কণিকা রশীদের প্রথম বই মেঘমালার সোনালি দিন বেরোয় ২০১১ সালে। কিন্তু প্রথম বইতেই তিনি একজন শক্তিশালী গল্পকার হিসেবে তাঁর আগমনী ঘোষণা করেছিলেন। এরপর গত পাঁচ বছরে তিনি আরও পাঁচটি বই প্রকাশ করে আমাদের দেশের শিশু-কিশোর সাহিত্যে একটা সম্মানের জায়গা অধিকার করে নিয়েছেন। তাঁর গল্পগ্রন্থ অন্যরকম মা, যাঁরা পড়েছেন বা পড়বেন, তাঁরা আমার কথার সত্যতা স্বীকার করবেন।
শিশু-কিশোরদের জন্য খুব ভালো বই যে প্রতিবছর অনেক বেরোয় তা নয়, বিশেষ করে যেসব বই তাদের কল্পনাকে জাগাবে, জীবনকে আরও নিবিড়ভাবে বুঝতে শেখাবে, ভালো-মন্দের তফাত বুঝিয়ে দেবে, সেসব বই। অথচ এ রকম বই পেলে খুদে পাঠকেরা শুধু নয়, বড়রাও উৎসাহ নিয়ে পড়েন। কণিকা রশীদের গল্পে বাস্তব-অবাস্তব খুব সূক্ষ্মভাবে মিশে থাকে। বাস্তবকে ছাপিয়ে ওঠে কল্পনার শক্তি—যে শক্তি জীবনকে রূপ, রস ও রঙে উপস্থাপন করে। তিনি গল্প বলেন অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে, তাঁর ভাষাটি সুন্দর—তাতে অকারণে বর্ণনা বা ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায় না। অথচ শিশু-কিশোরদের মনের জগৎটাকে তিনি একেবারে ভেতর থেকে দেখেন। তাঁর চরিত্ররা খুবই জীবন্ত থাকে, যেন তারা আমাদের খুবই চেনা। এ জন্য তাদের সঙ্গী হতে আমাদের ইচ্ছা হয়।
আর কত বিচিত্র সেসব চরিত্র, কত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে কণিকা রশীদের গল্পগুলোতে! অন্যরকম মা বইটিতে সাতটি গল্প আছে এবং বইটির শিরোনাম যেমনটি জানায়। কয়েক ধরনের মায়ের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। কিন্তু একই সঙ্গে বিচিত্র সব সন্তান, শিশু-কিশোর এবং তরুণকেও আমরা দেখতে পাই। তাদের একটি ছোট তালিকা করে তাদের পরিচয়টা তুলে ধরলে গল্পগুলো পড়া কেন আমাদের জন্য জরুরি, তা বোঝা যাবে।
তার আগে কণিকা রশীদ নিয়ে কিছু কথা সেরে ফেলা যায়। তাঁর দৃষ্টিতে ১৯৭১ একটা বিশাল উপস্থিতি, যেহেতু ওই বছরটি আমাদের একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। ওই বছর একদল নরপশুর রক্তপিপাসা মেটাতে আমাদের অসংখ্য মানুষকে আত্মবিসর্জন দিতে হয়েছিল। আবার ওই বছর আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের মহিমায় আমাদের আত্মপরিচয় অনেক উজ্জ্বল করেছিলেন, দেশের মানুষ একটা অভিন্ন লক্ষ্যে এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিল। কণিকা রশীদ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে সামনে রেখে গল্প লেখেন। সে জন্য তাঁর গল্পে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতির বিষয়টি গুরুত্ব পায়। তিনি গ্রামের পটভূমিতে লিখতে পছন্দ করেন। বইটির অন্যরকম মা নামের প্রথম গল্পে তিনি যে মায়ের কথা বলেন, তিনি এক ছেলেকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছেন, কিন্তু অন্য ছেলেকে নিয়ে পালাতে গিয়ে পাকিস্তানি পশুদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। ওই গল্পে সম্ভ্রম হারানো এক গরিবকে মুক্তিযোদ্ধারা মায়ের জায়গায় বসিয়েছে। সেই নারী, যার নাম শেফালি, তাকে গল্পের শেষে বেঁচে যাওয়া ছেলেটি বলল, ‘তুমিই আমার মা! আমার অন্য রকম মা।’
অন্য রকম মা আরও আছেন, ‘ভুবন’ গল্পের ভুবন পড়ে ক্লাস সিক্সে। এক ভাই তার, বাবা নেই। সে পিকনিক করতে গিয়ে নদীতে নেমে তলিয়ে গেল। তার ভাঙা হূদয় মা একদিন তাকে ফেরত পেলেন—নদী থেকে ওঠে এল ভুবন। কিন্তু সেকি আসলে ভুবন, না মায়ের কল্পনার ভুবন? এ প্রশ্নের কোনো পরিষ্কার উত্তর নেই গল্পে, শুধু আমরা জানলাম, একজন মা তার সন্তানকে তার কল্পনায় জীবন দিতে পারেন। ‘ঠিকানা’ গল্পে ছোট্ট অভি বড় হয়েছে মায়ের আদর-স্নেহে। কিন্তু একদিন সে জানল সে পালিত। আসল মায়ের সন্ধানে সে পথে নামল। একসময় তাকে পেলও এবং জানল তার আসল মা তার এত দিন জানা মায়ের বোন। ছোট বোনের সন্তান হয়নি বলে আপন সন্তানকে যিনি তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। গল্পের শেষে তার দুই মা একখানে এসে মেলেন, দুই মায়ের ভালোবাসার অতঃপর তার জীবন কাটবে। অভি এই অবস্থাটাকে পাকাপোক্ত করতে বোর্ডিং স্কুলে চলে যায় দার্জিলিং। অসাধারণ গল্প, অসাধারণ দুই মা এবং তাদের সন্তান অভি।
মা ও সন্তানের মধ্যে যে সম্পর্ক, তার মতো পবিত্র এবং সুন্দর আর কিছু নয়। কিন্তু কণিকা রশীদ বাস্তবকে জানেন, বাস্তবকে তিনি অস্বীকার করেন না। এই বইতে একটি গল্প আছে, যার নাম ‘অনন্য এক ভুবন’। এই গল্পে করিমন বিবি দুই ছেলের মা। অনেক যত্নে অনেক কষ্টে করিমন মানুষ করেছেন দুই ছেলেকে। স্বামী বাউন্ডুলে চরিত্রের, তিনি ঘর ছেড়ে চলে গেলে একটুখানি জমি আর নিজের ঘরটা নিয়েছিলেন করিমন। কিন্তু বড় ছেলে জোর করে জমি বেচে বিদেশে চাকরি নিয়ে গেল। ছোট ছেলে আরও খারাপ কাজ করে টাকা জোগাড় করে বিদেশে গেল—যে তার মায়ের বাড়িটাই বিক্রি করে দিল এবং এটি করার জন্য সে নিল ছলচাতুরীর আশ্রয়। মা শেষ পর্যন্ত অনাহারে হারিয়ে গেলেন। কিন্তু কণিকা রশীদ তাকে এক অসম্ভব সুন্দর রাজ্যে নিয়ে গেলেন। আমাদের জানালেন, সেই রাজ্যে আছে শুধু ‘ভালো লাগার এক অপূর্ব শিহরণ।’ করিমন বিবির মতো মায়েদের জন্য এই ভুবনটাই তো সবাই কামনা করে।
কণিকা রশীদের গল্প পড়ার—অভিজ্ঞতাটা আনন্দের, পরিতৃপ্তির। তাঁর অন্যরকম মা পাঠপ্রিয় হবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়।