তোমরা যারা শিশু, কিশোর, তরুণ, তাদের জন্য আমার পরামর্শ হলো, বড় স্বপ্ন দেখবে। কিন্তু জীবনের লক্ষ্য ছোটবেলাতেই স্থির করে ফেলো না। কথাটার মানে আমি একটু বুঝিয়ে বলতে চাই।
স্বপ্ন কী? এই ব্যাপারে আমার সাকিব আল হাসানের কথা পছন্দ হয়েছে। হ্যাঁ, বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের কথাই বলছি। কিশোর আলোর পাঁচ নম্বর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সাকিব আল হাসান এসেছিলেন কিআনন্দ অনুষ্ঠান ২০১৮ করতে। সেই অনুষ্ঠানে আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্বপ্ন কী? সাকিব আল হাসান বলেছিলেন, যা শুনলে লোকে চমকে উঠবে, লোকে বলবে, না, এটা সম্ভব নয়—তা হলো স্বপ্ন। যা হওয়া সম্ভব, যা ঘটানো সম্ভব, সেটা তো বাস্তব। বাস্তব জিনিসকে আমরা কেন স্বপ্ন বলব? স্বপ্নের কথা শুনে লোকে যদি পাগলই না বলল, সেটা কখনোই স্বপ্ন নয়। তাই তো! আমি বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হব, ডাক্তার হব, বিজ্ঞানী হব—এগুলো তো সবই পূরণ করা সম্ভব। তাহলে এগুলো স্বপ্ন হলো কী করে? যদি কেউ বলে, আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমি পাখি হয়ে গেছি; কেউ যদি স্বপ্ন দেখে আমি মঙ্গলগ্রহে বসে আইসক্রিম খাচ্ছি বা আমি টাইমমেশিনে চড়ে আইনস্টাইনের সঙ্গে গল্প করছি—এগুলো হলো স্বপ্ন।
কী সেই স্বপ্ন?
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলতে লাগলেন, যদিও আমরা বর্তমানে আর ভবিষ্যতে অনেক বাধাবিপত্তির মধ্যে থাকব, তবুও আমি বলব, আমার একটা স্বপ্ন আছে, যেটা আমেরিকান স্বপ্নেরই অংশ। আর তা হলো এই জাতি জেগে উঠবে, আর এই জাতির সত্যিকারের বিশ্বাসকে বাস্তবে পরিণত করবে যে প্রত্যেকটা মানুষ সমান হিসেবেই জন্মগ্রহণ করে।
তিনি বলতে লাগলেন তাঁর স্বপ্নের কথা, একদিন ক্রীতদাসেরা আর তাদের ছেলেরা এবং ক্রীতদাসের মালিকেরা আর তাদের ছেলেরা ভাই ভাই হিসেবে একই টেবিলে বসতে পারবে। স্বাধীনতা আর ন্যায়বিচারের সমান ভূমিতে মুক্তভাবে চলাচল করতে পারবে।
হ্যাঁ, আগে লোকে যেটাকে বলত অসম্ভব, পরে সেটা সম্ভব হয়েছে, সেই রকম স্বপ্ন তো পৃথিবীতে বহু মানুষ দেখেছেন এবং সেই স্বপ্ন তাঁরা পূরণও করেছেন। যেমন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র (১৯২৯-১৯৬৮) আমেরিকায় কালো মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছিলেন। আগে আমেরিকায় কালো মানুষদের কোনো অধিকার ছিল না। ভোটের অধিকার তো দূরের কথা, সাদা মানুষদের সঙ্গে একই বাসে-ট্রেনে তারা অনেক সময় উঠতে পারত না, একই রেস্তোরাঁয় ঢুকতে পারত না, একই স্কুলে পড়তে পারত না। মার্টিন লুথার কিং ১৯৬৩ সালে ওয়াশিংটনে একটা সমাবেশে ঘোষণা করলেন, আমার একটা স্বপ্ন আছে।
তার সেই কথা সেদিন স্বপ্ন মনে হয়েছিল। কিন্তু আজ তা অনেকটাই বাস্তবে পরিণত হয়েছে। তবে ওই সংগ্রাম চলছে।
কিংবা আমরা বলতে পারি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। তিনি যখন স্বাধীন বাংলাদেশের কথা ভাবতেন, তখন কেউই তা কল্পনা করতে পারত না। কিন্তু তিনি জানতেন যে, এই দেশ একদিন স্বাধীন হবে, আর তা করার জন্য তিনি জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। সারাটা জীবন তিনি সংগ্রাম করলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি অংশ নিলেন। পাকিস্তানের দুই অংশ পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তান মিলেই তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেন। সারা বাংলাদেশ স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হলো। তিনি বললেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” সেই সময় আমেরিকানরা বলতে লাগল, আচ্ছা, বাংলাদেশ যে স্বাধীন হতে চায়, স্বাধীন হয়ে ওরা কী করবে? ওরা তো খুব গরিব। ওদের তো কোনো সম্পদ নেই। ওই দেশ তো অর্থনৈতিকভাবে টেকসই হবে না। ইংরেজিতে ওরা রিপোর্ট লিখেছিল, ভায়াবল হবে না। কেন ওরা স্বাধীন হতে চাইছে?
কিন্তু বাংলাদেশ কেবল স্বাধীন হয়নি, অর্থনৈতিক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে এখন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বহু ক্ষেত্রে ভালো করছে। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ভারতের মানুষের চেয়েও ভালো। আমরা দ্রুত একটা বড় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবেও গড়ে উঠতে যাচ্ছি। আমেরিকান পণ্ডিতদের আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এর পেছনে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন।
কাজেই তোমাদের বলব, স্বপ্ন দেখো। বড় বড় স্বপ্ন। নিজের জীবন নিয়েও বড় স্বপ্ন দেখো। চারপাশের মানুষদের নিয়েও বড় স্বপ্ন দেখো। এগুলো যে বাস্তবায়িত হতেই হবে, তার নিশ্চয়তার কোনো দরকার নেই। কারণ তুমি স্বপ্ন দেখছ, বাস্তবের কথা বলছ না।
কিন্তু ছোটবেলাতেই পণ করার দরকার নেই যে, ডাক্তার আমাকে হতেই হবে। ইঞ্জিনিয়ার আমাকে হতেই হবে। ব্যারিস্টার আমাকে হতেই হবে। ছোটবেলায় তুমি বলতেই পারো, আমি বড় হয়ে পাইলট হব। অ্যাস্ট্রোনট হব। কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট হব। বলতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু সেটা যেন ধনুর্ভাঙা পণ না হয়।
আমরা এইবার আবারও ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের গল্পটা বলব। এ পি জে আবদুল কালাম হতে চেয়েছিলেন বিমানবাহিনীর পাইলট। সে জন্য তিনি দেরাদুনে গিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। আটজনকে নেওয়া হবে। এ পি জে আবদুল কালাম পরীক্ষায় হলেন নবম। খুব মন খারাপ করে তিনি একটা নদীর ধারে বসে আছেন। এই সময় একজন সাধু এলেন তাঁর কাছে। বললেন, খোকা, তুমি কেন একা একা নদীর ধারে বসে আছ? কেন তোমার মন খারাপ?
এ পি জে আবদুল কালাম বললেন, আমার জীবনের আর কোনো মানে নেই। আমি পাইলট হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছি। এই জীবন নিয়ে আমি এখন কী করব?
সাধু বললেন, তুমি পরীক্ষায় ফেল করেছ। এর একটা মানে আছে। তা হলো, নিয়তি তোমাকে বিমানবাহিনীর পাইলট হওয়ার জন্য তৈরি করেনি। তোমার ভাগ্যে নিশ্চয়ই অন্য কিছু হওয়া নির্ধারিত করে রাখা আছে। তুমি ওঠো। যাও। অনুসন্ধান করো যে নিয়তি তোমাকে কী হওয়ার জন্য বানিয়েছে। যাও। ওঠো। অনুসন্ধান করো।
এ পি জে আবদুল কালাম উঠলেন। তিনি মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান পড়লেন। হলেন ভারতের সবচেয়ে নামি মহাকাশবিজ্ঞানীদের একজন। শেষে ভারতের রাষ্ট্রপতিও (২০০২-২০০৭) হয়েছিলেন তিনি।
কাজেই আমাকে পাইলট হতেই হবে, আমাকে ডাক্তার হতেই হবে—এ ধরনের গোঁয়ার্তুমির কোনো মানে হয় না। কিন্তু বড় স্বপ্ন দেখো। তাতে কোনো ক্ষতি নেই।