তোমরা যারা গবেষক হতে চাও

গবেষণা। শুনলেই মনে হতে পারে খটোমটো এই ব্যাপারটা বুঝি কেবল ভারী চশমা পরা গুরুগম্ভীর বিজ্ঞানীদের জন্যই প্রযোজ্য। অথবা উঁচু ক্লাসে, পিএইচডি করা শিক্ষার্থীদের জন্য। কিন্তু না, একটা গোপন কথা ফাঁস করে দিই কানে কানে, গবেষণা করার কাজটা আসলে যে কেউই করতে পারে, কেবল কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। এই লেখাটা সেসব খুদে বিজ্ঞানীর জন্য, যারা এখন স্কুল বা কলেজে পড়ছ। এই লেখায় আলোচনা করব খুদে বিজ্ঞানীরা স্কুলে-কলেজে থাকার সময়ে কী করে করবে গবেষণায় হাতেখড়ি।

কেন করবে গবেষণা?

স্কুল বা কলেজে থাকার সময়ে পড়ালেখার বা একাডেমিক কাজের জন্য তোমার গবেষণার দরকার হবে না। কিন্তু তাহলে কেন গবেষণার কথা ভাববে? আসলে সব গবেষণা কিন্তু একাডেমিক কাজের জন্য না, বরং গবেষণা জড়িয়ে আছে আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রেই। গবেষণা শব্দটাকে গালভরা ভারিক্কি কিছু না ভেবে বরং ভেবে নাও তোমাদের কৌতূহল মেটানোর কৌশল হিসেবে। আর সব গবেষণা কিন্তু জটিল বিজ্ঞান বা প্রকৌশলের ওপরে না। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি প্রশ্নের জবাব সহজেই দিতে পারে গবেষণার পদ্ধতি।

গবেষণা কীভাবে করে?

গবেষণার উদ্দেশ্য হলো কোনো একটি প্রশ্নের জবাব বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খুঁজে বের করা। সে জন্য যে ধাপগুলো এক এক করে অতিক্রম করতে হয়, তা হলো ১. প্রশ্ন করা ২. সম্ভাব্য জবাব কী হতে পারে তা লিখে ফেলা ৩. জবাব খুঁজে বের করার জন্য পড়াশোনা করা ও পরীক্ষণ কিংবা অনুসন্ধান চালানো ৪. কোন সম্ভাব্য জবাবটি সঠিক সেটা এই অনুসন্ধান বা পরীক্ষণ থেকে বের করে সিদ্ধান্ত নেওয়া।

চলো, বেশ কয়েকটা উদাহরণ থেকে হাতে-কলমে শিখে ফেলি গবেষণার ব্যাপারটি।

মেসি নাকি রোনালদো?

একটা উদাহরণ দিই। ধরা যাক, তোমার বন্ধুদের আড্ডায় আলোচনা হচ্ছে, কে বেশি জনপ্রিয়, মেসি নাকি রোনালদো। তর্ক আর গলাবাজিতে না গিয়ে খুব সহজেই গবেষণা করতে পারো এটার ওপর। এ ক্ষেত্রে ধাপগুলা কী হতে পারে দেখা যাক—শুরুতেই আমাদের লিখে ফেলতে হবে হাইপোথিসিস বা অনুকল্প। ওরে বাবা, সেটা আবার কী? হাইপোথিসিস বা অনুকল্প হলো একটা সম্ভাব্য ঘটনা, যা আমরা যাচাই করতে চাচ্ছি।

মেসি-রোনালদোর জনপ্রিয়তার হাইপোথিসিস বা অনুকল্প—

১. মেসি বেশি জনপ্রিয়

২. রোনালদো বেশি জনপ্রিয়

৩. দুজনের জনপ্রিয়তায় খুব একটা তফাত নেই।

এই তিনটা সম্ভাবনা আছে এই বিষয়ে। এবার তোমার কাজ হবে অনুসন্ধান। প্রথমেই ঠিক করে নিতে হবে জনপ্রিয়তার মাপকাঠি কী। হতে পারে, সেটা কারও ফেসবুক পেজে কত লাইক অথবা কার নামে গুগল সার্চে বেশি ফলাফল আসে। কিংবা তোমার পাড়া প্রতিবেশীর ১০০ জনকে প্রশ্ন করে কে কাকে সাপোর্ট করে তার জরিপ। এ রকম বেশ কিছু মাপকাঠি ঠিক করে সেই জিনিসগুলো তোমাকে মেপে দেখতে হবে, খাতা-কলমে। ধরা যাক, তোমার মাপকাঠি হলো এই তিনটার মিশ্রণ, মানে ৫০% গুরুত্ব দেবে জরিপের ওপরে, ৩০% দেবে ফেসবুক লাইকের হিসাবে আর ২০% দেবে গুগল সার্চে ফলাফল সংখ্যায়।

এবারে খাতা-কলমে ফলাফলগুলা লিখে ফেলো, কোন মাপকাঠিতে কার অবস্থান কী রকম। তারপর গুরুত্ব বিচারে সেগুলোকে যোগ করে বের করো কার কত পয়েন্ট। সেই পয়েন্টের ভিত্তিতে ঠিক করে ফেলো, কে বেশি জনপ্রিয়, মেসি নাকি রোনালদো।

লাইকাকাঙ্ক্ষী গবেষণা

বন্ধুদের সঙ্গে তর্কে জেতা ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রেই গবেষণার এই পদ্ধতি কাজে আসবে। ধরো, তুমি খেয়াল করলে, ফেসবুকে নানা লেখা বা ছবিতে নানা সংখ্যক লাইক পড়ছে, কোনো ছবিতে বেশি, কোনো কিছুতে কম। এর কারণ কী হতে পারে?

১. হতে পারে সময়টা এখানে ব্যাপার, দিনের কোনো সময়ে কিছু শেয়ার করলে বেশি মানুষের চোখে পড়ে, অন্য সময়ে কম। তোমার অনুকল্প যদি এটা হয়, তাহলে কাছাকাছি ধরনের জিনিস দিনের নানা সময়ে (সকালে, বিকেলে, রাতে) পোস্ট করে দেখতে পারো, কোনটাতে কেমন লাইক পড়ছে। বেশ কিছু এ রকম এক্সপেরিমেন্ট চালালে এই ধারণাটা ঠিক কি না, তা বুঝতে পারবে।

২. হতে পারে, লেখার বিষয়ের ওপরে নির্ভর করছে জনপ্রিয়তা। সেই ক্ষেত্রে অন্য সবকিছু ঠিক রেখে (যেমন দিনের একই সময়ে বা সপ্তাহের একই দিনে) বিভিন্ন রকমের লেখা পোস্ট করে দেখতে পারো কোন ধরনের লেখায় কেমন সমর্থন পাও।

সাকিবের ছক্কা ও কুফা লোকজন

আবার ধরো, তোমার মনে ধারণা হলো, বাংলাদেশের খেলার সময়ে তুমি বাথরুমে গেলেই সাকিব ছক্কা মারে, অথবা তোমার কুফা টাইপের ভাইয়া খেলা দেখতে বসলেই সাকিব আউট হয়। আসলেই কি তাই? একটু পরীক্ষা করেই দেখো না, কতবার সাকিবের ব্যাটিংয়ের সময়ে খেলার সামনে থেকে উঠেছ, আর এই ওঠার সময়টাতে কতটুকু রান হয়েছে, সেটা? এই হিসাব বা এক্সপেরিমেন্ট থেকেই কিন্তু পেয়ে যাবে তোমার প্রশ্নের জবাব, আসলেই কি তুমি টিভির সামনে থেকে উঠলেই সাকিব ছক্কা মেরেছে কি না।

ছিল্লা, কাইট্টা, লবণ দিয়ে গবেষণা?

শেষ উদাহরণটা একটু অন্য রকমের দিই। ধরো, তোমার মনে প্রশ্ন জাগল, তোমাদের বাসায় যে লবণটা খাও, সেটা কি আয়োডিনযুক্ত নাকি আয়োডিন ছাড়া? দোকানদারে আয়োডিন আছে বললেই কি সেটা সত্যি হয়ে যাবে? এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারো গবেষণা করে, খুব সহজে। এখানে অনুকল্প দুটি হলো ১. লবণে আয়োডিন আছে অথবা ২. লবণে আয়োডিন নেই।

কয়েকটা ভাত চিপে ভর্তা করে তাতে লবণ দিয়ে তার মাঝে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস দিয়ে ফেলো, ওটা কি বেগুনি হয়ে গেছে? যদি হয়, তাহলে এই লবণে আয়োডিন আছে, না হলে নেই। এই গবেষণাটা খুব সহজ, তাই না? আর ছোট্ট এই কাজটা করেই কিন্তু পেয়ে গেলে তোমার প্রশ্নের জবাব। এটাই গবেষণা।

খুদে গবেষকেরা, গবেষণার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু গালভরা ডিগ্রি পাওয়া না, বরং প্রশ্নের, কৌতূহলের জবাব দেওয়া। গবেষণা শুরু করার কোনো বয়স নেই, তুমি স্কুলেই পড়ো কিংবা কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেকোনো সময়েই শুরু করে দিতে পারো গবেষণা। দরকার কেবল ধাপে ধাপে কাজটা করা, আর নিয়মগুলো মেনে প্রশ্নের জবাব বের করা। তাহলেই দেখবে আমাদের এই জগত্টা কী অসাধারণ, এই পৃথিবী এই জীবন কেমন করে কাজ করে, কীভাবে চলছে এই বিশ্বের সবকিছু। এসব কিছু জানার, এসব বোঝার জন্যই তো আমাদের এই জীবন, তাই না?

গবেষণার রাজ্যে খুদে বিজ্ঞানীদের পদচারণা শুভ হোক।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, কম্পিউটার বিজ্ঞান, ইউনিভার্সিটি অব আলাবামা অ্যাট বার্মিংহাম