নিশ্চিতভাবেই বইয়ের মলাট দিয়ে বইকে মূল্যায়ন করা যায় না। যেমন মোড়ক দিয়ে বিচার হয় না পণ্যের গুণাগুণ। কারণ, হাওয়ায় ভরা প্যাকেটে থাকে অল্প কটা চিপস। তবে, ‘ব্যাকরণের বিন্দুবিসর্গ’ বইটি যেন তার ব্যতিক্রম। প্রচ্ছদ দেখলেই যেমন চোখ জুড়ে প্রশান্তি নামে, তেমনি বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে নতুন কিছু জানার প্রশান্তি। বইটিতে শিশু–কিশোরদের জন্য বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণের নানান বিষয় লেখক তুলে ধরেছেন, তবে প্রচলিত ব্যাকরণ বইয়ের নিয়ম ভেঙে।
মেঘদূত ও রোদদূত লেখকের দুই নাতি। একজন পড়াশোনা শুরু করেছে, আরেকজন সবে শিখছে বর্ণমালা। লেখক পুরো বইয়ে রূপকথার গল্পের মতো তাদের শুনিয়েছেন বাংলা ভাষার জন্ম ও বেড়ে উঠার কাহিনি। বর্ণমালার বিবিধ রং, ব্যবহার ও উচ্চারণ । নানা রকম ছড়া, ধাঁধা বলে বলে ধরে রেখেছেন এক পৃষ্ঠা থেকে অন্য পৃষ্ঠায় যাওয়ার আকর্ষণ। গল্পের আসরে যোগ করেছেন আরও কিছু চরিত্র। তাদের মুখে তুলে দিয়েছেন ব্যাকরণের অজানা প্রশ্ন আর উওর দিয়েছেন মিকি মাউসের গল্পের মতো মজা করে। বলেছেন, ‘জানতে হবে বর্ণমালার বাহির-ভিতর, নইলে মায়ের ভাষা হবে নিতান্ত পর।’
১৪৪ পৃষ্ঠার বইটিকে ২৮টি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। সূচিপত্রের নামও অনেক অভিনব। ‘জ্যান্ত ভাষা, মরা ভাষা, যুক্ত বর্ণের দুষ্টুমি’ কিংবা ‘বহুরূপী-অ’, ইত্যাদি। নাম দেখেই ইচ্ছা হয় পড়ার। অধ্যায় ভাগের ফলে আরও একটি সুবিধা হয়েছে। বইটি এক-দুবার পড়ে সব কিছু মনে রাখা সম্ভব না–ও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে শুধু প্রয়োজনীয় অধ্যায়টা পড়ে নেওয়া যাবে।
বইটির লেখক মানবর্দ্ধন পাল প্রায় ৩৭ বছর শিক্ষকতা করেছেন। ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়েছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। ফলে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের নানা প্রশ্নের উত্তর তিনি এখানে যুক্ত করেছেন। যেমন ডিম্ব বানানের উচ্চারণ ‘ডিমবো’ কিন্তু অশ্ব বানানের উচ্চারণ ‘অশ্ শো’ কেন।
সাতটি সুর, সাতটি রঙের মতোই আমাদের ধ্বনিতেও রয়েছে সাতের খেলা। কী সেই সাত? বাংলা ভাষাতে আরও আছে নানান রহস্য, যা ‘অক্সিজেনের মতো নিজে জ্বলে না, কিন্তু অন্যকে জ্বলতে সাহায্য করে।’ এই রহস্য জানতে হলে পড়তে হবে বইটি।
ট্রেন ভ্রমণের সময় পাশে বসে থাকা এক তরুণের সঙ্গে পরিচয়ের পর ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার বাড়ি কোথায়?” তরুণ বলল, “ব্রাহ্মণবাড়িয়া।” ভদ্রলোক আবার জিজ্ঞেস করলেন, “বানানটা কী?” তরুণের উত্তর, “আমরা এখন ঢাকায় থাকি”।
বানান নিয়েও আছে মজার ঘটনার বর্ণনা। লেখকের ভাষায়, ‘ট্রেন ভ্রমণের সময় পাশে বসে থাকা এক তরুণের সঙ্গে পরিচয়ের পর ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার বাড়ি কোথায়?” তরুণ বলল, “ব্রাহ্মণবাড়িয়া।” ভদ্রলোক আবার জিজ্ঞেস করলেন, “বানানটা কী?” তরুণের উত্তর, “আমরা এখন ঢাকায় থাকি”।’
এই বইয়ের মাধ্যমে লেখক শিশু–কিশোরদের ব্যাকরণভীতি দূর করতে চেয়েছেন, বলেছেন বইয়ের ভূমিকাতেই। ফলে বইটিতে রয়েছে ভীতি জয়ের মন্ত্র।
দু-একটি জায়গায় গল্পের বর্ণনা ধীর বলে মনে হলেও বইটি পড়ে পাঠক বই পড়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবেন না, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
মায়ের ভাষা নিয়ে আমাদের যে গর্ব, তা শুধু গান, কবিতায় সীমাবদ্ধ নেই; ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। ভাষা নিয়ে আমাদের এই অর্জন ধরে রাখতে হলে, বাংলা ভাষাকে তুলে দিতে হলে সারা পৃথিবীর মানুষের মুখে, আমাদের জানতে হবে ভাষার নানান দিক। আর সে পথে ‘ব্যাকরণের বিন্দুবিসর্গ’ হতে পারে একটি শক্ত হাতিয়ার।