শুরুতেই একটি বহুপদী সমাপ্তিসূচক প্রশ্ন।
গত চার মাসে সবচেয়ে বেশিবার শোনা শব্দ—
i) লকডাউন
ii) কোয়ারেন্টিন
iii) করোনা
কোনটি সঠিক?
ক) i, ii খ) ii, iii
গ) i, iii ঘ) i, ii, iii
পরীক্ষার সব প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর না পারলেও এটা নিশ্চয় সবাই ধরে ফেলেছ, উত্তর হবে ঘ, মানে তিনটিই। দল, মতনির্বিশেষে এই নতুন তিনটি শব্দ হয়ে উঠেছে মানুষের ঐক্যের জায়গা। প্রতিটি অনুভূতিতেই সরব উপস্থিতি এ শব্দগুলোর। সঙ্গে আছে—
১। হতাশা: এই ‘কোয়ারেন্টিনে’ আর যে কত দিন থাকতে হবে!
২। ভবিষ্যৎ চিন্তা: কবে যে ‘লকডাউনটা’ তুলবে!
৩। আশাবাদ: করোনা গেলে এবার অমুক কাজটা করবই।
‘কোয়ারেন্টিন’ শব্দটা আমি প্রথম শিখেছিলাম হার্জের বিখ্যাত টিনটিন পড়ে। সূর্যদেবের বন্দী বইয়ে এক জায়গায় জাহাজে বন্দী রাখা হয় প্রফেসর ক্যালকুলাসকে। টিনটিন আর ক্যাপ্টেন হ্যাডক তাঁকে উদ্ধার করতে গিয়ে দেখেন, ছোঁয়াচে রোগের নাম করে জাহাজ লকডাউন, যাত্রীরা কোয়ারেন্টিনে আছে। তবে ক্লাস টু-তে পড়া সেই জ্ঞান যে আমার জীবনেও প্রতিফলিত হবে, সেটা বুঝিনি।
‘করোনা’ শব্দটা অবশ্য বেশ দেরিতেই শিখেছি। সেই ঘটনাটা বলি। গত বছরের ডিসেম্বর মাস। একদিন দেখা এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে। রাস্তায় খুব একটা ধুলাবালু নেই, তবু তিনি সার্জিক্যাল মাস্ক পরে হাঁটছেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘মাস্ক কেন ভাই?’
‘চীনে নতুন ভাইরাস আসছে, শোনো নাই? অনেক দেশেই ছড়াচ্ছে।’
‘বাংলাদেশে আসছে?’
‘এখনো আসে নাই। তবে আসতে পারে।’
‘নাম কী ভাইরাসের?’
‘নাম শিওর জানি না। “করোনা” বা এ জাতীয় কিছু একটা হবে। হাঁচি-কাশি দিয়ে ছড়ায়। এ জন্য মাস্ক।’
সেই প্রথম করোনা শব্দটা শুনলাম। যদিও এর গুরুত্ব তখনো অনুধাবন করতে পারিনি।
এরপর এল মার্চ মাস। প্রতিদিন টান টান উত্তেজনা। এই বুঝি বাংলাদেশে করোনা ধরা পড়ে, এই বুঝি কেউ মারা যায়। দুনিয়াজুড়ে করোনার তাণ্ডব। হাঁ করে টিভির টকশো দেখি, পত্রিকার খবর পড়ি। গুরুগম্ভীর আলোচনা দেখি।
চারদিকে দুশ্চিন্তা। সবার চিন্তা করোনা নিয়ে। আমার চিন্তা এইচএসসি নিয়ে। দ্বাদশপড়ুয়া (!) শিক্ষার্থী আমি। সামনে মহা পরীক্ষা। টিভির স্ক্রলে, পত্রিকার কলামে কিংবা বোর্ডের ওয়েবসাইটে খুঁজি এইচএসসি নিয়ে কিছু আছে কি না। পরীক্ষা কি পেছাবে?
মার্চ শেষ হলো। পেছাল এইচএসসি। একের পর এক মাস আসতে লাগল। এপ্রিল, মে, জুন। বার্সেলোনায় মেসির যেমন পাকা জায়গা, তেমনি বাংলাদেশে জায়গা পাকা করে নিল করোনা। আমার স্বপ্নের এইচএসসি হয়ে গেল খড়ের গাদার মধ্যে একমাত্র সুচ। খুঁজেই পাওয়া যায় না। সুতা প্রস্তুত থাকুক আর না থাকুক, সুচ আমি খুঁজতে থাকলাম। ক্লাস ওয়ানে থাকতে হিসাব করেছিলাম, ২০২০ সালে এইচএসসি দেব। সেই পরীক্ষা হচ্ছে না, মানা যায়?
চারদিকে গবেষণা, হিসাব–নিকাশ, কীভাবে করোনা তাড়ানো যায়, ভ্যাকসিন বেরোল কি না, কতজন আক্রান্ত হলো ইত্যাদি ইত্যাদি। যাদের এসব নিয়ে হিসাব করার কোনো মানে নেই, তারাও করে। বের করে করোনা থেকে মুক্তির নানান পন্থা। গুরুগম্ভীর আলোচনা করি আমিও। পরিচিত মহলে করোনা থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য পেশ করি। যদিও করোনা তাতে যায় না।
যায় না আমার চিন্তাও। কী করা যায় এই অবসরে, কিংবা করোনা গেলে কী করব? একবার ভাবলাম, করোনা গেলে টেকনাফ টু তেঁতুলিয়া হাঁটব। আরেকবার ভাবলাম হেঁটে হেঁটে পাড়ি দেব ৬৪ জেলা। পরে ‘উদ্ভট’, ‘হাস্যকর’ ও ‘প্রায় অসম্ভব’—এই তিন ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরিকল্পনাদ্বয় বাদ পড়ল। শুরু হলো নতুন পরিকল্পনা। ঘরে বসে কী করা যায়? নতুন ভাষা শেখা যায়। সিদ্ধান্ত নিলাম স্প্যানিশ শিখব। শিখে কী করব জানি না, তবে শিখে রাখতে তো দোষ নেই। এতে আর কিছু হোক বা না হোক, বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদ এল ক্লাসিকোর কমেন্ট্রি তো বুঝব।
অনলাইনে স্প্যানিশ শেখার কার্যক্রম পুরোদমে চলছে। আশা করছি কিছুদিনের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারব, Si, yo hablo español!
পৃথিবীজুড়ে করোনা নিয়ে খুব খারাপ অবস্থা। সবার মন খারাপ। আমারও মন খারাপ। নতুন তিনটি শব্দ থেকে আমরা কবে মুক্তি পাব, এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। সবাই এই প্রশ্নের উত্তরই খুঁজছে। এরই মধ্যে চলো যে যেভাবে আছি, ভালো থাকার চেষ্টা করি, ভালো থাকি। Adiós.
লেখক : এইচএসসি পরীক্ষার্থী, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ, ঢাকা