করোনাভাইরাসের মহামারি পুরো বিশ্বের জন্য একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। বাংলাদেশসহ প্রায় বিশ্বজুড়েই লকডাউন, ছুটি বা সবকিছু প্রায় বন্ধ। কোথাও আংশিক খুলছে। কোথাওবা আরও শক্ত হচ্ছে ঘরে থাকা। মহামারি চলাকালে সবারই মানসিক চাপে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। সবার মতো শিশু, কিশোর আর তরুণদেরও মানসিক চাপ বাড়বে। একদিকে স্কুল–কলেজ বন্ধ, পড়ালেখা-পরীক্ষা কী হবে না হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা, সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ হচ্ছে না, আরেক দিকে বাসায় থাকতে থাকতে একঘেয়েমিতে পেয়ে বসেছে, নেই মাঠে গিয়ে কোনো খেলাধুলার সুযোগ। আর অন্য সবার মতো তাদের মনেও আছে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ভয়, সংক্রমিত হয়ে গেলে চিকিৎসা নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং মৃত্যুভীতি। নতুন জীবনধারা, নিয়মকানুনের সঙ্গে মানিয়ে চলাও কঠিন মনে হতে পারে। তার ওপর যদি মা–বাবারা তাঁদের নিজেদের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠাগুলো সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেন, তখন শিশু–কিশোর–তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য আরও বিপন্ন হয়ে পড়ে।
এই সময়ে শিশু, কিশোর, তরুণসহ যে কারও মধ্যে উদ্বিগ্নতা (অ্যাংজাইটি), তীব্র মানসিক চাপ (স্ট্রেস), ঘুমের সমস্যা (স্লিপ ডিসঅর্ডার), বিষণ্নতা বা অবসাদ (ডিপ্রেশন), পরিবর্তিত পরিস্থিতি মানিয়ে চলার সমস্যা (অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিসঅর্ডার), আতঙ্ক (প্যানিক ডিসঅর্ডার) ইত্যাদি মানসিক স্বাস্থ্যসমস্যা দেখা দিতে পারে। আর যেসব শিশু, কিশোর, তরুণ আগে থেকেই কোনো মানসিক বা মাদকের সমস্যায় ছিল, তাদের লক্ষণগুলো বেড়ে যাবে।
এই সময়ে শিশু, কিশোর আর তরুণদের মধ্যে যেসব মানসিক লক্ষণ বেশি দেখা দিতে পারে, তা হলো:
• ঘুমের রুটিন পরিবর্তন হয়ে যাওয়া: সারা রাত জেগে থাকা আর সারা দিন ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে উঠতে পারে। ফলে মস্তিষ্কের বায়োলজিক্যাল ক্লক এলোমেলো হয়ে যায়, যা আবেগ আর আচরণকে পরিবর্তন করে ফেলে।
• কোনো কাজে মন বসে না: কোনো কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারে না। এমনকি পছন্দের বিষয়টিতেও।
• জরুরি বিষয়গুলো ভুলে যাওয়া: সাধারণ বিষয়গুলোও ভুলে যেতে থাকে। দৈনন্দিন বিষয়গুলো মনে রাখতে না পারা।
• আবেগজনিত অসুবিধা: আবেগের বহিঃপ্রকাশ খুব বেশি হতে পারে, আবার কারও কারও আবেগ ভোঁতা হয়ে যেতে পারে। কেউ বেশি বেশি কান্নাকাটি করে, কেউবা একদম স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে, কেউ বিনা কারণে অতি উৎফুল্লও হতে পারে!
• আচরণের সমস্যা: হঠাৎ রেগে যাওয়া। আগ্রাসী আচরণ করা। এলোমেলো কথা বলার মতো লক্ষণও থাকতে পারে কারও কারও মধ্যে।
• পারিবারিক সম্পর্কের অবনতি: দেখা যায় এই সময় কাছের মানুষের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে এবং সম্পর্কগুলো নষ্ট হচ্ছে।
• বিভিন্ন শারীরিক লক্ষণ: বুক ধড়ফড় করা, ফুসফুসের সব ঠিক থাকা সত্ত্বেও নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার অনুভূতি, ঘাম হওয়া, হাত–পা ঠান্ডা হয়ে আসা, শরীরে শক্তি না পাওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
• আসক্তি বেড়ে যাওয়া: বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইন্টারনেট বা ইলেকট্রনিক গ্যাজেটে আসক্তি বেড়ে যেতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাদকাসক্তিও দেখা যায়।
• চেনা জায়গা বা চেনা মানুষ চিনতে না পারা: অনেক সময় তীব্র মানসিক চাপের কারণে আশপাশের পরিচিত মানুষ, স্থান, সময় ইত্যাদি সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হতে পারে।
• শিশুদের বিশেষ সমস্যা: একদম যারা ছোট শিশু—তারা মা-বাবাকে বেশি করে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। কেউবা নিজেকে গুটিয়ে রাখে। কেউ বেশি কান্নাকাটি করে, মা–বাবাকে সারাক্ষণ প্রশ্ন করতে থাকে। কেউবা বিছানায় প্রস্রাব করা শুরু করে।
এ সময় মানসিক চাপ কমাতে
করোনা মহামারি চলাকালে মনের ওপর চাপ কমাতে যা যা করা উচিত, তা হচ্ছে:
• রুটিন ঠিক রাখতে হবে: বিশেষ করে ঘুমের রুটিন। রাতে ঘুমাতে হবে আর দিনে সক্রিয় থাকতে হবে। সময়মতো গোসল আর খাওয়াদাওয়া করতে হবে। রুটিনের বড় ধরনের পরিবর্তন করা চলবে না। ঘুমের কমপক্ষে দুই ঘণ্টা আগেই মুঠোফোন, ল্যাপটপ বা টিভি দেখা বন্ধ করতে হবে।
• পাল্টাতে হবে দৃষ্টিভঙ্গি: ঘরে থাকাকে বন্দিত্ব মনে করা যাবে না। কেউ ঘরবন্দী নয়। বাইরের পৃথিবীটাই বন্দী। ঘরেই সবাই মুক্ত। ভাইরাস থেকে মুক্ত। সংক্রমণ থেকে মুক্ত।
• গুজবে কান দেওয়া যাবে না: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা সবকিছু বিশ্বাস রাখা যাবে না। কেবল নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য গ্রহণ করতে হবে।
• সারা দিন করোনা করোনা নয়: করোনাভাইরাসের বাইরেও জীবন আছে। সেটা মাথায় রেখে পড়ালেখা করা, নিজের যত্ন নেওয়া, বই পড়া, মুভি দেখা বা নিজের ব্যক্তিগত কাজগুলো করা বজায় রাখতে হবে। দিনে দুবারের বেশি করোনাবিষয়ক সংবাদ দেখার প্রয়োজন নেই। নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্মচর্চা করাও মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করবে।
• ঘরের কাজে অংশ নিতে হবে: পরিবারের সব সদস্যের সঙ্গে মিলে ঘরের ছোটখাটো কাজ, যেমন রান্নায় সাহায্য করা, ঘর পরিষ্কার করা ইত্যাদিতে অংশ নিতে হবে।
• পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে: নিজেকে আলাদা করে রাখা যাবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিবারের সঙ্গে গুণগত সময় কাটাতে হবে। একে অপরের সঙ্গে আবেগ–অনুভূতি শেয়ার করতে হবে।
• ক্ষতিকর অভ্যাস বর্জন: যাদের ধূমপান বা অন্য কোনো মাদক গ্রহণের অভ্যাস ছিল, তাদের সে অভ্যাসগুলো ত্যাগ করতে হবে।
• সামাজিকভাবে যুক্ত থাকা: এ সময় বন্ধু–সহপাঠীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হচ্ছে না। কিন্তু সামাজিকভাবে তাদের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে।
• প্রযুক্তিতে আসক্তি নয়: সামাজিকভাবে সংযুক্ত থাকতে হবে, কিন্তু তাই বলে ইন্টারনেটে আসক্ত হওয়া চলবে না। ইন্টারনেটের যৌক্তিক ব্যবহার করতে হবে।
• দায়িত্ব আছে মা–বাবাদেরও: এ সময় মা–বাবারা সন্তানের ওপর বিরক্ত হবেন না। প্রত্যেক সন্তানকে আলাদা করে সময় দেবেন। তাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবেন। তাদের মিথ্যা বলবেন না। তাদের সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্যারম, লুডু বা অন্য কোনো ঘরোয়া খেলায় অংশ নিতে পারেন। সন্তানের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যসমস্যা দেখা দিলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে দেরি করবেন না।
করোনা–পরবর্তী নতুন পৃথিবীতে কিশোর–তরুণেরা
করোনাভাইরাস পুরো বিলীন হোক আর না–ই হোক, এই মহামারিকাল কিন্তু অনন্ত থাকবে না। ধাপে ধাপে নতুন জীবনধারার সঙ্গে সবাইকে মানিয়ে নিতেই হবে। সেই অনাগত পৃথিবীতে হয়তোবা মোটেই করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব থাকবে না অথবা এই ভাইরাসের সঙ্গেই আমাদের বসবাস করতে হবে। সেই নতুন পৃথিবীতে কিশোর–তরুণেরাই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় প্রবীণদের কার্যক্রম খানিকটা শ্লথ হয়ে আসবেই। করোনাভাইরাস থাকুক আর না–ই থাকুক, আমাদের সামাজিক আচরণ, জগৎ সম্পর্কে ধারণা (কগনিশন), আমাদের নীতিনৈতিকতা আর আবেগ অনেকাংশেই পরিবর্তিত হয়ে যাবে। প্রযুক্তিনির্ভর কর্মপরিবেশ তৈরি হবে। আমূল বদলে যাবে স্বাস্থ্যব্যবস্থা। শিক্ষাব্যবস্থাও সাজবে নতুন রূপে। সেই নতুন পৃথিবীতে টিকে থাকতে এবং দক্ষতার সঙ্গে টিকে থাকতে কিশোর–তরুণদের দরকার এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া। এ জন্য তারা যেসব দিকে বেশি নজর দেবে, তা হলো:
• নিজের দক্ষতা বাড়াতে হবে: নিউ নরমাল পৃথিবীতে নতুন নতুন দক্ষতার চাহিদা বেড়ে যাবে। সৃজনশীল দক্ষতা শিখে নিতে হবে তরুণদের। এবং তা এখনই। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বা অন্য যেকোনো মাধ্যম থেকে নিজেদের একটু বেশি দক্ষ করে নিতে হবে। শিখতে হবে ব্যতিক্রমী নানান বিষয়। কে কোনটা শিখবে, তা নির্ভর করবে যার যার লক্ষ্যের ওপর। নতুন ভাষা শেখা থেকে শুরু করে গান শেখা, বাদ্যযন্ত্র বাজানো বা কম্পিউটারের প্রোগ্রাম—যেকোনো কিছু শিখে নিতে পারেন তরুণেরা এই সময়ে।
• চর্চা করতে হবে মানবিক গুণেরও: আগামী পৃথিবীতে মানুষের সঙ্গে মানুষের একধরনের সংহতি তৈরি হতে পারে বলে সমাজবিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন। সেই পৃথিবীতে মানবিক গুণগুলোর কদর বেড়ে যাবে। তাই এই দুর্যোগের মধ্যে প্রত্যেক তরুণকে মানবিক মানুষ হয়ে ওঠার সুযোগটিকে কাজে লাগাতেই হবে। অন্যের প্রতি ভালোবাসা, ধন্যবাদ দেওয়া, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আর অপরের প্রশংসা করার মতো বিষয় থেকে শুরু করে নিজেকে নিরাপদে রেখে যতটা সম্ভব আর্ত মানুষের পাশে থাকতে হবে।
• হতাশ হওয়া যাবে না: ‘করোনার কারণে অনেক সময় নষ্ট হলো, অনেক পিছিয়ে গেলাম’—এসব ভেবে হতাশ হওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে, এ সময় নিজের আর প্রিয়জনের জীবন বাঁচিয়ে রাখাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই করোনা–পরবর্তী সময়ে নিজের বেঁচে যাওয়া জীবনটাকে কত কার্যকরভাবে কাজে লাগানো যায়, সেটার জন্য পরিকল্পনা করে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, কেউ পিছিয়ে যায়নি, পৃথিবীটাই থেমে আছে।
• সামাজিক আচরণের পরিবর্তনগুলো রপ্ত করতে হবে: কর্মস্থলে বা রাস্তাঘাটে দূরত্ব রক্ষা করা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তাবিধিগুলো মেনে চলা—এগুলোকে হালকা ভেবে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। যথাসম্ভব কঠোরভাবে সেগুলো মেনে চলতে হবে।
• জীবনের অগ্রাধিকারগুলো সাজিয়ে নিতে হবে: যাপিত জীবনে অনেক কিছু আছে অবশ্যপ্রয়োজনীয়, কিছু মোটামুটি প্রয়োজনীয় আর কিছু একেবারেই বাহুল্য। তাই সব বাহুল্য বর্জন করে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে নিজের আর সামাজিক জীবনে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
• শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর বিজ্ঞান: নিউ নরমাল পৃথিবীতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর বিজ্ঞানকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তাই কিশোর–তরুণদের সব ধরনের কূপমুণ্ডূকতা আর অন্ধবিশ্বাস ঝেড়ে ফেলে বিজ্ঞানচর্চায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
• প্রয়োজনে জীবনের নতুন লক্ষ্য: করোনাকাল থেকে শিক্ষা নিয়ে কিশোর–তরুণদের এখন থেকেই নিজের জীবনের লক্ষ্য নতুন করে নির্ধারণ করে নিতে হবে। করোনা–পূর্ববর্তী অনেক হিসাব–নিকাশ পাল্টে যাবে। তাই পরিবর্তিত নতুনের সঙ্গে নিজেকেও পরিবর্তন করে নেওয়া জরুরি। পরিবর্তনের ঢেউকে ভয় পেলে চলবে না। সেই ঢেউয়ের তালে তালে নিজেকে পরিবর্তন করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই কিশোর–তরুণদের মূল কাজ।