পড়ার সময় পড়া খেলার সময় খেলা

ছবি: সুমন ইউসুফ

আমার ছোটবেলা কেটেছে রংপুরে। আমরা ছিলাম পাঁচ ভাইবোন। আমি চার নম্বর। আমার আম্মা চাইতেন তাঁর ছেলেমেয়েদের যেন রেজাল্ট ভালো হয়। সে জন্য তিনি নিজেই পড়াতেন আমাদের। অঙ্ক করাতেন, গ্রামার শেখাতেন। আম্মার বিশেষ যত্নের কারণে আমাদের বড় ভাই ক্লাসে ফার্স্ট হতে লাগল। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেল, ক্লাস এইটে বৃত্তি পেল। এরপর আমাদের বাকি চারজনকে বড় ভাইয়ের রাস্তা ধরতে বাধ্যই করা হলো প্রায়।

কিন্তু আম্মার তিনটা আদেশ ছিল। তিনি বলতেন, আমার সব ছেলেকেই তিনটা জিনিস পারতেই হবে। এক. সাইকেল চালানো। দুই. গাছে চড়া। তিন. সাঁতার কাটা।

তোমরা ভাবছ, এ আর এমন কী। আমরা তো ছোটবেলা থেকেই সাইকেল চালাতে জানি। আমাদের সময়ে ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না। কারণ ছোট ছোট সাইকেল আমাদের কিনে দিত না কেউ। আমাদের সময়ে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না। বাড়তি কিছু ছিল না কোনো পরিবারেই। আমাদের সবারই শার্ট থাকত একটা, বড়জোর দুটো, প্যান্টও দুটোর বেশি না। ছোটবেলায় ছোট সাইকেল আমাদের পুরো এলাকাতেই কারও ছিল না। আমরা বড়দের বড় সাইকেল চড়তে শিখতাম। কারও কাছ থেকে সাইকেল চেয়ে নিয়ে প্র্যাকটিস করতাম মাঠে। প্রথমে ছিল হাফ প্যাডেল। সাইকেলের সিটে তো আর উঠতে শিখতাম না। কারণ, আমরা এতটুকুন, সাইকেল তার চেয়ে অনেক বড়। সিটে বসলে পা প্যাডেলের নাগাল পাবে না। তাই আমরা সাইকেলের নিচে চড়তাম। মানে হলো, সাইকেলের তিন কোনা রডের বাঁ পাশে একটা পা, আরেকটা পা ডান পাশে দিয়ে ঘোরাতাম প্যাডেল। এমনি করে প্র্যাকটিস করতে করতে দক্ষ হয়ে যেতাম আমরা। আমাদের এক হাত থাকত বাঁ হাতলে, এক হাত থাকত সাইকেলের ওপরের রডে, ডান বগলের নিচে থাকত সিটটা। তারপর যখন আরেকটু লম্বা হয়ে গেছি, তখন সাইকেলের সিটে বসে আমরা সাইকেল চালানো শিখতাম। শিখতে গিয়ে পড়ে যেতাম, অবশ্যই হাঁটু ছিলে যেত। দাঁতও ভেঙে যেত কারও কারও।

আর গাছ ছিল আমাদের প্রিয় জায়গা। আমার একটা প্রিয় জামগাছ ছিল। বেশ বড়সড়। সেই জামগাছের ওপরে দুটো ডাল পাশাপাশি এমনভাবে ছিল যে, সেখানে উঠে শুয়ে-বসে সময় কাটানো যেত। আমি আর আমার দুই বছরের বড় বোন সেই গাছের ডালে উঠে আরামে বসে থাকতাম, শুয়ে থাকতাম। গল্প করতাম। বড় বড় পিঁপড়া মাঝেমধ্যে কামড়ে হাতের তালু লাল করে দিত। আমাদের বাড়ির সামনে পিটিআই স্কুল। স্কুলে বড় মাঠ। মাঠে দুটো বটগাছ ছিল। মাঝারি বটগাছ। সেই বটগাছে আমরা ১০-১২ জন বালক-বালিকা উঠে পড়তাম। একটা খেলা আমরা নিজেরাই আবিষ্কার করেছিলাম। গাছচুন্নি। একজন থাকবে গাছের নিচে। বাকিরা থাকবে গাছের ডালে। গাছের নিচে একটা রুমাল বা গাছের ডালের টুকরা থাকবে। যে নিচে আছে, সে সেই রুমালটা পাহারা দেবে। আর যারা ওপরে আছে, তাদের কাজ হবে গাছ থেকে নেমে রুমালটা চুরি করে আবার গাছে উঠে পড়া। কিন্তু যে নিচে আছে, সে যদি ছুঁয়ে ফেলে, তাহলে যাকে ছোঁয়া হবে, সে আবার হবে চোর। রুমাল চুরির মতোই এই খেলাটা। আমরা বাঁদরের মতো গাছের ডাল থেকে ঝুপঝুপ করে তিন–চারজন একসঙ্গে মাটিতে নামতাম। চোর আমাদের ধাওয়া করত। কতজনকে করবে। আরেকজন গিয়ে রুমালটা নিয়ে গাছে উঠে পড়ত।

আম্মার তিনটা আদেশ ছিল। তিনি বলতেন, আমার সব ছেলেকেই তিনটা জিনিস পারতেই হবে। এক. সাইকেল চালানো। দুই. গাছে চড়া। তিন. সাঁতার কাটা।

আমি অনেক বড় হয়ে আমার মেয়েকে নিয়ে রংপুরে ফিরে ওই মাঠে গিয়েছিলাম। মেয়ে আর তার মা মাঠে হাঁটছে। আর আমি সেই গাছে গিয়ে উঠে বসেছিলাম।

আর সাঁতার কাটা। আমাদের তো আর সুইমিংপুল ছিল না। পুকুর ছিল এখানে–ওখানে অনেক। তবে আমি সাঁতার শিখেছি আমাদের দাদার বাড়িতে। ওখানে প্রতি বর্ষায় বন্যা হতো। আমাদের দাদাবাড়ির উঠানে উঠত পানি। সেই নদীতেই গোসল করতে হতো। বন্যার পানিতে গোসল করতে করতে কখন যে সাঁতার শিখে ফেলেছি, নিজেই জানি না।

গাছে চড়ে একবার খুব বিপদে পড়েছিলাম। আমাদের দাদাবাড়ি গিেয়ছি গ্রীষ্মের ছুটিতে। মড়াঘাটি নামে একটা জায়গা ছিল। বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে। নদীর ধারে। সেখানে নাকি আগে শ্মশান ছিল। সেই গাছগাছড়া জঙ্গলভরা জায়গায় আমাদের তিনটা আমগাছ ছিল। বেশ বড়সড় আমগাছ। একদিন দুপুরবেলা। চারদিকে রোদ ঝাঁ ঝাঁ করছে। মনে হচ্ছে, এ যেন এক তেপান্তরের মাঠ। আমি একা গেছি মড়াঘাটিতে। একটা আমগাছের অনেক উঁচু একটা নিঃসঙ্গ ডালের একেবারে শেষ মাথায় একটা পাকা আম। আমি গাছে উঠে পড়লাম। সরীসৃপের মতো বুকে বেয়ে আমি পৌঁছে গেলাম সেই ডালের মাথায়। আমটা হাতে নিলাম। এবার নামব কী করে! অনেক উঁচুতে উঠে গেছি। আর এই ডালটার কোনো শাখা–প্রশাখা নেই, যেটা ধরে বা যেখানে পা দিয়ে নামতে পারি। আমি আমটা নিচে ফেলে দিলাম। এখন আর নামতে পারছি না। আশপাশে কেউ নেই যে আমি ডেকে সাহায্য চাইব। সাহায্য চাইলেও কীভাবে সাহায্য করবে? আমি ভয়ে কাঁদতে লাগলাম। নিচে তাকিয়ে দেখি, ও রে বাবা গো, অনেক উঁচুতে উঠে গেছি। খানিকক্ষণ কেঁদে-কেটে সাহস করে আস্তে আস্তে বুকে বেয়ে ডালটা জাপটে ধরে নিচে নামছি। ধীরে ধীরে। প্রায় ১৫ মিনিট নামার পর আরেকটা ডালের দেখা পাওয়া গেল। সেখানে পা রেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এরপর আর ভয় নেই।

ছবি: সুমন ইউসুফ

নদীতেও একবার বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম। গ্রামের বাড়িতেই। আমি একটা নৌকা নিয়ে একা বাইছি। আমি বইঠা বাইতে পারি। লগি ঠেলতে পারি। ধরো, তখন আমার বয়স ১০। খুব বন্যা হচ্ছে। পানি প্রবল বেগে বইছে।

এ রকম বন্যায় আমি আর আমার বন্ধু অতুল নৌকা নিয়ে প্রায় এক মাইল চওড়া নদী পার হয়ে ওপারে গেছি। নদীর ওই পাড়ে একটা হাঁসের ডিম কুড়িয়ে পেলাম। সেটা নিয়ে এসে ভেজে খাওয়াও সারা। কিন্তু আজ আমি নৌকা নিয়ে বেরিয়েছি একা।

একটা জায়গায় নদীর প্রবল স্রোত ঘূর্ণি পাকাচ্ছে। নদীর ওই পাড়ে একজন পথিক আমাকে ডাকছেন। খোকা, নৌকাটা নিয়ে এসো। আমাকে পার করে দাও। আমি নৌকা নিয়ে ঘূর্ণিস্রোতের জায়গাটা পার হতে চাইছি। কিন্তু এত স্রোত আর এত ঘূর্ণি যে ওইখানে গিয়ে নৌকা বনবন করে ঘুরতে লাগল। বইঠা দিয়ে নৌকার হাল ধরে আছি। কিন্তু সামলাতে পারছি না। কোনোরকমে খানিকটা এগোলাম। তখন ওই পথিক গলাপানিতে নেমে এসে আমার নৌকার মাথা ধরলেন।

আমার আম্মা আমাদের লেখাপড়ার ব্যাপারে যত্ন নিতেন। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন; বরং বাধ্য করেছিলেন কতগুলো বাইরের কাজ করতে।

আমার আব্বা ছিলেন শিশুমনোবিজ্ঞানের শিক্ষক। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের তিনি শিশুমনোবিজ্ঞান পড়াতেন। আব্বা বলতেন, শিশুকে প্রকৃতির বুকে ছেড়ে দাও। প্রকৃতিই শিশুকে শিক্ষা দেবে।

আব্বা বলতেন, কোনো বাচ্চাকে কেউ মারধর করতে পারবে না।

আব্বা আমাকে খুব উৎসাহ দিতেন ছবি আঁকায়, কিংবা লেখালেখিতে। আমি হয়তো কোথাও গিয়ে উপস্থিত বক্তৃতা করে একটা পুরস্কার পেয়েছি। আব্বা বলতেন, বাবা, কী বললা, বলো তো। আমি পুরোটা আবার বলতাম। আব্বা বিস্মিত হয়ে বলতেন, তুমি এইসব কথা বলতে পারলা!

আর আমার আব্বা বলতেন, বই পড়ো। পৃথিবীতে খারাপ বই বলতে কিছু নেই। বই কখনো খারাপ হয় না।

আব্বার অফিসের লাইব্রেরিতে আমাদের ছিল অবাধ প্রবেশাধিকার। আমরা প্রচুর বই তুলে নিয়ে আসতাম প্রতি সপ্তাহে। আমার প্রিয় ছিল রূপকথার গল্প। ধরো, তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। গল্পের বই নিয়ে এসে রূপকথার গল্পগুলো আমি সবার আগে পড়ে শেষ করতাম।

আমাদের সবজির বাগান ছিল। ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটোর চারা লাগানো হতো। সকালে–বিকেলে চারা গাছগুলোতে পানি দিতে হতো। আর কলাগাছের বাকল কেটে আমরা চারা গাছগুলোর ছায়ার ব্যবস্থা করতাম। সকালবেলা শিশিরে গাছগুলোর পাতা ঝলমল করত। ঘাসের গায়ে শিশির জমে থাকত।

আর ছিল খেলা। বেলা তিনটা হওয়ার আগেই ফুটবল নিয়ে মাঠে গিয়ে হাজির। দেয়ালে জোরে জোরে বল মারতাম, যাতে শব্দ হয়। পাড়ার সব বন্ধু আওয়াজ শুনে মাঠে আসে। আসতও। আমরা দুই ভাগে ভাগ হতাম। ‘রাজা রাজা বেলি, এসো ভাই খেলি’ বলে দুই ভাগ হতে হতো।

আব্বা বলতেন, শিশুকে প্রকৃতির বুকে ছেড়ে দাও। প্রকৃতিই শিশুকে শিক্ষা দেবে।

যতই খেলো না কেন, মাগরিবের আজান হলো তো বাসায় ফিরতেই হবে। গিয়ে হাত–মুখ ধুয়ে পড়তে বসো।

আমাদের ছোটবেলা ছিল প্রচুর খেলার, প্রচুর ছোটাছুটি করার, প্রচুর বই পড়ার। পরীক্ষা ব্যাপারটাও ছিল, কিন্তু আজকের ছেলেমেয়েদের মতো সারাক্ষণ পড়া, সারাক্ষণ হোমওয়ার্ক করার মতো কঠিন ছিল না। আমরা একা একা হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতাম। বই থাকত হাতে। হাতের ঘামে বই–খাতা ভিজে যেত। স্কুলব্যাগ বলতে কিছু ছিল না আমাদের প্রায় কোনো ছাত্ররই। আমাদের কেউ স্কুলে নিয়ে যেত না, স্কুল থেকে নিয়ে আসত না। অত গাড়িঘোড়াও তো ছিল না যে বিপদ-আপদ ঘটবে।

আমাদের ছোটবেলায় রংপুরে টেলিভিশন ছিল না। রেডিও ছিল। আমরা রেডিওতে গান শুনতাম। নাটক শুনতাম।

এখন তোমাদের আমরা কী করতে বলব?

আমাদের সময়ে আমরা বলতাম: পড়ার সময় পড়া, খেলার সময় খেলা।

তোমাদের বলি, পড়ার সময় পড়া। সারাক্ষণ পড়তে হবে না। বাইরের বই পড়ো প্রচুর পরিমাণে। দৌড়ঝাঁপ করো। সারাক্ষণ মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকো না। সারাক্ষণ ভিডিও গেমস নিয়ে মেতে থেকো না।

সাইকেল চালাও।

সাঁতার কাটো।

না হলে দৌড়াও।

ফুটবল, বাস্কেটবল, টেবিল টেনিস খেলো।

আর প্রচুর ছড়া-কবিতা মুখস্থ করে ফেলো। রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটা সবারই মুখস্থ থাকা চাই। কাজী নজরুল ইসলামের ‘লিচুচোর’ সবাইকে মুখস্থ বলতে পারতে হবে। শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটাও মুখস্থ করে ফেলো।

শুধু জিপিএ–৫ পেলে কোনো লাভ নেই। পরীক্ষার রেজাল্ট মোটামুটি ভালো, আর অন্য অনেক বিষয়ে তুমি অংশ নিচ্ছ, যা ভালো লাগছে—গান, কবিতা, খেলা, বাগান করা, ছবি আঁকা, ঘুরে বেড়ানো, বিতর্ক-বক্তৃতা-নাটক, ফটোগ্রাফি—এসব করছ, যা ভালো লাগে, সেটা, তাহলে তুমি অনেক বড় হবে।

কিছু না পারো, জানালা দিয়ে তাকিয়ে আকাশ দেখো। দূরের গাছটা দেখো। নীল আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। কত রকমের আকার নিচ্ছে। সবুজ মাঠের দিকে তাকাও। না হলে যেকোনো একটা গাছের পাতার দিকে খেয়াল করে তাকাও। কত রূপ, কত আকার, কত রং। তুমি বলো:

তোমরা যখন শিখছ পড়া মানুষ হওয়ার জন্য,
আমি না হয় পাখিই হব, পাখির মতো বন্য।

মডেল: নওশিন, অমিত্রাক্ষর, তা-সীন, লাবণী ও জাসিয়া।