তোমার সঙ্গেও কি এমন হয়?

জোরে চিৎকার, বকাবকি করা শিশুর জন্য ক্ষতিকর
‘মা-বাবা শুধু আমাকে বকা দেয়, ভালোই বাসে না’ তোমার কি এমন মনে হয়? মনে হলে খুব বিনয়ের সঙ্গে তোমার অভিভাবককে বলো এই লেখাটা পড়তে। আর তুমি তো পড়বেই।

আমার বাচ্চাটা কথাই শোনে না, খায় না ঠিকমতো, ঘুমায় না, পড়াশোনাও নেই। এটা যেন জগতের সব বাবা-মায়ের সাধারণ উক্তি। সন্তান যেন পৃথিবীর সবচেয়ে অবাধ্য প্রাণী!

কিন্তু কী আর করা! শিশুকালটাই এমন। ছোটরা কি বোঝে কোন খাবারে কতটুকু ভিটামিন? কিংবা নামতা মুখস্থ করে কী হবে? তাই বেড়ে ওঠার এই সময়টাতে পুরো দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয় অভিভাবককেই। শিশু-কিশোরদের প্রতি এমন আচরণ করা ঠিক নয়, যা শৈশব-কৈশোর থেকে শুরু করে পরিণত বয়স, এমনকি সারা জীবন ভোগাবে। আমার এক প্রতিবেশীর কথাই বলি। তার একমাত্র সন্তানের মূল সমস্যা কথা শোনে না। তাই ছেলেকে জোর করে কথা শোনানোর জন্য কণ্ঠস্বর উঁচুতে উঠতে উঠতে আমাদেরও কান ঝালাপালা। দাঁতে-দাঁত চেপে, মুখ খিঁচে এমন চিৎকার করে বাচ্চাকে বকাঝকা শুরু করেন যে আমার নিজেরই অস্থির লাগে। একটা শিশু কীভাবে সহ্য করবে এমন চিৎকার-চেঁচামেচি, বকাঝকা! তাই মা-বাবাকে বলছি, শিশুদের আদর করবেন, শাসন করবেন। কিন্তু তাদের অতিরিক্ত বকাঝকা-চিৎকার-চেঁচামেচি করবেন না। এর ফল মোটেও ভালো হয় না।

আত্মবিশ্বাস

যে শিশুদের সারাক্ষণ বকাবকির মধ্যে রাখা হয় আর অন্যদের সঙ্গে তুলনা করা হয়, নিজেদের প্রতি আত্মবিশ্বাস কমে যায় তাদের। ‘দেখো, অমুক কত লক্ষ্মী, ঠিকমতো পড়াশোনা করে, আর তুমি ডাব্বা। তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না।’ এসব কথা শুনতে শুনতে তাদের মধ্যে একধরনের হতাশা কাজ করে। নিজেদের অযোগ্য মনে করে তারা। পৃথিবীতে তারা যে বড় কিছু করতে পারে, এমন চিন্তা করার মতো মানসিকতা নষ্ট হয়ে যায়।

ভয়

ধীরে ধীরে শিশুদের মনে অজানা একধরনের ভয় এসে বাসা বাঁধে। নিজের ভেতর গুটিয়ে নেওয়ার প্রবণতা চলে আসে তাদের মধ্যে। ভেতরে-ভেতরে কষ্ট পেলেও কারও সঙ্গে সহজভাবে মিশতে পারে না। বন্ধুত্ব করতে পারে না। যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেদের বেশ দুর্বল আর অসহায় মনে করে তারা।

আক্রমণাত্মক মনোভাব

তারপর সেই শিশুর বয়স যখন চার-পাঁচ বছরে এসে পৌঁছায়, তখন তাদের মধ্যে লক্ষ করা যায় একধরনের আক্রমণাত্মক আচরণ। কাউকে সহ্য করতে না পারলে বা অনেক সময় কোনো কারণ ছাড়াই অন্য কাউকে ধাক্কা দেয়, কোনো কিছু দিয়ে আঘাত করতে চায় বা কামড়ে দিতে চায়।

মনোযোগের সমস্যা

একটা সময়ে এসে দেখা যায়, যত জোরেই চিৎকার করে বকা দেওয়া হোক না কেন, শিশুর মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে না। যেন সে পাত্তাই দিচ্ছে না আর। ‘অ্যাই টিভি বন্ধ কর, বলছি বন্ধ কর এক্ষণ।’ আপনার হুংকারে হয়তো বাড়ি কাঁপছে, কিন্তু শিশু নির্বিকারভাবে টিভির সামনে বসেই আছে। রাগে আপনার গা কাঁপছে। কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন না যে আপনার আচরণের কারণেই তার এই হাল। আপনি আপনার সন্তানের মনোযোগের বারোটা বাজিয়েছেন।

কোনো বাবা-মা’ই ঘুম থেকে উঠে পরিকল্পনা করেন না যে আজ সারা দিন সন্তানদের বকাঝকা করবেন। কিন্তু অনেক সময়ই পরিস্থিতির কারণে মেজাজ খিঁচড়ে যায়। বকাবকির উত্তাপে সন্তানদের মন যেমন খারাপ হয়, তেমনি তাদের বকা দিয়ে বাবা-মা’ও অনুতপ্ত হন, কিন্তু প্রায় সময়ই প্রকাশ করতে পারেন না।

চিৎকার কমানোর জন্য কী করা যায়?

  • ‘আমি কখনোই চিত্কার করব না’ বললেই তো সমাধান হয় না। বাস্তবতা ও পারিপার্শ্বিকতার দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।

  • শিশুকে শাসন করারও একটা মাত্রা আছে। অশ্রাব্য ভাষায় গালি দেওয়া বা ভীষণ জোরে চিৎকার, বকাবকি করা শিশুর জন্য ক্ষতিকর।

  • পারিবারিক জীবনটা আবেগ-অনুভূতিতে ভরপুর। অনেক সময়ই নানা ধরনের মানসিক চাপ কাজ করে। সে জন্য পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া থাকা খুব প্রয়োজন।

  • যেই পরিস্থিতি বা ঘটনাগুলো আপনার মেজাজটাকে বিগড়ে দেয়, চিৎকার করতে উৎসাহিত করে, সেসব পরিস্থিতি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে।

  • দিন শেষে নিজের মনে মনেই একটা হিসাব কষে নিন, সারা দিনে কতবার আপনি আপনার সন্তানের প্রশংসা করেন আর তাকে বকাঝকাই বা করেন কতবার।

যদি চিৎকার করে বকাঝকা করেই ফেলেন

  • সন্তানকে বুঝিয়ে বলুন যে আপনার ভুল হয়েছে এবং আপনি ভীষণ দুঃখিত।

  • পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঝগড়া হতেই পারে। সন্তানকে আড়ালে রেখেই এসব পারিবারিক বিবাদ মীমাংসা করুন।

  • সন্তানের জন্য ক্ষতিকর এমন কিছু বলা থেকে সচেতনভাবে বিরত থাকুন।

  • কখনোই গালাগাল করবেন না। তাদের মমতা দিয়ে বুঝিয়ে বলতে হবে যে আপনি শুধু তার এই আচরণটা পছন্দ করছেন না। কিন্তু আপনি অনেক ভালোবাসেন তাকে।

  • কখনো সন্তানও আপনার সঙ্গে রেগে চিৎকার করতে পারে। আপনি নিজেকে তার অবস্থানে রেখে চিন্তা করুন। তারপর পরিস্থিতি বিবেচনা করে বুঝিয়ে বলুন।

  • প্রয়োজনে তাকে গল্প শুনিয়ে, আদর দিয়ে বা উপহার দিয়ে বোঝাতে হবে।

প্রয়োজনে বাচ্চাদের গল্প শুনিয়ে, আদর দিয়ে বা উপহার দিয়ে বোঝাতে হবে

বকাবকি বাদ দিয়ে বলুন কতটা ভালোবাসেন

  • সন্তানদের প্রায়ই বলুন, আপনি তাদের কতটা ভালোবাসেন, কতটা গর্ববোধ করেন তাদের জন্য।

  • আপনার কাজে তারা সাহায্য করলে যে আপনি খুশি হন, সেটাও বলুন তাদের।

  • সব সময় তাদের উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করুন।

  • সন্তানদের বুঝতে দিন যে জীবনে ভুল করারও প্রয়োজন আছে। কারণ, ভুল থেকেই মানুষ শেখে।