২২ আগস্ট ২০১৪, শুক্রবার বেলা ১১টা বেজে ২৬ মিনিট। আমাদের ছোট্ট দলটা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের গেটে দাঁড়িয়ে। উদ্দেশ্য ছিল হেঁটে পুরান ঢাকার অলিগলিসহ বিভিন্ন বিখ্যাত স্থাপনা পরিদর্শন। তখনো কেউই জানতাম না পরমুহূর্তেই ব্যাপক উত্তেজনা অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য। আমাদের ভ্রমণ শুরু হওয়ার কথা ঠিক বেলা ১১টায়। কিন্তু ইতিমধ্যেই আমাদের ২৬ মিনিট দেরি আর হাঁটা শুরু করতে করতে সাড়ে ১১টা বেজেই গেল। আমাদের প্রথম গন্তব্য হোসেনি দালান। নাজিমুদ্দিন রোডে এসে হাতের ডানে ঘুরলেই সরু একটা পথ চলে গিয়েছে হোসেনি দালানে। এখানকার বিখ্যাত ইমামবাড়ায় প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল মসজিদসংলগ্ন ছোট্ট পুকুর। ভূমি থেকে খানিকটা উঁচু মসজিদটির বারান্দায় গিয়ে পুকুরে উঁকি দিলেই দেখা মিলবে শত শত মাছের আনাগোনা। সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো মসজিদের ভেতরেই এক পাশে রয়েছে মাজার শরিফ। এখানে এলে মসজিদের নিয়মকানুনের প্রতি কিন্তু অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে।
হোসেনি দালান থেকে বের হয়েই শুরু হয় আমাদের বিভিন্ন অলিগলির মধ্যে হারিয়ে যাওয়া। পথে চলতে চলতে একটু চাপা গলি দেখলেই আমরা হইহই করে দৌড়ে গলির অন্য মাথা পর্যন্ত চলে গিয়েছি। পুরান ঢাকায় প্রায়ই চোখে পড়বে পুরোনো আমলের বাড়িঘর। তাই যখনই কোনো পুরোনো দালান চোখে পড়েছে, থমকে দাঁড়িয়েছি। গভীর মনোযোগে দেখেছি এর নকশা। আবার অতি আগ্রহবশত এক পুরোনো বাড়িতে ঢুকতে গিয়েই তো বাড়ির মালিকের কাছে খেলাম বকা। হ্যাঁ, এটাও একটা সতর্কতা, কৌতূহল মেটাতে হুট করে কারও বাড়িতে ঢুকে যাওয়া অবশ্যই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তবে সম্ভব হলে বাড়ির মালিকের অনুমতি সাপেক্ষে বাড়িটি ভালোভাবে ঘুরে দেখা যেতেই পারে।
এ রকম উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করতে করতেই আমরা এসে পড়েছিলাম আরমানিটোলার বিখ্যাত তারা মসজিদের সামনে। পাশেই বেশ পুরোনো লাল ইটের সুন্দর নকশায় বাঁধাই করা আরমানিটোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়। তারা মসজিদ খুব একটা বড় না হলেও এর অসাধারণ সৌন্দর্য তোমার নজর কাড়তে কোনো ছাড় দেবে না। যেহেতু শুক্রবার, তাই জুমার নামাজটা আমরা এখানে সেরেই শুরু করি আহসান মঞ্জিলের উদ্দেশে যাত্রা। তবে এখানে আবার আরেক সমস্যা, আমাদের কারোরই আহসান মঞ্জিলের রাস্তা কোন দিকে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। হাতে স্মার্টফোন থাকলেও জিপিএস ব্যবহার করে গন্তব্যের রাস্তা না খুঁজে রাস্তার ধারের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতেই এগিয়ে যাব বলে ঠিক করলাম। আর এভাবে কিছুদূর এগোতেই সামনে পড়ল আর্মেনিয়ান চার্চ। তবে ঘুরতে ঘুরতে মন খারাপ হলো অসাধারণ এই চার্চের সামনে এসেই। চার্চ যে সেদিন বন্ধ, সে কথা কার জানা ছিল! আর্মেনিয়ান চার্চ জনসাধারণের জন্য খোলা থাকে শুধু রোববার। তাই মন খারাপ করেই সেখান থেকে চলে এলাম আহসান মঞ্জিলে।
আহসান মঞ্জিলের গেটে তখন প্রবেশ টিকিট কেনার জন্য পর্যটকদের লম্বা সারি। তবে সেই সারি পেরিয়ে টিকিট পেতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না আমাদের। টিকিট জনপ্রতি মাত্র দশ টাকা। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতেই আহসান মঞ্জিল জাদুঘর। ঢাকার নবাবদের এই বাসভবনে তাদের ব্যবহার্য দৈনন্দিন জিনিসপত্র নিয়েই তৈরি হয়েছে জাদুঘরটি। আহসান মঞ্জিলের প্রতিষ্ঠাতা নওয়াব আবদুল গনি তার পুত্র খাজা আহসানউল্লাহর নামানুসারে এর নামকরণ করেন। এর নির্মাণকাল ১৮৫৯-১৮৭২ সাল।
অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন এই আহসান মঞ্জিল ঘোরা শেষ করে বেরোতেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। সামনেই সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল আর আহসান মঞ্জিলের মূল ভবনের বাইরে সিঁড়ি থেকেই দেখা যাচ্ছে লঞ্চের চলাচল। আমাদের আনন্দ আর দেখে কে, সবাই লাফিয়ে বের হয়ে পড়লাম নৌকায় চড়ব বলে। ঘাটেই নদী পারাপারের জন্য অনেক নৌকা অপেক্ষা করতে দেখা গেল। আর নৌকায় উঠেই আরও অবাক। বুড়িগঙ্গা নদী বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে কালো কুচকুচে কালো আর দুর্গন্ধযুক্ত নোংরা পানির ছবি। কিন্তু এ যে পুরো পরিষ্কার। দুর্গন্ধের ছিটেফোঁটাও নেই। মাঝির কাছ থেকেই জানা গেল, বর্ষার সময় নদীর পানি পরিষ্কার হয়ে যায়।
বুড়িগঙ্গা নদীর রূপ পুরোই বদলে গেছে যেন। গান গাইতে গাইতে বেশ কিছুক্ষণ নৌকায় ঘুরে আমরা যখন তীরে উঠলাম, ততক্ষণে ঘড়িতে সময় বিকেল পৌনে পাঁচটা আর ক্ষুধায় আমাদের অবস্থা তখন বারোটা। তাই আর দেরি না করে দ্রুত রওনা দিলাম আলাউদ্দিন রোডের হাজির বিরিয়ানির উদ্দেশে। না, এবার আর হাঁটা নয়। এবার ছিল রিকশাভ্রমণের পালা। এখানে পেটপুজো সেরে আরেকটু সামনে পুরান ঢাকার বিখ্যাত বিউটি লাচ্ছির দোকানে আমরা হাজির হলাম লাচ্ছি আর লেবুর শরবত দিয়ে গলা ভেজানোর জন্য। সেখানে বসেই আমরা চিন্তা করছিলাম অসাধারণ এই দিনটি কীভাবে কাটালাম তা নিয়ে। যান্ত্রিক এই জীবনে পড়ালেখা, স্কুল-কলেজে, এই কোচিং সেই কোচিংয়ের ভিড়ে সামান্য বিনোদনের সময়টুকুও খুঁজে পাওয়া যায় না। সে জন্য অনেক দূরে কোথাও ভ্রমণে যাওয়া ঝামেলা মনে হলে হুটহাট কাছে কোথাও গিয়ে ঘুরে আসাই যায়।