আমাদের শরীরের ৬০ শতাংশই হলো পানি। শরীরের প্রতিটি কোষের ভেতরে বাইরে যে পানি আছে, তা সমস্ত শরীরের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। হিসাবমতে, একজন ৭০ কেজি ওজনের পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরে প্রায় ৪২ লিটার পানি আছে। এর মধ্যে ২৮ লিটার আছে তার কোষের ভেতরে, সাড়ে ১০ লিটার আছে কোষের বাইরে চারদিকে আর বাকি সাড়ে ৩ লিটার পানি প্রবাহিত হচ্ছে তার রক্তের মধ্যে।
পানির আরেক নাম জীবন। কারণ পানি ছাড়া কারও পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। শরীরের প্রতিটি যন্ত্র ঠিকঠাকমতো কাজ করতে হলে চাই পানি। শরীর যদি পানিশূন্য হয়ে পড়ে, তবে কোষগুলো কুঁচকে যায়, আবার পানি বেশি হয়ে গেলে কোষগুলো ফুলে যায়। দুটোই আমাদের জন্য খারাপ। তাই পানির ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। আমাদের শরীর স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে মস্তিষ্ক, কিডনি, পিটুইটারি গ্রন্থি ইত্যাদির মাধ্যমে পানির ভারসাম্য বজায় রাখে। কিন্তু তার সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন পানি পানের অভ্যেসটাও জরুরি।
কতটুকু পানি খাব
কেউ কতটুকু পানি পান করবে, তা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। যেমন চারপাশের আবহাওয়া, হার্ট ও কিডনির কার্যকারিতা, শরীর থেকে পানি হারানোর হার ইত্যাদি। ২৪ ঘণ্টায় প্রস্রাবের সঙ্গে অনেকটা পানি বের হয়ে যায়। এর বাইরে ত্বক থেকে ঘামের মাধ্যমে ও ফুসফুস থেকে প্রশ্বাসের সঙ্গে এক লিটারের কিছু কম পানি বেরিয়ে যায় শরীর থেকে। এই হারিয়ে যাওয়া পানি প্রতিদিন আবার পূরণ করতে হয়। মোটামুটি দুই থেকে আড়াই লিটার (প্রতিদিন আট গ্লাস) পানি পান করলে এই ভারসাম্য বজায় থাকে। তবে এটা নির্ভর করে তুমি কতটা পরিশ্রম করছ, আজকে গরমটা কেমন, কতটা ঘামছ ইত্যাদির ওপর। খুব গরম আর্দ্র আবহাওয়ায়, খেলাধুলা বা পরিশ্রম করলে কি জ্বর, বমি বা ডায়রিয়া হলে শরীর পানি হারায় বেশি। তাই পানি পানও করতে হয় বেশি।
আমরা কতটুকু পানি পান করব, তা অনুভব করার জন্য আমাদের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে একটা থার্স্ট সেন্টার বা পিপাসা কেন্দ্র আছে। যখনই শরীরে পানির দরকার হয়, তখনই এই পিপাসা কেন্দ্র সজাগ হয়ে ওঠে আর আমরা পিপাসার অনুভূতি টের পাই। তারপর পানি পান করি। পানির চাহিদা পূরণ হয়ে গেলে এই পিপাসা কেন্দ্র নিজে নিজেই আবার বার্তা দেয় যে আর পানি লাগবে না। কিন্তু যদি কারও মস্তিষ্কের এই অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায়, যেমন কেউ অচেতন থাকলে, স্ট্রোক হলে, মাথায় অস্ত্রোপচারের পর বা দুর্ঘটনার পর, খুব বয়স্ক বা খুব ছোট শিশুদের, যাদের নিজে থেকে এই পিপাসা বোঝার এবং বুঝে পানি চাইবার ক্ষমতা নেই, তাদের বেলায় এই ফর্মুলা খাটবে না। আবার শরীরে কোনো কারণে পানির অভাব দেখা দিলে পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে ভেসোপ্রেসিন নামে এক ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়, এই হরমোন তখন কিডনির ওপর কাজ করে এবং কিডনি প্রস্রাবের সঙ্গে পানি বের করা কমিয়ে দিয়ে শরীরে পানি ধরে রাখে। এভাবেও শরীর নিজে নিজেই পানির ভারসাম্য রক্ষা করতে চেষ্টা করে। কারও কিডনি বা মস্তিস্কে সমস্যা থাকলে পানির ভারসাম্য রক্ষা জটিল হয়ে পড়ে।
কেন পানি পান জরুরি
শরীরে পানির অভাব হলে তাকে বলে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা। কারও যদি খুব বমি বা ডায়রিয়া হয়, কিংবা অতিরিক্ত ঘাম হয়, তবে শরীর থেকে সব পানি বেরিয়ে যায় ও ডিহাইড্রেশন হয়। ডিহাইড্রেশন হলে তুমি কীভাবে বুঝতে পারবে? মাথা ঝিম ঝিম করবে, ত্বক শুষ্ক ও ঢিলে হয়ে যাবে, জিভ শুকিয়ে খটখটে হয়ে যাবে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসবে, তারপর প্রস্রাবের পরিমাণ কমে আসবে। তীব্র মাত্রার ডিহাইড্রেশন হলে মানুষ মারাও যেতে পারে। মারা না গেলেও কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে, রক্তচাপ কমে গিয়ে মানুষ অচেতন হয়ে পড়তে পারে। পানির ভারসাম্যের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে শরীরের লবণের ভারসাম্য। তাই ডিহাইড্রেশন হলে রক্তে লবণের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, তা থেকে রক্তের ঘনত্বের তারতম্য হয় এবং এ কারণেও মানুষ অজ্ঞান হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারে। তাই যখনই কোনো কারণে পানিশূন্যতা দেখা দেয়, তখনই সেটা সঙ্গে সঙ্গে পূরণ করতে হয়। আগেই বলা হয়েছে দৈনন্দিন কাজ চালানোর জন্য আমাদের মোটামুটি দুই থেকে আড়াই লিটার পানি পান করলেই চলে। কিন্তু কোনো কারণে অতিরিক্ত পানি বের হয়ে গেলে বা পানিশূন্যতা হলে আরও বেশি পানি পান করতে হবে। শরীরের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করা ছাড়াও পানি পান আরও অনেক কারণেই জরুরি।
যথেষ্ট পরিমাণ পানি পান না করলে মাংসপেশিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, ক্লান্তি লাগে। বিশেষ করে যারা খেলাধুলা, ব্যায়াম বা পরিশ্রম করে, তাদের বেশি করে পানি পান না করলে অতিরিক্ত দুর্বল লাগতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলেন, খেলাধুলা বা ব্যায়াম শুরু করার অন্তত আধঘণ্টা আগে দুই–তিন গ্লাস পানি পান করা উচিত। তারপর শেষ করেও পানি খেতে হবে।
পানি খেলে ত্বক সতেজ ও সুন্দর দেখায়। যথেষ্ট পানি পান না করলে ত্বক বিবর্ণ ও ম্যাড়মেড়ে হয়ে যায়।
পানি পান করলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়।
অনেকে বলে, সকালে ঘুম থেকে উঠেই পানি পান করলে নাকি ওজন কমে। এ কথা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এটা সত্যি যে অন্য যে কোনো পানীয়র চেয়ে পানিই হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম পানীয়, যাতে ওজন বাড়ে না।
কিডনি সুস্থ রাখার জন্য পানি পান করা দরকার। যারা পানি যথেষ্ট পান করে না, তাদের প্রস্রাবে সংক্রমণ হতে পারে বারবার।
রক্তের ৯০ শতাংশই হলো পানি। তাই পানি যথেষ্ট পান না করলে রক্তপ্রবাহ ধীর হয়ে যায়, রক্তচাপ কমে যায়।
মস্তিষ্কের নিউরনগুলো খুবই পানি সংবেদনশীল। পানির সামান্য তারতম্যে এরা আক্রান্ত হয়। পানি কমবেশি হওয়ার কারণে ভাবনাচিন্তা এলোমেলো হয়ে যায়, সবকিছু ঝাপসা মনে হয় ও অসংলগ্ন হয়ে পড়ে মানুষ।
শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার জন্যও পানি দরকার।
এ ছাড়া আরও এক শ একটা কারণ আছে, যার জন্য পানি জরুরি। কেউ খাবারদাবার না খেয়ে কয়েক দিন পর্যন্ত দিব্যি বেঁচে থাকতে পারবে, কিন্তু পানি না পেলে বাঁচবে না।
চাই বিশুদ্ধ পানি
আমাদের চারপাশে কত সব পানীয় আছে! জুস, কোমল পানীয়, চকলেট ড্রিংকস, স্পোর্টস ড্রিংক বা এনার্জি ড্রিংক, কফি, চা আরও কত কিছু। পানির বদলে ওগুলো খেলে কেমন হয়? মোটেও ভালো হয় না আসলে। কেননা, পানি ছাড়া অন্য যেকোনো পানীয়র যে ঘনত্ব বা উপাদান, তা আমাদের শরীরের তরলের ঘনত্ব থেকে আলাদা। খুব গরমে ঠান্ডা কোমল পানীয় বা জুসজাতীয় কিছু খেলে পিপাসা ভালো মিটবে, এ ধারণা কিন্তু ভুল। বিজ্ঞান বলছে, বিপাকক্রিয়ার ঝামেলার জন্য বরং এই সব পানীয় পিপাসা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। শুধু সাধারণ পানিই পারে সত্যিকারের পিপাসা মেটাতে আর শরীরের পানির চাহিদা পূরণ করতে। পানি ক্যালরিমুক্ত, ক্যাফেইনমুক্ত, কৃত্রিম রং ও রাসায়নিকমুক্ত বলে নিরাপদ। পানির মাধ্যমে কিন্তু অনেক রোগ ছড়ায়। টাইফয়েড, জন্ডিস, ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয় ইত্যাদি নানা রোগের জন্য এই পানিই দায়ী। পানিতে লুকায়িত নানা জীবাণুর কারণেই এসব রোগ হয়। তাই পান করার আগে নিশ্চিত হতে হবে যে পানিটা যেন বিশুদ্ধ হয়। পানি বিশুদ্ধ করার নানা উপায় আছে। সবচেয়ে ভালো হচ্ছে পানি ফুটিয়ে ঠান্ডা করে পরিষ্কার পাত্রে ভরে সংরক্ষণ করা। অনেকে পানি ফোটানোর পর ফিল্টারও করে থাকে। অনেক জায়গায় গভীর নলকূপের পানি ব্যবহৃত হয় অথবা বৃষ্টির পানি বা ঝর্নার পানি মানুষ পান করে। বাড়ির বাইরে বা স্কুলে যাওয়ার সময়ও এই বিশুদ্ধ ফোটানো পানি পরিষ্কার বোতলে বা ফ্লাস্কে ভরে বহন করা উচিত। কখনোই রাস্তায় খোলা পানি বা পানি দিয়ে তৈরি কোনো সরবত খাবে না। আমাদের দেশে ট্যাপের পানি নিরাপদ নয়, তাই এটা না ফুটিয়ে সরাসরি পান করা যাবে না। আবার কখনো কখনো পানি নানা ধরনের ধাতু দ্বারাও দূষিত হয়। যেমন আর্সেনিক বা সীসা পানিতে মিশে গেলে সেই পানি থেকে নানা সমস্যা হতে পারে। তাই পানিদূষণ যেন না হয়, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। নদী–নালা, পুকুর, সমুদ্র, লেক ইত্যাদির পানিতে বর্জ্য পদার্থ ফেলা কখনোই উচিত নয়। আশা করি এদিকেও তোমরা নজর রাখবে।