আনা ফ্রাঙ্ক—বিশ্বব্যাপী পরিচিত এক নাম। সারা পৃথিবীর মানুষের মনে আঁচড় কেটে আছে আনার লেখা স্মৃতিকথা। ১৯২৯ সালের ১২ জুন জার্মানিতে জন্ম আনার। পিতা অটো ফ্রাঙ্ক, মা এডিথ হল্যান্ডার, বড় বোন মারগট এবং আনা—ভালোই চলছিল চারজনের পরিবারটি। কিন্তু তিরিশের দশকে জার্মানির পরিবেশ হয়ে উঠল উত্তপ্ত। হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি বাহিনী তখন অধিকার কায়েমে ব্যস্ত। পরিকল্পিতভাবেই চারদিকে চরম উগ্রবাদ ও বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছিল। আর এর প্রধান শিকার ছিল ইহুদিরা। দিনে দিনে অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তাই বনেদি ইহুদি পরিবারের কর্তা অটো ফ্রাঙ্ক সিদ্ধান্ত নিলেন দেশত্যাগের। সপরিবারে চলে এলেন হল্যান্ডে।
হল্যান্ডের আমস্টারডাম শহরে শুরু হলো নতুন যাত্রা। তবে তাও বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। আনার বয়স যখন ১০, পৃথিবীজুড়ে শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। নাৎসি বাহিনীর রোষানলে জার্মানি ছাড়ছিল অগণিত ইহুদি। একের পর এক ভূখণ্ড দখল করছিলেন হিটলার।
১৯৪১ সালে হিটলারের কালো থাবা পড়ল হল্যান্ডে। শেষ পর্যন্ত শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পেতে ১৯৪২ সালের ৬ জুলাই থেকে গোপন আস্তানায় লুকিয়ে পড়েন ফ্রাঙ্ক পরিবারের চারজন। সঙ্গে ফান ডান পরিবারের তিনজন এবং ডাক্তার ডুসেলসহ মোট আটজন। শুরু হয় শ্বাসরুদ্ধকর জীবন! টানা ২৫ মাস আত্মগোপন করে ছিলেন তাঁরা। আর সেই সময়েই প্রতিটি দিনের কথা নিজের ডায়েরিতে লিখতে শুরু করে ১৩ বছরের আনা। পরে সেটাই হয়ে দাঁড়ায় ইতিহাস।
আত্মগোপনের আগের জন্মদিনে পিতার কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিল ডায়েরিটি। সেই ডায়েরির পাতা ভরে উঠেছিল ১৩ বছর বয়সী এক বালিকার সরল, অকপট লেখায়। অবিশ্বাস্য স্পষ্টতায় এ ডায়েরিতে অঙ্কিত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ভয়াবহতা ও মনুষ্যত্বের চরম লাঞ্ছনার কথা। অনিশ্চয়তার জীবন, সামনে অস্পষ্ট ভবিষ্যত্। তবু আনার লেখা প্রতিটি শব্দে ফুটে উঠেছে আশার চিহ্ন। একই রুটিনের একঘেয়ে জীবনের বর্ণনা আনার কলমের ছোঁয়ায় ফুটে উঠেছে নতুনভাবে।
১৯৪৪ সালের ১ আগস্ট শেষবারের মতো ডায়েরি লিখেছিল আনা। এর চার দিন পর তাদের গোপন আস্তানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নাৎসি বাহিনী। টেনেহিঁচড়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় বন্দী শিবিরে। জার্মানির আউশভিত্স্ বন্দী শিবিরে ১৯৪৫ সালের ৬ জানুয়ারি মারা যান আনার মা। আনা ও মারগটকে পাঠানো হয় বেরজেন-বেলসেন বন্দী শিবিরে। এরপর ফেব্রুয়ারি বা মার্চের শুরুর দিকে মারা যান আনার বড় বোন মারগট। ওই মার্চ মাসেই মৃত্যুবরণ করে আনা ফ্রাঙ্ক।
তবে সেখান থেকে ফিরে আসতে পেরেছিলেন আনার বাবা। তাঁর মাধ্যমেই আনার ডায়েরি প্রথম বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালের ২৫ জুন। ডায়েরিটি বই আকারে প্রকাশিত হওয়ার পর অকল্পনীয় সাড়া পড়েছিল বিশ্বে। অনেকে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে এই বইটির লেখক ১৩ বছরের একটা মেয়ে। ১৯৫২তে আমেরিকায় প্রথমবার বইটি প্রকাশিত হলে প্রথম মুদ্রণেই পাঁচ হাজার কপি বিক্রি হয়, তাও প্রথম সপ্তাহেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছাপার সংখ্যাটি বেড়েই চলেছে। এখন পর্যন্ত ৩৫টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে ডায়েরিটি। ইংরেজিতে বইটার নাম দেয়া হয়েছিল দ্য ডায়েরি অব এ ইয়াং গার্ল। যদিও আনা ফ্রাঙ্ক তার ডায়েরির নাম দিয়েছিল ‘দ্য সিক্রেট অ্যানেক্স’ (গুপ্ত মহল)।
এরপর যত দিন গেছে, বেড়ে চলেছে আনার পরিচিতি। ১৯৬০ সালের ৩ মে আমস্টারডামের সেই বাড়িটিকে মিউজিয়াম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এখানে রয়েছে সেই গুপ্ত মহল এবং আনার সময়ের সবকিছু। মিউজিয়ামে প্রজেক্টরে সব সময় দেখানো হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হিটলার, নাৎসি বাহিনী ও ফ্রাঙ্ক পরিবারের ছবি।
আনা লিখেছিলেন, ‘লাখো মানুষের যন্ত্রণা বুঝতে পারি আমি। তবু যখন আকাশের দিকে তাকাই, কেন যেন মনে হয় সব ঠিক হয়ে যাবে। মনে হয় এ নির্মম নিষ্ঠুরতারও অবসান হবে। আবারও ফিরে আসবে শান্তি...”