সেই ৫ হাজার বছরেরও আগে মিশরে প্যাপিরাস-গাছের পাতায় লেখা শুরু হয়। গাছের পাতার পথ পেরিয়ে ছাপার প্রক্রিয়া আমরা দেখতে পাই ডিজিটাল পর্দাতেও। পাতায় পাতায় ছাপা সেই ইতিহাসের বর্ণগুলোর হাত ধরেই মানুষ এগিয়েছে এত দূর। কী শিখছে মানুষ, সেটাই পৌঁছে গেছে পরের প্রজন্মে। এই ছাপাখানার আদ্যোপান্ত ইতিহাসই এবার তাহলে দেখে নেওয়া যাক।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩ হাজার বছর
ধারণা করা হয়, ঠিক এই সময়ে মিশরে সাইপেরাস প্যাপিরাসগাছের সন্ধান মেলে। ধর্মীয় জ্ঞান আর মহাপুরুষদের কথা লিখে রাখার জন্য এই গাছের পাতাই ব্যবহার করত তারা। হালকা গঠনের এই পাতাগুলোক তারা বলত ‘প্যাপিরাস’। কয়লার খোঁচায় তখন থেকে শুরু হয় লিখে সংরক্ষণ করার পন্থা।
১০৫ খ্রিষ্টাব্দ
প্রকৃত কাগজ তৈরি করা শুরু হয় এই সময়ে। প্রাচীন চীনে চাই লান (জিংঝহং) একেবারে কারিগরিভাবে কাগজ বানানো শুরু করেন। কাগজ আবিষ্কারের কারণে চীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও দ্রুত জ্ঞান প্রচার সম্ভব হয়।
১০৪০ খ্রিষ্টাব্দ
এ সময়ে এসে চীনে পরিবহনযোগ্য ছাপাখানা চালু হয়। খ্রিষ্টীয় মিশনারি ও ব্যবসায়ীরা মিলে এই প্রযুক্তি ইউরোপে নিয়ে যান। সেখানে ধীরে ধীরে তাঁরা এই ছাপা প্রযুক্তির উন্নয়ন চালিয়ে যেতে থাকেন।
১৪৩৮ সাল
ইউরোপে ছাপাখানা প্রবেশের পরপরই তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেখানে ছাপাখানা প্রথম পরিচালনা করেন জোহানস গুটেনবার্গ। ইউরোপে তখন বই, পোস্টার, ছবি, পত্রিকা ছাপানো শুরু হয়। ফলে দ্রুত সেখানকার মানুষ শিক্ষিত হয়ে ওঠে। বলা চলে, মানবসভ্যতার আধুনিক সময়ের শুরুই হয় এই ছাপাখানার হাত ধরে।
১৪৭৩ সাল
কাঠের ব্লক ব্যবহার করে ছাপার শুরু হয় এই সময়ে। ইউরোপে তখন গানের বই ছাপা শুরু হয়। নবম শতকের অনেক শিল্প, সংস্কৃতি, সুর এই বইয়ের মাধ্যমে ফিরে আসে। শুরু হয় জ্ঞানচর্চা ও সংরক্ষণের পথযাত্রা।
১৪৭৬ সাল
ইউরোপে এই সময়ে ইনটাগ্লিও ছাপার শুরু হয়। এই পদ্ধতিতে জিংক ও কপার প্লেটে বিশেষভাবে খোদাই করা হয়, যেন সেখানে কালি আটকে থাকে। লেটারপ্রেস বা রিলিফ প্রিন্টিংয়ের ক্ষেত্রে নির্ধারিত আকারে কালি বসানো হতো। ইনটাগ্লিও পদ্ধতিতে রঙিন ছবি প্রিন্ট করা আরও সহজ হয়ে ওঠে।
এই পদ্ধতিতে ছাপা শুরু হতেই শিল্প, বিজ্ঞানে নতুন সম্ভাবনা শুরু হয়।
ভেনিসে এক ছাপাখানায় এরহার্ড র্যাটডল্ট নামের এক ছাপাখানার মালিক তখন প্রথমবারের মতো চাঁদের গতিবিধি সম্বন্ধীয় বই প্রকাশ করেন।
১৫৬৯ সাল
ইউরোপে এই সময় শুরু হয় মানচিত্র ছাপানোর কাজ। পৃথিবী গোলাকার হলেও ভূমির আকৃতি হিসেবে মানচিত্র ছাপার এক বিশেষ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন জেরারডাস মার্কেরটর। এটাকে অনেকে মার্কেরেটর প্রোজেকশন বলে। ইউরোপসহ সারা বিশ্বে তখন মার্কেরেটরের বানানো মানচিত্র ছড়িয়ে পড়ে।
১৭২৮ সাল
এই সময়ে ইউরোপে উদ্ভাবিত হয় স্টেরিওটাইপ প্রিন্টিং। এই আবিষ্কারের পর বিপুল পরিমাণে ছাপার কাজ একই সময়ে করা সম্ভব হচ্ছিল। কোনো ধাতব প্লেটের ওপর ছাপার অক্ষরগুলো খোদাই করে সেই ফ্রেমে কালি ঢেলে একের পর এক ছাপা যাচ্ছিল খবরের কাগজ, বই, পোস্টার।
১৭৬৮ সাল
স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে এ বছর প্রকাশ করা হয় প্রথম এনসাইক্লোপিডিয়া। ব্রিটানিকা প্রকাশনী এটি প্রকাশ করে। ইংরেজি ভাষায় সবচেয়ে পুরোনো অভিধান এটি। যদিও এখন আর এটি ছাপায় প্রকাশ করা হয় না।
১৭৭৬ সাল
এই বছরের ৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার জানান দিতে কন্টিনেন্টাল কংগ্রেসের অফিশিয়াল ছাপাখানা থেকে ঘোষণাপত্র ছাপানো হয়। ১৩টি স্টেটের মাঝে ২০০টিরও বেশি বড় আকৃতির ছাপা কাগজে টুকরা টুকরাভাবে ছাপিয়ে বিলি করা হয় এই ঘোষণাপত্র। এ কাজের দায়ভার ছিল ছাপাখানার মালিক জন ডানলপের।
১৮৬০ সাল
ঢাকায় প্রথম ছাপাখানা চালু করেন সুন্দর মিত্র, যার নাম ছিল বাংলা প্রেস।
১৯০৬ সাল
এই সময়ে এসে আবিষ্কৃত হয় লাডলো টাইপোগ্রাফ সিস্টেম। এই সিস্টেমে কোনো ধাতুর ওপর উচ্চতাপ প্রয়োগ করে ফ্রেম বানিয়ে লেখা ছাপা হয়। খবরের কাগজের শিরোনাম বা বড় কোনো ছবির ক্যাপশন বসাতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। খুব বড় আকারে ছাপা হওয়ার কারণে এই পদ্ধতির কাজে অনেক বৈচিত্র্য তৈরি হয়।
ইগল প্রিন্টিং ইংক নামের একটি প্রতিষ্ঠান ছাপার জন্য চারটি মৌলিক রং বেছে নেয়। সায়ান, মেজেন্টা, হলুদ আর কালো (যেটাকে মূলত তখন ‘কি কালার’ বলা হতো) এই চারটি রং ব্যবহার করে যেকোনো রঙিন ছবি ছাপাতে পারত তারা। এ চারটি রঙের যে কাঠামো, তাকে বলা হয় সিএমওয়াইকে। গোটা ছাপাখানার ইতিহাসে রঙিন এক বদল নিয়ে আসে এই সিএমওয়াইকে।
১৯৫১ সাল
ধারাবাহিকভাবে কালির মাধ্যমে রঙিন ছবি প্রিন্টের প্রিন্টার আবিষ্কারের কৃতিত্ব পায় সিমেন্স। তড়িৎ চৌম্বকীয় আকর্ষণপদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে ফোঁটা ফোঁটা কালি দিয়ে ছাপা হতো এই প্রিন্টারে। বাজারে ভালোই চলেছিল এটি।
১৯৬৩ সাল
এই সময়ে সবার সামনে আসে প্যারাটোন কালার ম্যাচিং সিস্টেম। ১৪টি আলাদা মৌলিক পিগমেন্টস ব্যবহার করে ১,১১৪টি রং ছাপানো যায় এই পদ্ধতিতে। রঙিন ছাপার ক্ষেত্রে নতুন এক মাত্রা তৈরি করে এটি, যা এখনো বিভিন্ন ছাপাখানায় ব্যবহার করা হচ্ছে।
১৯৬৮ সাল
জাপানের প্রিন্টার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ওকেআই প্রথম ডট প্রিন্ট প্রযুক্তির প্রিন্টার বাজারে আনে। কালিতে ভরা এক সুতায় তড়িৎ চৌম্বক প্রভাব সৃষ্টি করে কাগজে চার্জ তৈরি করে প্রিন্ট করা হয় ডট মেট্রিক্স প্রিন্টারে। ৯০–এর দশক পর্যন্ত প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে জনপ্রিয় ছিল এই ডট মেট্রিক্স প্রিন্টার।
১৯৬৯ সাল
লেজার প্রিন্টার উদ্ভাবিত হয় এই সময়ে। জেরক্স নামের এই প্রিন্টারগুলোর লেজার বিম ব্যবহার করে নির্ধারিত কাঠামোতে বৈদ্যুতিক মডেল বানিয়ে নিত। এই মডেলের গায়ে টোনার নামের বিশেষ কালি আকৃষ্ট হয়ে লেখার আকৃতি ধারণ করত। একই পদ্ধতি ব্যবহার করে ছবিও ছাপানো যেত।
১৯৭০ সাল
এই প্রথম মানুষ তরল কালি ব্যবহার করা শুরু করে।
১৯৭২ সাল
ছাপার কাগজটিকে উত্তপ্ত করে নির্ধারিত মাত্রায় কালি ছড়িয়ে দিয়ে শুরু করা হয় থার্মাল প্রিন্টার। বিল ছাপাতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা শুরু হয়।
১৯৮৪ সাল
স্টেরিওলথোগ্রাফি, যেটাকে এখন আমরা চিনি ত্রিমাত্রিক প্রিন্ট হিসেবে। ডিজিটাল ডেটা ব্যবহার করে কোনো বস্তুর ত্রিমাত্রিক গঠন প্রিন্ট করতে এই প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়। চার্লেস হল ছাপার এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
১৯৯০ সাল
বাজারে নতুন প্রযুক্তি জেরক্স ডকুটেক আসে এবার। কোনো কাগজে ছাপানো তথ্য স্ক্যান করে সেটা পরিবর্তন ও প্রয়োজনে আবার ছাপানোর সুবিধা দেয় এই প্রযুক্তি।
১৯৯১ সাল
সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব। তাই ছাপা নানা কাজের প্রমাণ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে সবখানে।
২০০৩ সাল
হিউলেট প্যাকার্ড প্রথম তার ছাড়াই ছাপার সুবিধা নিয়ে আসেন জনসমক্ষে। মাইক্রোসফট ডট নেট কমপ্যাক্ট ফ্রেমওয়ার্কে এই সেবার মাধ্যমে প্রিন্টারের সঙ্গে তার দিয়ে সংযোগ ছাড়াই কোনো তথ্য ছাপানো যেত।
২০১৭ সাল
যুক্তরাষ্ট্রের ডাক সেবা এক বিশেষ ডাকটিকিট ছাপানো শুরু করে। যেটাতে থার্মোক্রোনিক কালি ব্যবহার করা হয়েছিল। এটাতে থাকা বিশেষ কালির সাহায্যে সূর্যগ্রহণ দেখানো যাচ্ছিল। যখন কালি গরম থাকত, তখন ওই অংশ কালো দেখাত। আবার ঠান্ডা হলে সেটা সাদা অর্থাৎ, চাঁদের মতো দেখাত।