তোমার কি এ রকম মনে হচ্ছে যে তুমি জানো না তুমি আসলে কী চাও। আসলে কী তোমার ভালো লাগে! এ রকম যদি হয়ে থাকে, একদমই ভাবনার কিছু নেই। আসলে আমরা কেউই জানি না, আমরা কী চাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে আছে:
ফাল্গুনরাতে দক্ষিণবায়ে
কোথা দিশা খুঁজে পাই না।
যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই,
যাহা পাই তাহা চাই না।
যা চাই, তা ভুল করে চাই। আর যা পেয়েছি, মনে হয়, এটা তো আমি চাইনি। আর তোমরা যারা কিশোর, তাদের জন্য বাস্তবতা আরও কঠিন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই ‘ছুটি’ গল্পে বলেছেন, ‘তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। শোভাও নাই, কোনো কাজেও লাগে না। স্নেহও উদ্রেক করে না, তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে। তাহার মুখে আধে-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগল্ভতা। হঠাৎ কাপড়চোপড়ের পরিমাণ রক্ষা না করিয়া বেমানানরূপে বাড়িয়া উঠে; লোকে সেটা তাহার একটা কুশ্রী স্পর্ধাস্বরূপ জ্ঞান করে। তাহার শৈশবের লালিত্য এবং কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা সহসা চলিয়া যায়; লোকে সেজন্য তাহাকে মনে মনে অপরাধ না দিয়া থাকিতে পারে না। শৈশব এবং যৌবনের অনেক দোষ মাপ করা যায়, কিন্তু এই সময়ের কোনো স্বাভাবিক অনিবার্য ত্রুটিও যেন অসহ্য বোধ হয়।
সেও সর্বদা মনে মনে বুঝিতে পারে, পৃথিবীর কোথাও সে ঠিক খাপ খাইতেছে না; এইজন্য আপনার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সর্বদা লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী হইয়া থাকে। অথচ এই বয়সেই স্নেহের জন্য কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত কাতরতা মনে জন্মায়। এই সময়ে যদি সে কোনো সহৃদয় ব্যক্তির নিকট হইতে স্নেহ কিংবা সখ্য লাভ করিতে পারে তবে তাহার নিকট আত্মবিক্রীত হইয়া থাকে। কিন্তু তাহাকে স্নেহ করিতে কেহ সাহস করে না; কারণ সেটা সাধারণে প্রশ্রয় বলিয়া মনে করে। সুতরাং তাহার চেহারা এবং ভাবখানা অনেকটা প্রভুহীন পথের কুকুরের মতো হইয়া যায়।’
এই সময় তোমাদের মনে হতে পারে যে আমি কী চাই আমি জানি না। মনে হতে পারে যে কেউ আমাকে বুঝতে পারে না, যারা বোঝে, তারা ভুল বোঝে। এটা যে কেবল তোমার মনে হয়, তা নয়। এটা আমাদের মতো বয়স্ক মানুষদেরও মনে হয়। সোশ্যালসেল্ফ নামের একটা ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ২৭% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ মনে করেন, তাঁদেরকে হয় কেউ বোঝে না বা ভুল বোঝে। ৫০% লোক মনে করেন, তাঁরা একা এবং মানুষের সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগ নেই, মানে তাঁরা বিচ্ছিন্ন।
এই রকম যদি বড়দেরই মনে হয়, তাহলে ছোটদের তো মনে হবেই।
তো এই সমস্যা থেকে বাঁচার উপায় কী? প্রথম কথা হলো, এটাকে সমস্যা বলে মনে না করা। সবারই জীবন একই রকম। তুমি আলাদা রকম কেউ নও। দুই হলো, গালে হাত দিয়ে এটাকে সমস্যা বলে ভাবতে না বসা। তুমি সব সময় নিজেকে ব্যস্ত রাখো।
কী করে? এক. লেখাপড়া। দুই. খেলাধুলা। তিন. বইপড়া। চার. ছবি আঁকা। পাঁচ. হবি বা শখ নিয়ে ব্যস্ত থাকা। যেমন ডাকটিকিট সংগ্রহ করা, বাগান করা, রান্না করা। চার. বিতর্ক, আবৃত্তি, গান, নাচ, অভিনয়, গল্প বলা—এ রকম একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকা। খেলার সময় খেলা, পড়ার সময় পড়া, অবসর সময়ে একটা কিছু করা আর বাকি সময় ঠিকঠাক ঘুমানো। সাইকেল চালাতে পারো, সাঁতার শিখতে পারো। চুপচাপ বসে থেকো না। নিজেকে ব্যস্ত রাখো। কিশোর আলো পড়ো, কিশোর আলোর বুক ক্লাব গড়ে তোলো আর কিশোর আলোতে লেখা পাঠাও। একটা কিছু করো। বাবা-মাকে সাহায্য করো, ভাইবোনদের সঙ্গে গল্প করো। বাসার কাজে মাকে সহযোগিতা করো।
আরেকটা কথা আমি শুনি, আজকালকার শিশু-কিশোরেরা বুঝতে পারে না, কী তাদের প্রিয়, কোনটাকে তাদের ভালো বলা উচিত, কোন হবি বা শখ তাদের থাকা উচিত।
এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করার আগে বলি,
১. সারাক্ষণ হাতে মোবাইল বা গেজেট নিয়ে মাথাটা গুঁজে থেকো না। কতক্ষণ গেমস খেলবে, কতক্ষণ ইন্টারনেটে থাকবে, তার একটা নিয়ম থাকা উচিত। তুমি যেন ভিডিও গেমসে আসক্ত না হয়ে পড়ো।
২. নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখবে না। দরজা খোলা থাকতে হবে।
৩. মেহমান বাড়িতে এলে এগিয়ে যাবে। সালাম বা কুশল বিনিময় করবে। নিজে থেকে যেচে কথা বলবে।
৪. মা–বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাবে। বাইরের চেনা বা অচেনা মানুষের সঙ্গেও সুন্দর করে গল্প করবে।
৫. সামনে অতিথি থাকলে হাতের গেজেটের দিকে তাকিয়ে থাকবে না।
এরপর ওই সমস্যাটা নিয়ে কথা বলি। আমি জানি না, আমি কী চাই। আমার কী হতে ইচ্ছে করে। আমার কী ভালো লাগে। আমি কোন ধরনের গল্প পছন্দ করি। কোন খাবারটা আমার পছন্দ।
প্রথমে বলি জীবনের লক্ষ্য নিয়ে। ছোটবেলা থেকেই ডাক্তার হব, ইঞ্জিনিয়ার হব, কম্পিউটার নিয়ে পড়ব—এ ধরনের কঠিন প্রতিজ্ঞা করার দরকার কী! স্বপ্ন দেখো। কিন্তু খুব বেশি নির্দিষ্ট করে জীবনের লক্ষ্য স্থির কোরো না। নিজের মনটাকে খোলা রাখো। দৃষ্টিকোণ বড় করো। দিগন্ত যেন বড় হয়। অপশন যেন অনেকগুলো খোলা থাকে। যেমন তুমি সায়েন্স নেবে না আর্টস নেবে, এটা ভেবে রাখতে পারো। নাকি কমার্স পড়বে, ভাবো। এখন তোমার কিন্তু এইভাবে ভাবার দরকার নেই যে তোমাকে বুয়েটেই ভর্তি হতে হবে কিংবা ঢাকা মেডিকেল কলেজেই চান্স পেতে হবে।
সব সাবজেক্টই ভালো সাবজেক্ট। যদি সেটা তোমার ভালো লাগে আর যদি তুমি ভালো করো।
পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো করা খুব ভালো। অবশ্যই পরীক্ষার ফল ভালো করার চেষ্টা করবে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও যদি পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো না-ই হয়, তাহলেও মন খারাপ করা চলবে না। পরীক্ষার ফল ভালো করলে তুমি যা পড়তে চাইছ, তা-ই পড়তে পারবে। যা হতে চাইছ, তা-ই হতে পারবে। ভালো না হলে হয়তো জীবনের শেষে তুমি আরও ভালো করবে।
আর ভালো লাগা, মন্দ লাগা সব সময় বদল হয়। আজ তোমার হয়তো ব্যান্ডের গান ভালো লাগছে, কদিন পরে ভালো লাগতে পারে রবীন্দ্রসংগীত। আজ তোমার ভালো লাগছে চায়নিজ খাবার, কত দিন পর হয়তো বিরিয়ানি ভালো লাগবে। আবার একই সঙ্গে দুই বিপরীত জিনিসও ভালো লাগতে পারে। যেমন যিনি উচ্চাঙ্গসংগীত শোনেন, তিনিই হয়তো হার্ড রক শোনেন। যিনি ভাত ভর্তা–ভাজি খেতে ভালোবাসেন, তিনিই হয়তো মেক্সিকান ফুডও পছন্দ করেন। যিনি হুমায়ূন আহমেদের লেখা ভালোবাসেন, তিনিই হয়তো কঠিন কোনো প্রবন্ধের বই পড়েন, দর্শনশাস্ত্রের ইতিহাস নিয়ে গভীরভাবে চর্চা করেন।
তোমাদের বন্ধুবান্ধব ভালো হতে হবে। বন্ধুরা আড্ডা দিলে অনেক বিষয় সেই আড্ডা থেকে জানতে পারবে। যেমন তোমার বন্ধুরা কোন বইটা পড়ল। কোন ভালো সিনেমাটা দেখল।
আরেকটা কথা। আমাদের সবার পরিবারের আর্থিক সংগতি এক রকম নয়। আমার বাবা যদি বড়লোক হন, তাহলেও আমাকে মিতব্যয়ী হতে হবে। বন্ধুবান্ধবের সামনে টাকার গরম দেখানো চলবে না। আবার আমার পরিবার যদি কম আয়ে চলে, তাহলেও আমার মন খারাপ করে রাখা চলবে না। এসব না ভেবেই সমান মর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করেই মিশতে হবে। আমাদের প্রত্যেকের কতগুলো গুণ আছে, ভালো বৈশিষ্ট্য আছে। আমার ভেতরের শ্রেষ্ঠটা আমাকে বের করে আনতে হবে। তাহলে আমি লম্বা না বেঁটে, কালো না ফরসা, বড়লোক না গরিব—এসবে কিছু যায় আসবে না।
তবে সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ—এই কথাটা সব সময়ই মনে রাখতে হবে। বন্ধু নির্বাচনের সময় খেয়াল রাখতে হবে, বাবা-মা এই বন্ধুবান্ধবকে ভালো বলছেন কি না।
এদের কথা মা–বাবাকে খুলে বলতে পারব কি না।
এমন কিছু করবে না, যা মা–বাবার সঙ্গে তুমি শেয়ার করতে পারো না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও, এমনকি ইনবক্সে এমন কিছু করবে না, যা বাবা-মাকে তুমি দেখাতে পারবে না।
আসলে নিজেকে নিয়ে বেশি ভেবো না। আর আড়ালে কে কী বলল, তাতেও কিছু যায় আসে না।
তবে আমরা চাই, বাবা-মা যেন আমাদেরকে নিয়ে খুশি থাকেন।