই এখন ব্যাগে সব সময় নোটবুক রাখি।
ডিজিটাল এই যুগে মুঠোফোনে নোট নেওয়া কিংবা ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ থেকে পিডিএফে বইয়ের সফট কপি পড়াটাই এই প্রজন্মের অভ্যাস হয়ে গেছে। আর এটি করতে গিয়ে এখনকার এই যন্ত্রবান্ধব প্রজন্মের পড়াশোনাটাও যে বড্ড বেশি যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে খেয়াল আছে? যেকোনো বই আমরা এখন বইয়ের দোকানে খোঁজ করার আগে পিডিএফের খোঁজ করি। কাগজ–কলম তো এখন অনেকের পরীক্ষার হল বাদে হাতে নেওয়াই হয় না। নোট নেওয়া হয় মুঠোফোনে, বই পড়া হয় পিডিএফে।
অথচ মুঠোফোনে নোট নেওয়ার চেয়ে খাতা–কলমে হাতে লিখে নেওয়া নোটের স্থায়িত্ব স্মৃতিতে অনেকখানি বেশি। কারণ, খাতা–কলমে নোট নেওয়া হলে প্রয়োজন সাপেক্ষে আঁকাআঁকি কিংবা ডুডলিং করেও রাখা যায়, যেটা ফোনে নোট নেওয়ার সময় করা যায় না। আর আঁকা জিনিস স্মৃতিতে অধিকতর স্থায়ী। অন্যদিকে সফট কপির চেয়ে হার্ডকপি অর্থাৎ বই থেকে পড়াটা বেশি কার্যকর। ফোন কিংবা ল্যাপটপ বা ডেস্কটপে পিডিএফ থেকে পড়ার সময় হাজারটা নোটিফিকেশনের যে বিড়ম্বনা, সেটা হার্ডকপি অর্থাৎ বই থেকে পড়ার সময় থাকে না। সত্যি সত্যি পড়ায় মনোযোগ ধরে রাখা সম্ভব হয়।
এখন থেকে মুঠোফোনে নোট নেওয়ার বদলে ডায়েরি কিংবা খাতায় নোট নাও। আর পিডিএফ বা সফট কপি না পড়ে হার্ডকপি থেকে পড়ার অভ্যাস করো।
গুছিয়ে প্রস্তুতি নিতে স্টিকি নোটস, মার্কার ও হাইলাইটার ব্যবহার করো—
ক্লাসে প্রায়ই টিচাররা বইয়ে গুরুত্বপূর্ণ টপিক বা ইনফরমেশন দাগিয়ে রাখার পরামর্শ দিতেন। আমার এক বন্ধু আবার বই দাগাতে বেশ ভালোবাসত। মনের সুখে বই দাগাতে গিয়ে পরীক্ষার আগের রাতে আবিষ্কার করত যে তার বইয়ে দুর্ভাগ্যজনকভাবে এমন কোনো লাইন বাকি নেই যেটার নিচে সে দাগ দেয়নি। তখন রিভিশন দিতে বেশ বেগ পেতে হতো তাকে।
তা তোমরা পড়ার সময় বই দাগিয়ে পড়ো তো? পড়ার সময় যখনই কোনো গুরুত্বপূর্ণ শব্দ, বাক্য বা তথ্য চোখে পড়বে, সব সময় সেটাকে হাইলাইটার বা অন্য রঙের কালি দিয়ে চিহ্নিত করে রাখবে। এটা পরে রিভিশনের সময় বেশ কাজে দেবে। তবে হ্যাঁ, দাগাতে গিয়ে আমার বন্ধুর মতো সারা বই রঙিন করে ফেলো না যেন। এমন যেন না হয় যে কোনটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আর কোনটা নয়, সেটাতেই গুলিয়ে যায়। আর যদি নতুন কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংযুক্ত করতে হয়, তখন স্টিকি নোটে লিখে বই কিংবা নোটে যুক্ত করে দিতে পারো। তথ্যের পরিমাণ বেশি হলে প্রয়োজনে অন্য রঙের কলম দিয়ে বইতে বা নোটে লিখেও রাখতে পারো।
এই স্টিকি নোটস, হাইলাইটেড পয়েন্টস আর অন্য কালিতে লেখা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোই রিভিশনের সময় চোখে পড়বে সবার আগে। এতে পরীক্ষার ঠিক আগমুহূর্তে রিভিশন দেওয়া সহজ হবে।
হারানো মনোযোগ ফেরাতে ‘Pomodoro Technique’ কাজে লাগাও—
স্কুল বা কলেজের ক্লাসগুলো কতক্ষণ ধরে হয়? একটানা ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা, তা–ই না? অধিকাংশ স্কুল বা কলেজেই মাঝখানে মিনিট ত্রিশেকের বিরতি দিয়ে অন্তত ৬ থেকে ৮টা করে ক্লাস হয় রোজ।
আমার তো এ রকমই হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে তো এর চেয়েও বেশি। মাঝেমধ্যে টানা ৩টা ক্লাসও হয়, তা–ও একেকটা আবার দেড় থেকে দুই ঘণ্টাব্যাপী। না মানে স্কুল-কলেজে ৪ ঘণ্টায় ৬-৮টা করে ক্লাস হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ ঘণ্টায় ২-৩টা ক্লাস হয়। টানা ক্লাস করতে গিয়ে এমন হতো যে শেষের দিকে টিচার কী পড়াচ্ছেন, সেগুলো একটানা বসে থাকার ক্লান্তি আর বিরক্তিতে ঠিকঠাক শোনা হতো না।
যেকোনো একটা ক্লাস কিংবা লেকচারের শুরুতে মনোযোগ বা আকর্ষণ থাকে একেবারে শীর্ষে অর্থাৎ চূড়ায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটা প্রতিনিয়ত কমতে থাকে। এটাই খুব স্বাভাবিক। এই লেখার কথা যদি বিবেচনা করা হয়, পাঠকের আকর্ষণ শুরুতে যতখানি ছিল, লেখার এ অংশে এসে এর চেয়ে অনেকখানি কমে গেছে এটা নিশ্চিতভাবে বলে দেওয়া যায়।
মনোযোগ ধরে রাখা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর মধ্যে একটি। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এটা প্রমাণিত যে মানব মস্তিষ্ক একটানা ২০-৩০ মিনিটের বেশি কখনো মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। এই সময়ের পর মনোযোগ ক্রমেই কমতে থাকে।
কিন্তু এই ক্রমেই কমে যাওয়া মনোযোগকে ফিরিয়ে আনারও উপায় আছে বৈকি। এই উপায়ের নামই হলো ‘Pomodoro Technique’। পড়া কিংবা যেকোনো কাজ করার সময় ২৫ মিনিট পরপর ৫-১০ মিনিটের ছোট্ট একটা বিরতি নেওয়া এবং এরপর আবার শুরু করার প্রক্রিয়াই হলো Pomodoro Technique। এতে আগ্রহ, মনোযোগ দুটোই ফিরবে।
এরপর থেকে মনোযোগ নিয়ে আর কখনো অভিযোগ নয়। ট্রাই করে দেখতে পারো Pomodoro Technique। আশা করি কাজে দেবে।
স্পেসড রিপিটেশন টেকনিক বাড়াবে স্মৃতিশক্তি—
আমার একটা বিদ্ঘুটে অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি একবার টানা চার ঘণ্টা ধরে পদার্থবিদ্যার গতিবিদ্যা অধ্যায়টা পড়ে শেষ করলাম। এরপর আব্বু যখন নিউটনের গতির দ্বিতীয় সূত্রটার গাণিতিক রূপ জানতে চাইলেন, তখন আর কিচ্ছু বলতে পারলাম না। এর পরের ঘটনায় নাহয় আর না গেলাম।
আচ্ছা, তোমাদের সঙ্গে কি কখনো এমন হয়েছে যে একটানা অনেকক্ষণ ধরে পড়েই যাচ্ছ? পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা, চ্যাপ্টারের পর চ্যাপ্টার। কিন্তু পড়া শেষে ঠিক মনেই করে উঠতে পারলে না এতক্ষণ ধরে পড়লে কী? আমার সঙ্গে কিন্তু এ রকম হতো মাঝেমধ্যে। এই সমস্যার একটা সমাধান হতে পারে,
‘পড়া-পড়া-পড়া’ নাকি ‘পড়া-বিরতি-পড়া’
একটানা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে যাওয়ার চেয়ে মাঝখানে বিরতি নিয়ে পড়লে সেই পড়া স্মৃতিতে অধিকতর স্থায়ী হয়। পড়ার মাঝখানে বিরতি নিয়ে পুনরায় পড়ার যে প্রক্রিয়া, এর নামই স্পেসড রিপিটেশন সিস্টেম। পড়া ভুলে যাওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করতে এই ট্রিকটি কাজে লাগানো যেতে পারে। আর বিরতিতে একটুখানি ঘুম স্মৃতিতে পড়ার স্থায়িত্ব বাড়াবে কয়েক গুণ। তাই ঘুমের ব্যাপারটা ভুলে গেলে চলবে না।
শিখতে হবে শেখাতেও—
আমি যখনই কোনো বই পড়ে নতুন কোনো আইডিয়া পাই কিংবা কারও কাছ থেকে কোনো পরামর্শ পাই অথবা নতুন কিছু শিখি, সব সময় চেষ্টা করি সেগুলো সবার সঙ্গে শেয়ার করতে, সবাইকে জানাতে। শেখাতে আমার বেশ ভালো লাগে। কিন্তু সামনাসামনি অনেককে একসঙ্গে শেখানোটা বেশ কঠিন বলেই আমি ভিডিও বানাই। তখন খুব আনন্দ হয়, যখন আমাকে কেউ টেক্সট করে কিংবা সামনাসামনি দেখা হলে বলে যে ‘ভাইয়া, আপনার অমুক ভিডিও দেখে আমি এটা শিখেছি।’ কিংবা ‘আপনার প্রেজেন্টেশনের প্লেলিস্ট দেখার পর থেকে আমার এখন আর প্রেজেন্টেশন দিতে ভয় করে না।’
তুমি কখনো নিজের কোনো বন্ধুকে পড়া বুঝতে সাহায্য করেছ? নিজে যেটা শেখো, সেটা অন্যকে শেখাতে পারো তো?
If you can’t explain it simply, you don’t understand it well enough.বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন
অর্থাৎ কেউ কিছু শেখার পরপর সেটা যদি অন্যকে শেখাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সে শেখায় ঘাটতি রয়েছে! আর যেকোনো জিনিস মনে রাখা কিংবা যেকোনো বিষয়ে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো অনুশীলন বা চর্চা। তাই এখন থেকে নিজে নতুন যা–ই শেখো না কেন, সেটা অন্যকে শেখানোর চেষ্টা করবে। তাহলেই সে শেখা অধিকতর স্থায়ী হবে। আর অন্যদিকে প্রতিনিয়ত চর্চার মাধ্যমে ঝালাই করে নেওয়া হবে কতটুকু শিখতে পেরেছ সেটাও।
তাই এখন থেকেই যেকোনো ক্লাসের যেকোনো বিষয়ের যে টপিকই পড়া হোক না কেন, চেষ্টা করবে সেগুলো চর্চার মধ্যে রাখার।
দক্ষতা বাড়াবে শেখার বাস্তবিক প্রয়োগ, হতে হবে ব্যবহারিক জ্ঞানেও জ্ঞানী—
আমার ‘পাওয়ারপয়েন্ট’ নামের কমলা রঙের অতি পরিচিত সফটওয়্যারটার প্রতি বেশ আগ্রহ ছিল একসময়। এখন যে নেই তা বলছি না। তা সেই আগ্রহের বশবর্তী হয়ে শিখে ফেললাম এই সাধারণ সফটওয়্যারটির খুঁটিনাটি। এরপর শুরু করলাম শেখানো। আমার পাওয়ারপয়েন্টে প্রেজেন্টেশন বানিয়ে উপার্জনের গল্প তো আগেই বলেছি কয়েকটি ভিডিওতে।
তা তোমরা স্কুল–কলেজের ব্যবহারিক ক্লাসগুলোতে নিয়মিত অংশ নাও তো? শিক্ষকের দেখিয়ে দেওয়া নির্দেশনামতো পরীক্ষাগুলো নিজেরা হাতে–কলমে করে দেখো তো?
জ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগে দক্ষতা বাড়ে। তাই বিজ্ঞানের জ্ঞান যেগুলোর বাস্তবিক আর ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্ভব, সেগুলো হাতে-কলমে প্রয়োগ করে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই শেখা উচিত। তাই বিজ্ঞানের যে জ্ঞানগুলো ব্যবহারিকভাবে প্রয়োগ করতে পারবে, সেগুলো সেভাবে প্রয়োগ করবে। পরীক্ষণগুলো করবে হাতে–কলমে। মনে রেখো, যখন যা–ই শেখো না কেন, সেটাকে যদি বাস্তবে ব্যবহারিক প্রয়োগ করতে পারো, তাহলেই সে শেখা পাকাপোক্ত হবে। এতে জ্ঞান আর দক্ষতা দুটোই বাড়বে। কোনো নতুন বই পড়লে বা মুভি দেখলে চেষ্টা করবে সেগুলোর রিভিউ লিখতে। সেগুলো থেকে নিজে কী বুঝলে বা শিখলে, সেটা সবাইকে বোঝানোর ক্ষমতা থাকতে হবে। কোনো সফটওয়্যার স্কিল শিখলে সেটাকে কাজে লাগাতে হবে ব্যবহারিকভাবে। তাই এখন থেকে যা–ই শেখো না কেন, সেগুলো বাস্তবিকভাবে প্রয়োগ করার চেষ্টা করবে। তাহলেই বাড়বে দক্ষতা। আর বলা যায় না, কখনো কখনো পেয়ে যেতে পারো উপার্জনের সুযোগও।
পড়াশোনা যেন না হয় আর কোনো প্যারার কারণ। এবার বোরিং পড়াশোনাকে করে ফেলো আনন্দের। Study smart not hard। এর পরের কোনো ইভেন্টে তোমাদের কাছ থেকে পড়াশোনা নিয়ে তোমাদের আনন্দময় অভিজ্ঞতার কথা শোনার অপেক্ষায় রইলাম। সবার জন্য শুভকামনা আর ভালোবাসা।