আমাদের বাসায় কেন চড়ুই আসে না
কিছুদিন আগেও আমাদের বাসায় থাকত দুটো চড়ুই কিংবা আমরাই থাকতাম চড়ুইদের বাসায়। তিনতলার ওই বাসাটায় আগে থেকেই তো ছিল ওরা। কে জানে, আমরা গিয়েই হয়তো ওদের সংসারে অনুপ্রবেশ করলাম। আম্মাই তো ঘুলঘুলির ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আসা কিছু খড়কুটো সরিয়ে ফেলল পরিচ্ছন্নতা অভিযানের নামে। চড়ুই দুটো নিশ্চয়ই ক্ষুব্ধ হয়ে ভেবেছিল, ‘একি? আসামাত্রই এই অবস্থা? কদিন পর তো আমাদেরই উচ্ছেদ করে দেবে।’
হঠাৎ খুব অস্থির হয়ে উঠত চড়ুইগুলো। বুঝতাম, নতুন সদস্য আসছে তাদের বাড়িতে। রাতে বারান্দার দরজা খুললেই চমকে ঘরের ভেতর ঢুকে যেত একেকটা। তাড়াতাড়ি ফ্যান বন্ধ করে দিতাম আমি। ফ্যানে বাড়ি খেলে সব শেষ!
যদিও কদিন বাদে তারা ঠিকই বুঝে ফেলেছিল, আমরা তাদের হটাব না। চড়ুইদের আস্থা পেতে প্রতিদিন জানালা দিয়ে ভাত-মুড়ি ফেলতাম কার্নিশে। আম্মা টের পেত না কিংবা টের পেলেও সেটা বুঝতে দিত না আমাকে। মাঝে মাঝে কাক এসে ভাগ বসাত চড়ুইয়ের সেট মেনুতে। খুব রাগ হতো কাকের ওপর। নিজেই হয়ে যেতাম কাকতাড়ুয়া। কাক যেন চিরশত্রু আমার, আর আমি চড়ুইদের দলে।
অবশ্য সব সময়ই চড়ুইদের দলে আমি। এই বাসায় আসার আগে ছিলাম কলোনির চারতলায়। ক্ষমতাবান রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মতো বারান্দাটা দখল করে ফেলেছিল একদল চড়ুই। ভোর থেকেই তাদের কিচিরমিচির ঘুম ভাঙাত আমাদের। সত্যি বলতে কি, খুব অকৃতজ্ঞ ছিল সেই চড়ুইগুলো। নিজের হাতে খাবার দিতাম তাদের, অথচ বিনিময়ে রোদে শুকাতে দেওয়া কাপড়গুলোর ওপর তাদের প্রাকৃতিক কর্মের ছাপ রেখে যেত বদমাশগুলো। মনে মনে বলতাম, ‘হে চড়ুই তুমি ভুবনে ভুবনে/ ইয়ে করে যাও গোপন গোপনে’। খুব রেগে যেত আম্মা। চড়ুইগুলোর মতোই চেঁচামেচি করত একটানা—‘কালকেই তাড়ায় দেব সবগুলাকে! একটা কাপড় শুকাইতে দেওয়া যায় না এদের যন্ত্রণায়। এক কাপড় বারবার ধোয়া যায়? আর এই শয়তান ছেলেটা খাওয়ায় খাওয়ায় মাথায় তুলছে এগুলাকে। পড়ালেখার নাম নাই, চড়ুই খাওয়ায়! পড়ালেখা না করলে বড় হয়ে ওই পাখিওয়ালাই হইতে হবে। আবার যদি দেখি মুড়ি দিসো, তো খারাপ হবে বলে দিলাম। মুড়ির টিন আমি তালা দিয়ে রাখব…!’ না আমি, না চড়ুই—আম্মার কথায় পাত্তা দিত না কেউ। একাই বলে যেত নেতার মতো।
মাঝেমধ্যে চড়ুইগুলো কোথায় যেন উধাও হয়ে যেত হুট করে। তখন এই আম্মাই আবার মন খারাপ করে বলত, ‘পাখিগুলা গেল কই? তাড়ায় দিসো নাকি?’ কদিন পর আবার যখন ফিরে আসত পাখিরা, খুশি হতো বাসার সবাই। বাসায় চড়ুই থাকা নাকি ভালো।
হঠাৎ খুব অস্থির হয়ে উঠত চড়ুইগুলো। বুঝতাম, নতুন সদস্য আসছে তাদের বাড়িতে। রাতে বারান্দার দরজা খুললেই চমকে ঘরের ভেতর ঢুকে যেত একেকটা। তাড়াতাড়ি ফ্যান বন্ধ করে দিতাম আমি। ফ্যানে বাড়ি খেলে সব শেষ! কিন্তু ঘরে ঢুকে পড়া চড়ুইগুলো এত বোকা, সহজ রাস্তাটা চিনতেই পারত না কেন যেন। আরে বোকা, যেদিক দিয়ে ঢুকলি, ওই দিক দিয়ে বেরিয়ে যা, এত ছটফট করার কী আছে? কতবার বুক ধড়ফড় করা চড়ুইকে পৌঁছে দিয়েছি তার বাসায়, একটা ধন্যবাদও দেয়নি। কদিন পর যখন নতুন মুখ আসত চড়ুই পরিবারে, চুপিসারে দেখতে যেতাম ওদের। কেমন অদ্ভুতভাবে হাঁ করে থাকত সারা দিন। পারলে মনে হয় আকাশটাও গিলে ফেলবে টুপ করে। বড় হয়ে গেলে পরে বাসাটা ছেড়ে কোথায় যেন চলে যেত চড়ুইগুলো। কিছুদিন পর আবার আসত নতুন চড়ুই কিংবা সেই পুরানোগুলোই। চেনা তো আর যায় না, সব চড়ুই একই রকম মনে হয় আমার কাছে।
এখন একতলায় থাকি আমরা। বারান্দায়, জানালার কার্নিশে চড়ুইয়ের অবাধ যাতায়াত। যেমন করে রোজ বেল বাজিয়ে পত্রিকা দিয়ে যায় হকার, চড়ুইরাও কার্নিশে দাঁড়িয়ে ঠিক ঠিক ঘুম ভাঙাতে আসে আমার। রোজ, শুক্রবারও ছুটি নেই তাদের। কিন্তু ইদানীং চড়ুইদের মনে হয় কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। তারা আর আমাদের বাসায় আসে না। বারান্দার রশিতে ক্লথক্লিপ দোল খায় বাতাসে, চড়ুই নেই। ভোরে ঘুম ভাঙাতেও আসে না তাদের কোনো সদস্য। নতুন দালান উঠছে দুপাশে। ঘুম ভাঙে গ্রিল কিংবা টাইলস কাটার শব্দে। ইট গুঁড়া করার মেশিনটা চালু হয়ে যায় বেশ সকালেই। প্রচণ্ড শব্দে কতগুলো ইট ফুঁড়ে দেয়ালের ভেতরে ঢুকে যায় ড্রিল মেশিন। ওপর থেকে বিকট আওয়াজে নিচে এসে পড়ে রড, টিন, হাতুড়ি, বালির বস্তা কিংবা একটা শ্রমিক।
কার্নিশের বাসা ছেড়ে তাই চড়ুইগুলো পালিয়ে গেছে অন্য কোথাও। তাদের আর কী দোষ, আমারই তো পালাতে ইচ্ছে করে রোজ। শুধু দুটো ডানার অভাবে এখানেই পড়ে পড়ে ইট–রডের কান্না শুনি।