আমার বাড়ির গলিতে কখনো যদি তুমি বেড়াতে আসো, তাহলে গলির মুখ থেকেই বিরক্ত হবে। গলির মুখজুড়ে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। নালা উপচে পড়ছে ময়লা পানি। রাস্তা ভাঙাচোরা। তারপরও সাহস করে যে ছ’তলা বাড়ির ছ’তলায় থাকি আমি, তাতে পৌঁছে কলবেল টিপে দাও তাহলে ছত্রিশ মাস বয়সী আটত্রিশ ইঞ্চি রোগা টিঙটিঙে যে তোমার সামনে এসে দাঁড়াবে দরজা খুলে তার কাণ্ডকারখানা তোমার ভালো নাও লাগতে পারে। যদি বাঁদরের কাজকারবার তোমার না-পছন্দ হয়, তাহলে ওই অভ্যর্থনাকারীর কার্যকলাপও তোমার পছন্দ হবে না। বাঁদরের সঙ্গে তার যে আশ্চর্য মিল! এইবার ওই আটত্রিশ ইঞ্চি তোমার একটা আঙুল ধরে টেনে এনে বসাবে বসবার ঘরে। তোমাকে সাবধান করে দিয়ে বলবে, ‘আমার বাবার বই ধরবে না কিন্তু।’ এবার চারদিকে তাকিয়ে তুমি খুশি হলে হতেও পারো, যদি বই ভালোবাসো। কারণ? কারণ, আমাদের বসবার ঘরে বই ছাড়া আর কিছু নেই। দেয়ালজোড়া তাকে তাকে সাজানো হাজারো বই! বই দেখলেই পড়বার কিংবা জামার তলায় গুঁজে ফেলবার জন্য যদি উসখুস করতে থাকো, তাহলে হতাশ হতে হবে তোমাকে। কেন? কেননা, ওই আটত্রিশ ইঞ্চি সামনে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে আর বলছে, ‘আমার বাবার বই ধরবে না কিন্তু!’
যাহোক, তখন ওই আটত্রিশ ইঞ্চি রোগা টিঙটিঙের বাবা, মূর্তিমান ইয়া মোটা এই আমি বসবার ঘরে ঢুকব।
যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো, ‘এত এত বই পড়েন আপনি? হাসিমুখে উত্তর দেব, ‘না তো, সব পড়ি না। কোনোটা পড়ি পুরো। কোনোটা অর্ধেক। কোনোটা খালি দেখি। গন্ধ শুঁকি কোনোটার।’
যদি তারপরই জিজ্ঞেস করো ‘জমজমাট অ্যাডভেঞ্চার বইয়ের খবর দিতে পারবেন কিছু?’
‘আলবত পারব, এক শ বার পারব’, ‘আচ্ছা, শুনি তো এমন কিছু বইয়ের খবর।’
‘আরে, অমন বই তো অনেক! অত নাম বলব কেমন করে?’ ঘাবড়ে গিয়ে বলব আমি।
‘তার চেয়ে বলুন, জানেন না আপনি।’, ঠোঁট উল্টে বলবে তুমি।
‘আঁতে ঘা লাগবে না অমন কথা শুনলে?’, ব্যস, মুখ খুলে যাবে আমার।
‘প্রথমে মনে পড়ছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০)-এর কথা। বড়দের জন্য যেমন লিখেছেন, তেমনি শিশু-কিশোরদের জন্যও লিখেছেন বিস্তর। তাঁর অমর অ্যাডভেঞ্চার ‘চাঁদের পাহাড়’-এ মূল চরিত্র শঙ্কর আফ্রিকার রিখটারসভেল্ড পর্বতে গিয়ে যেভাবে রোমাঞ্চকর অভিযানে জড়িয়ে পড়ে—সেটা ভোলা অসম্ভব। মনে পড়ছে, শাহরিয়ার কবিরের নাম। তাঁর মতো এমন গুরুত্ব দিয়ে কিশোর মনের একদম ভেতরের জগৎটাকে তুলে ধরা লেখক বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ। বিশেষ করে রহস্যে ঘেরা অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসের মধ্য দিয়ে সমাজকে চেনা। দেশকে ভালোবাসার যে অনবদ্য কায়দা তাঁর, সেটি অতুলনীয়। শাহরিয়ার কবিরের অন্য বইগুলোর সঙ্গে সঙ্গে পড়তেই হবে নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়, কার্পেথিয়ানের কালো গোলাপ, বার্চবনে ঝড়, হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানা। মনে পড়ছে, পুরোদস্তুর কিশোর সাহিত্যিক আলী ইমামের নামও। ভিন্ন ধাঁচের প্লট, প্রকৃতিকে ভালোবাসা, বিজ্ঞানমনস্কতা, আর মন কেমন করা ভাষা—এই তাঁর ট্রেডমার্ক। তিতিরমুখীর চৈতা, দ্বীপের নাম মধুবুনিয়া, অপারেশন কাঁকনপুর, নীলডুংরির আতঙ্ক—এগুলো তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (১৯৩৪-২০১২)-এর কথা বলতেই হবে। অজস্র লিখেছেন তিনি। জনপ্রিয়তাও পেয়েছেন আকাশচুম্বী। এই লেখকের কাকাবাবু চরিত্রটির রহস্য আর অ্যাডভেঞ্চার সিরিজটির জনপ্রিয়তা অবিশ্বাস্য। কাকাবাবু খোঁড়া, কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত আর অমিত সাহসী। কিশোর সন্তু আর তার বাচাল বন্ধু জোজো কখনো কখনো তার সহযাত্রী। ওই সিরিজটির কাহিনিগুলো আলাদা করে যেমন, তেমনি ছটি খণ্ডে বাজারে সহজলভ্য। ওই সিরিজ ছাড়াও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জলদস্যু, আঁধার রাতের অতিথি, উগসি রাজকুমার—এই বইগুলোও পড়া শুরু করলে না শেষ করে ওঠার উপায় নেই। বিশ্বাস করো, এই বইগুলো তোমার চারপাশকে নতুন করে দেখতে বাধ্য করবে।
এহসান চৌধুরী (১৯৪০)-এর কাঠিমামা সিরিজটির কথা আজকাল খুব একটা শোনা যায় না। কিন্তু ওই সিরিজের ‘কাঠিমামার অ্যাডভেঞ্চার’, ‘কাঠিমামার কর্মকাণ্ড’, ‘কাঠিমামার জয়যাত্রা’, ‘সাবধান কাঠিমামা।’-এই বইগুলো যে পড়বে সেই বলবে ফার্স্ট ক্লাস। আর নতুন করে কী বলব এ সময়ের বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কিশোর সাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবালের কথা। তাঁর বইয়ের নাম কোনটা ছেড়ে কোনটা বলব? তবে, জমজমাট অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে হাতকাটা রবিন, দীপু নাম্বার টু, দস্যি ক’জন, টি রেক্সের সন্ধানে, দুষ্টু ছেলের দল-এই বইগুলোর কথা মনে পড়ছে। রহস্য, অ্যাডভেঞ্চারের পাশাপাশি কিশোর পাঠককে উদ্দীপন শেখানো এবং কোনটি ঠিক-বেঠিক ঠিক নয় সেটি নতুন করে চেনানোর ক্ষেত্রে জুড়ি নেই মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখায়।
এদিকে প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৮)-এর ‘ঘনাদা’ এক অনবদ্য চরিত্র। ১৯৪৫ সালে ‘মশা’ গল্প দিয়ে ঘনাদার যাত্রা শুরু। আর সেই শুরু থেকেই বাজিমাত। তারপর একের পর এক লা-জবাব রসাল সব অ্যাডভেঞ্চার। বাহাত্তর নম্বর বনমালি লস্কর লেনের বাসিন্দা ঘনাদার গল্পে বুদ হতে হবে সব্বাইকে। ইতিহাস, ভূগোল, রসায়ন-পদার্থ-জীববিদ্যার এক দুর্দান্ত মিশেল এই কাহিনিগুলো। রহস্য, কল্পবিজ্ঞান—সব মিলিয়ে সে এক অন্যরকম অ্যাডভেঞ্চারের মজা। ঘনাদার সমস্ত কাহিনি একসময় পাওয়া যায় মাত্র তিনটি খণ্ডে। ওহ হো, একটা নাম বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম। লেখকটির নাম হেমেন্দ্রকুমার রায় (১৯৮৮-১৯৬৩)। তাঁর জমজমাট অ্যাডভেঞ্চার বইগুলোর মধ্যে পড়া চাই-ই চাই ‘যকের ধন’ এবং ‘আবার যকের ধন’। এমন কিছু বইয়ের নাম মনে পড়ছে যেগুলোকে সরাসরি অ্যাডভেঞ্চার বলা যাবে কিনা জানি না-তবে অন্য এক জগতে অভিযানের আশ্চর্য আনন্দ পাওয়া যায়। যেমন, মাহমুদুল হক (১৯৪০-২০০৮) কিশোরদের জন্য লিখেছেন একটিমাত্র উপন্যাস। অথচ, তাঁর ওই একটিমাত্র উপন্যাস ‘কুশল ও বিক্কোর মারণ কারুক’- তার বিচিত্র নামের মতোই বিচিত্র। সত্যজিৎরায়ের (১৯২১-৯২) লেখাকে সরাসরি অ্যাডভেঞ্চার না; গোয়েন্দা কিংবা বিজ্ঞান কল্পগল্প বলা চলে। তাঁর অমর চরিত্র ফেলুদা আর প্রোফেসর শঙ্কু ওই ঘরানারই লেখা। তবে, ওই লেখাগুলোর পর অভিজ্ঞতা তো একরকম অ্যাডভেঞ্চারই। সত্যজিৎ রায়ের তারিণীখুড়োর কাণ্ডকারখানায় অ্যাডভেঞ্চারের ভাগ বেশি, যদিও তারিণীখুড়োকে নিয়ে লেখক তুলনামুলকভাবে কমই লিখেছেন। সত্যজিৎ রায়ের সব লেখাই সমগ্র আকারে সহজলভ্য। সৈয়দ শামসুল হককে বলা হয় সব্যসাচী; কারণ ছোটগল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক—সবেতেই তাঁর ঈর্ষণীয় সাফল্য। তাঁর দুটি উপন্যাসের নাম মনে পড়ছে যেখানে অ্যাডভেঞ্চারের মতো করে বলা গল্প ভালো লাগবে সবার, সীমান্তের সিংহাসন, আর হাডসনের বন্দুক। মুনতাসীর মামুনের পরিচিতি মুক্তিযুদ্ধ আর ঢাকা গবেষক হিসেবে বেশি হলেও কিশোরদের জন্যও তাঁর চমৎকার সব লেখা রয়েছে। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে লড়াই উপন্যাসটির কথা। শৈলেন ঘোষ আজীবন লিখেছেন শুধু ছোটদের জন্যই। আশ্চর্য সুন্দর তাঁর লেখা। কল্পনার রঙিন জগতে জ্বলজ্বল বাস্তব করে বলতে জুড়ি নেই তাঁর। তাঁর সোনা-ঝরা গল্পের ইনকা, খুদে যাযাবর ইসতাসি, কিংবা আবু ও দস্যু সরদার—পড়া চাই-ই-চাই।
আচ্ছা, এ তো গেল বাংলা ভাষার কথা-ভিনদেশি ভাষায় অ্যাডভেঞ্চারের জগৎ নেই।’
‘নেই মানে! এক শবার আছে, হাজারবার আছে! সব কী আর পড়েছি আমি! সম্ভব পড়া! হঠাৎ করে মনেও তো পড়ে না সব নাম। তারপরও, একদম এক নম্বরে মনে পড়ছে জুল ভার্ন (১৮২৮-১৯০৫)-এর নাম। মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি পালিয়ে গিয়ে জাহাজে কেবিন বয়ের চাকরি নিয়েছিলেন। তাঁর বাবা খুঁজে পেতে নিয়ে আসে তাঁকে বাড়িতে। তখন তাঁকে প্রতিজ্ঞা করতে হয়েছিল যে আর কখনো বাড়ি থেকে পালাবেন না তিনি। কথা ঠিক ছিল তাঁর। কিন্তু মনে মনে তিনি পুরো দুনিয়া তো বটেই, ঘুরে বেড়িয়েছিলেন সাগরতল কিংবা রাজ্যের দেশ; আর সঙ্গে নিয়ে গেছেন অগুনতি মন্ত্রমুগ্ধ পাঠককেও। ফরাসি এই জুল ভার্নের অনেক বইয়ের মধ্যে অনবদ্য কটি হচ্ছে, আ জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দ্য আর্থ, অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ, ফাইভ উইকস ইন না বেলুন—এগুলো। জগদ্বিখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েন (১৮৩৫-১৯১০) এর আসল নাম স্যামুয়েল ক্লিমেন্স লংহর্ন। জীবদ্দশায় তাঁর লেখা যেমন জনপ্রিয় ছিল, তেমনি এত বছর পরও তাঁর পাঠকপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি এতটুকু। বিভিন্ন পেশার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা তাঁর লেখাকে করেছে সমৃদ্ধ। মার্ক টোয়েনের দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অব দ্য টম সয়্যার আর দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন— না পড়লেই নয়। হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড (১৮৫৬-১৯২৫) তাঁর সমস্ত লেখকজীবনই উৎসর্গ করেছিলেন অ্যাডভেঞ্চার এবং ফ্যান্টাসি ঘরানার লেখায়। ইংরেজ এই ভদ্রলোকের লেখা উপন্যাসের সংখ্যা মোট ৫৬টি। অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস হিসেবে কিং সলোমনস মাইনস অনবদ্য। তা ছাড়া ‘অ্যালান কোয়াটারমেইন’ এবং ‘আয়েশা’ সিরিজের বইগুলোও দুর্দান্ত।
স্কটল্যান্ডে জন্ম নেওয়া স্যার আর্থার কোনান ডয়েল (১৮৫৯-১৯৩০)-এর অমরত্ব নিশ্চিত হয়ে আছে তাঁর সৃষ্ট জগেসরা গোয়েন্দা শার্লক হোমসের মধ্য দিয়ে। তাঁর অনবদ্য অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’ অবশ্যপাঠ্য। স্কটল্যান্ডের আরেক লেখক রবার্ট লুইস স্টিভেনসন (১৮৫০-১৮৯৪) তাঁর মাত্র ৪৪ বছরের জীবনকালের মধ্যেই অমর সব অ্যাডভেঞ্চর উপহার দিয়ে গেছেন; ‘দ্য স্ট্রেঞ্জ কেস অব ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড’, ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’ তাঁর অমর সৃষ্টি। অসুস্থ ছিলেন লেখক। ওই সময় ছেলে স্কুল থেকে বাড়ি এল বেড়াতে। ছেলেকে বিছানায় শুয়ে শুয়ে গল্প শোনাতেন বাবা স্টিভেনসন; ওই বইটিই পরে লেখা হয় ট্রেজার আইল্যান্ড নামে। জলদস্যুদের নিয়ে গুপ্তধনকেন্দ্রিক বইটি পড়তেই হবে। আলেকজান্ডার সেলকার্ক নামের এক নাবিক নাকি চিলির কাছাকাছি কোনো একটা জনমানবশূন্য দ্বীপে কয়েক বছর সময় অতিবাহিত করেছিলেন; ওই কাহিনি খবরের কাগজে বেরোলে তাতেই উদ্বুদ্ধ হয়ে ড্যানিয়েল ডিফো (১৬৬০-১৭৩১) লিখে ফেলেন দ্য লাইফ অ্যান্ড স্ট্রেঞ্জ সারপ্রাইজিং অ্যাডভেঞ্চার্স অব রবিনসন ক্রুসো-যে বইটিও না পড়লেই নয়।
‘বাব্বাহ্! এত বই!’
‘এত দেখছ কোথায়? এখনো তো বলাই হয়নি জোহান ডেভিস ওয়েস (১৭৪৩-১৮১৮)-এর দ্য সুইস ফ্যামিলি রবিনসন-এর কথা; যে বইটি সম্বন্ধে স্বয়ং জুল ভার্ন বলেছিলেন যে এটা নাকি তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বই। ১৯০৭ সালে সাহিত্য নোবেল জয়ী লেখক রুডইয়ার্ড ফিপলিং (১৮৬৫-১৯৩৬)-এর যে কটা বই না পড়লেই নয়; সেগুলো হলো দ্য জংগল বুক, কিম, আর ক্যাপ্টেইনস কারেজিয়াস। যুক্তরাষ্ট্রের লেখক জ্যাক লন্ডন (১৮৭৬-১৯১৬)-এর দ্য সি উলফ-এর কথা ভোলা দায়। ১৯৮৩ সালের নোবেলজয়ী সাহিত্যিক স্যার উইলিয়াম গোল্ডিং (১৯১১-৯৩) লর্ড অব দ্য ফ্লাইজ-এ যেভাবে এক জনমানবহীন দ্বীপে একজন ব্রিটিশ কিশোরের দিনযাপন তুলে ধরেছেন—সেটি অ্যাডভেঞ্চারের চেয়ে কম নয় কোনো অংশে। জন রোনাল্ড রিউয়েল টলকিনকে আমরা চিনি জে আর আর টলকিন (১৮৯২-১৯৭৩) হিসেবে, যার অনবদ্য সৃষ্টি দ্য লর্ড অব দ্য রিংস-এর তিন খণ্ডের অনন্যসাধারণ অ্যাডভেঞ্চার। টলকিনের ‘হবিট’ সে তুলনায় ফ্যান্টাসি ঘরানার হলেও ওটাও পড়া চাই সবার। ড্যান ব্রাউনকে (১৯৬৪) আমরা যতটা না চিনি তার চেয়ে বেশি চিনি দ্য ভিঞ্চি কোডকে। অ্যাডভেঞ্চার রহস্য গোয়েন্দা, ইতিহাস—সবই যেন মিলেমিশে একাকার এই বইতে। টারজানের নাম কে না জানে? জঙ্গলের রাজা এই টারজান চরিত্রের স্রষ্টা এডগার রাইস বারোজ (১৮৭৫-১৯৫০)। তাঁর অনন্য সৃষ্টি যেন ঢাকা পড়ে গেছে টারজানের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তায়। টারজান সমগ্র পাবে সহজেই। একদম হাল আমলের ট্রিলজি মানে তিন খণ্ডের অ্যাডভেঞ্চার দ্য হাঙ্গার গেমসের লেখিকা সুজান কলিনসও হয়ে গেছেন লাখো পাঠকের প্রিয়। আর বলতেই হয় বেলজিয়ান শিল্পী জর্জেস প্রসপার রেমির কথা; যদিও আর্জে (১৯০৭-১৯৮৩) নামেই তার পরিচিতি। আর্জের অনবদ্য সাংবাদিক চরিত্র টিনটিনের অমর অ্যাডভেঞ্চারগুলো গ্রাফিক-নভেল হিসেবে দুনিয়াজোড়া সমাদৃত। সত্তরের অধিক ভাষায় এগুলো অনূদিত হয়েছে। ১৯২৯ সালে টিনটিনের সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত সব বইয়ের দোকানে পাওয়া যায় টিনটিন।
‘ইংরেজিতে লেখা বইগুলো বুঝব আমি?’
‘কেন বুঝবে না, আলবত বুঝবে! তা ছাড়া এগুলোর বেশির ভাগই সহজবোধ্য কিশোর উপযোগী সংস্করণও বাজারে আছে। ইংরেজি হলেও ওগুলো পড়তে পারবে তরতরিয়ে। আর, বাংলা অনুবাদ তো রয়েছেই। সবগুলোরই অনুবাদ পাবে তুমি বাজারে।’
‘কিন্তু পাব কোথায় বইগুলো?’
‘কেন? বইয়ের দোকানে! ফুটপাতে পাবে কম দামের পুরোনো কপি। স্কুল লাইব্রেরি কিংবা সরকারি গণপাঠাগারেও পাবে। পাবে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র-এর বইপড়া কর্মসূচিতেও। কিংবা ইন্টারনেটে অনলাইনেও অর্ডার করতে পারো—বাসায় পৌঁছে দেবে পছন্দমতো বই, তখন মিটিয়ে দিলেই হবে। আর, বন্ধু-পরিচিতিজনের বইয়ের তাকেও তো মিলবে বইগুলো। তবে, একটা কথা জানিয়ে রাখি তোমাকে, আজকাল পিডিএফ আকারে ইন্টারনেটেও পাওয়া যায় বই; যদি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের বইগুলোর শতকরা প্রায় এক শভাগই ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে লেখক-প্রকাশকের অগোচরে, চুরি করে! আর এই চুরি কিন্তু রীতিমতো বেআইনি। তাই, এই চুরিতে শামিল না হয়ে একটু কষ্ট করে টিফিনের পয়সা, রিকশা ভাড়া, কিংবা ঈদ-পূজার বকশিশ জমিয়ে বই কেনার মজাই অন্য রকম।
‘আচ্ছা, এই বইগুলো পড়ার দরকারটা কী? কী লাভ হবে পড়লে এগুলো?’
‘একটা কথা সাফ জানিয়ে দিই তোমাকে, এই বইগুলো পড়লে পরীক্ষায় কম নম্বর পাবে না, সিনেমা দেখার আনন্দও কমবে না, কিংবা ভবিষ্যতে ক্রয়-রোজগারেও কোনো অসুবিধা হবে না। তবে আমাদের চারপাশের স্বার্থপরতা আর সংকীর্ণতার মাঝে এই বইগুলোর মধ্য দিয়ে এক টুকরো আকাশ আর নির্মল আনন্দ পাওয়ার যে সম্ভাবনা সেটুকু হাতছাড়া হয়ে যাবে নিশ্চিত! আর, এই কথাটাও জোর দিয়ে জানিয়ে রাখি যে এই আকাশ আর আনন্দের কোনো দাম হয় না। এগুলো অমূল্য।’
এতক্ষণ আমাদের কথা শুনতে শুনতে বিরক্ত আটত্রিশ ইঞ্চি। সে বিরক্ত হয়ে বলবে, ‘কথা থামাও! আমি আইসক্রিম খাব।’
কী আর করা! আমরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গলির মোড়ের দোকান থেকে তিনটি কোন আইসক্রিম কিনে তাতে কামড় দিতে দিতে ভাবতে থাকি ট্রেজার আইল্যান্ডের কুখ্যাত জলদস্যুর সেই অদ্ভুত গান কিংবা হাতকাটা রবিনের দুরন্ত সব কাণ্ড।