মাসখানেক ধরে বিকেলবেলায় আমি ঝিমাই। পার্টটাইম জবের ফাঁকে বিরতিতে এই ঝিমানোর অভ্যাস হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে একসময় ঘুমিয়ে পড়ি। ছোট্ট ঘুম, যাকে ‘ন্যাপ’ বলে আরকি। বাংলাদেশে যখন ভাতঘুমের সময়, আমার তখন একটু জিরিয়ে নেওয়ার ঘুম। ঘুমে ঢলে পড়ার সময় শুধু মনে হয়, ঘুম ভাঙলেই দেখব আমি কিআর অফিসে কন্ট্রিবিউটর ডেস্কের পাশে বসে ঝিমাচ্ছি, আদনান মুকিত ভাই ঠেলে জিজ্ঞেস করছে, ‘আকিব, ঘুমাও কেন?’
২০২০ সাল থেকে আমি খুব কাছ থেকে কিআর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। প্রদায়ক হিসেবে কাজ করেছি কিআর অনলাইন সংস্করণেও। ওয়েবসাইট সম্পর্কে শূন্য জ্ঞান নিয়ে কাজ শুরু করা আমার হাতে বছর তিনেক কিশোর আলো ডটকমের বেশ কিছু দায়িত্ব ছিল।
দেশ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরে জাপানের ছোট্ট শহর বেপ্পুতে থাকছি গোটা একটা বছর হয়ে গেল। ঠিক এক বছর আগেও কিশোর আলো অফিসের কন্ট্রিবিউটর ডেস্কটায় বসে কাজ করতে করতে আমি এমনভাবেই ঝিমাতাম। একটু পরই ঘুম ভেঙে গলা উঁচু করে দেখতাম আদনান মুকিত ভাই ডাকছেন, হাতে থাকা লেখাটা শেষ করতে বলছেন। বছরখানেক ধরে আর কেউ ডাক দেয় না। তবে ভাই এখনো লিখতে বলেন, যেমনটা বলেছিলেন শুরুর দিন।
২০১৯ সালের শেষের দিকে আদনান মুকিত ভাই একদিন বললেন বিডিসাইক্লিস্টের ‘বিজয় রাইড’ নিয়ে লিখতে। কী লিখব, কীভাবে লিখব, কিছুই জানি না। তবে লিখলাম, যা–তা লিখলাম। লেখাটা ছাপা হওয়ার পর দেখলাম, কিআর পাতায় লেখাটা খুব একটা খারাপ লাগছে না পড়তে। কাঁপা কাঁপা হাতে ৫০০ শব্দের এক ফিচার ঘন্টা পাঁচেক লাগিয়ে লেখা আমি টানা দুই বছর কিআর প্রতিটি সংখ্যায় লেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিআর পাতায় গল্প-ফিচার লিখতে লিখতে একদিন খেয়াল করলাম, প্রথম আলোর বিভিন্ন পাতায়ও আমার লেখা যাচ্ছে। ‘নকশা’র লিড ফিচার কিংবা ‘বাণিজ্য’ পাতার কাঠখোট্টা লেখা—বাদ যাচ্ছে না কিছুই। এত দিন পরে এসে বুঝতে পারি, নিজেকে আবিষ্কার করেছিলাম সেদিনই, যেদিন কিশোর আলো থেকে লেখা চেয়েছিল আদনান মুকিত ভাই।
আমার দুনিয়ায় কেবল লেখালেখি নিয়ে হাজির হয়েছে কিআ, ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়; ‘জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ’—সবই শিখিয়েছে কিশোর আলো। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার শুরুর গল্পটা বলি। ২০১৬ সালে আমি থাকি ময়মনসিংহ। পড়ি মাত্র ক্লাস সেভেন। কিআনন্দের খবর পেয়ে একাই রওনা দিলাম ঢাকায়। স্বেচ্ছাসেবক নির্বাচন ইন্টারভিউয়ে গিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে স্বেচ্ছাসেবক নির্বাচিত হয়ে গেলাম। অতিরিক্ত স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শুরু করে চার বছর পর একদিন টের পেলাম, পাভেল ভাইয়ের সঙ্গে বসে আমি কিআর স্বেচ্ছাসেবক নির্বাচনের কাজ করছি। এই দিনগুলোয় আমি শিখেছি কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। জটিল সব পরিস্থিতি কীভাবে সহজে সামাল দিতে হয়। তবে সবচেয়ে বড় যেটা শিখেছি, কীভাবে ভালো মানুষ হওয়া যায়। খুব ভালো মানুষ এখনো হতে পারিনি, তবে মানুষ হওয়ার পথটা বাতলে দিয়েছিল কিশোর আলো ও সেখানকার মানুষেরা।
করোনাকালে আমি যখন ঘরে বসে আমার রুমের টাইলস গোনা শুরু করছি, তখন ঢাকা কিআ বুক ক্লাব কমিটি থেকে সিদ্ধান্ত হলো প্রতিদিন অনলাইনে বই নিয়ে কিছু একটা করার। কোনো দিন ফটোশপ ছুয়ে না দেখা আমি বসে পড়লাম গ্রাফিক ডিজাইন করতে। পাঁচ মিনিটের কাজ করলাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাগিয়ে। ফাইল হারানো, বাজে কালার সেন্স, ভুলভাল ছবি বসানো—বাদ পড়ল না কিছুই। আস্তে আস্তে একটু ভালো হওয়া শুরু করল আমার কাজগুলো। যা–তা ডিজাইন করা আমি কয়েক বছর পরই কিআর অনলাইনের সব ডিজাইন করতে লাগলাম। মাঝেমধ্যে প্রথম আলো পাতায় ছাপা হওয়া কিশোর আলোর বিজ্ঞাপনের জায়গায় ডিজাইনও দেখা যেত। কিশোর আলোর থেকে পাওয়া উৎসাহ ও সাহস কতটা শক্তভাবে আমার কাজের ওপর প্রভাব ফেলে, বুঝতে পেরেছিলাম তখন।
২০২০ সাল থেকে আমি খুব কাছ থেকে কিআর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। প্রদায়ক হিসেবে কাজ করেছি কিআর অনলাইন সংস্করণেও। ওয়েবসাইট সম্পর্কে শূন্য জ্ঞান নিয়ে কাজ শুরু করা আমার হাতে বছর তিনেক কিশোর আলো ডটকমের বেশ কিছু দায়িত্ব ছিল। প্রতিদিন শিখেছি কীভাবে নিজের বৃত্তের বাইরে গিয়েও কাজ করা যায়, কীভাবে চাইলেই সুন্দর কিছু তৈরি করা সম্ভব হয়। কিআ হাত ধরে ধরে আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে গোটা একটা ম্যাগাজিন প্রকাশ করতে হয়। লেখকের কাছে লেখা চাওয়া থেকে শুরু করে পেজ মেকআপ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ শিখেছি হাতে–কলমে। অদ্ভুত সুন্দর সব দিন কেটেছে আমার।
এত কিছু পাওয়ার পরও আমি একদিন ঘর ছাড়লাম। আমাকে যারা বড় করল, তাদের ছেড়ে পাড়ি জমালাম হাজার হাজার মাইল দূরে। চলে আসার সময় আনিস স্যার বললেন, আমাদের বাচ্চাটা চলে যায়। প্রতিদিন মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করা মানুষটা আমার জন্য মন খারাপ করল। আদনান মুকিত ভাই সব সময়ের মতো বললেন, ‘যত দূরেই যাও, লেখা দিয়ো।’ পাভেল মহিতুল আলম ভাই বললেন, ‘তুমি তো আছোই।’ আমি প্লেনে বসে দেখলাম আমার চোখ ভেজা। কী জানি কেন। আমার এখনো মনে হয়, আমি আসলে কাউকে ছেড়ে আসিনি। ওই শহরে, ওই অফিসে আমি একটা নিজেকে ফেলে চলে আসছি।
১১ বছরের লম্বা গল্প কয়েক শ শব্দে বলা খুব কঠিন। মায়া কাটানোটাও খুব কঠিন। আমি কাটাতে পারিনি। কাটাতে চাইও না। এখনো চেষ্টা করি কীভাবে কিআর সঙ্গে কাজ করা যায়। কিআও সুযোগ দেয়, আমি যেন দূরদেশে বসে নিজেকে কিআর অংশ ভাবতে পারি। প্রতি মাসেই কিশোর আলোর জন্য কাজ করছি, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কেবল একটা ব্যাপার ঠিক করতে পারছি না। বিকেলবেলার ছোট্ট ন্যাপ শেষে জেগে উঠে নিজেকে আমি পার্টটাইম জবের মাঝখানেই খুঁজে পাই। কিন্তু নিজেকে আর কিআর ডেস্কটায় পাই না।